লেবার দলীয় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লেমেন্ট অ্যাটলির হাত দিয়েই ১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশ ‘স্বাধীন’ হয়েছিল। তিনি ফ্রান্সের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সমরনায়ক ও পরবর্তী রাষ্ট্রপ্রধান চার্লস দ্য গল সম্পর্কে একবার বলেছিলেন, ‘উনি সেনাপতি হিসেবে খুব ভালো হতে পারেন, কিন্তু রাজনীতিবিদ হিসেবে ছিলেন খুবই নিম্নমানের।’
এই ইটের জবাবে চার্লস দ্য গল যে পাটকেলটা মেরেছিলেন, সেটা এখন রাজনৈতিক সাহিত্যে মোটামুটি প্রবাদ-প্রবচনের মতো হয়ে গেছে। দ্য গল বলেন, ‘রাজনীতি এমনই গুরুতর বিষয় যে এটা শুধু রাজনীতিবিদদের হাতে ছেড়ে দেওয়া নিরাপদ না।’
কোনো দেশের আইন, আদালতব্যবস্থা, রাষ্ট্রের গঠনতন্ত্র (সংবিধান), ন্যায়বিচার—এগুলোর ক্ষেত্রেও কথাটি খাটে। এগুলোও এত গুরুত্বপূর্ণ যে শুধু আইনজ্ঞদের হাতে ছেড়ে দেওয়া নিরাপদ নয়। নাগরিক, পেশাজীবী ও দেশের সামগ্রিক জনগণের একটি অংশের এগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত থাকা ও মনোযোগ দেওয়া খুব জরুরি। অথচ আমাদের দেশে উল্টোটা ঘটছে।
আমাদের দেশে আইনকানুন-বিচারব্যবস্থাকে দুর্বোধ্য কিংবা অগম্য অথবা ‘একেবারেই পাতে দেওয়ার যোগ্য নয়’, এমন কিছু একটা মনে করে কোনোক্রমে একে এড়িয়ে যাওয়ার একটা সচেতন বা অবচেতন দৃষ্টিভঙ্গি যেন বিরাজ করে আমাদের নাগরিক সমাজ বা বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে। কিন্তু আমাদের সবার যাপিত জীবনের সঙ্গে প্রতিদিনই এ বিষয়গুলো কোনো না কোনোভাবে আমাদের স্পর্শ করে যায়।
আমি একটু উত্তরাধুনিক তাত্ত্বিক ইয়ুর্গেন হাবারমাসের শরণ নিতে চাই। উনি বলেছেন, আইন একদিকে কাজ করে আধুনিক যুগের সামাজিক ঐক্যবদ্ধতার প্রাথমিক মাধ্যম হিসেবে। অন্যদিকে, এর ভূমিকা দাঁড়ায় ক্ষমতা হিসেবে; যে ক্ষমতা দিয়ে শাসিতদের আনুগত্য ও বাধ্যতা আদায় করা হয়। কারণ, আধুনিক সমাজে ক্ষমতা একাকী নিজের বৈধতার নিশ্চয়তা দিতে পারে না। আইন শাসিতদের সম্মতি আদায়ের মাধ্যমেই ক্ষমতাকে বৈধ করে তোলে।
আইন সম্পর্কে এত খারাপ কথা আপনারা শুনেছেন কি না জানি না! আমি শুনিনি। অথচ এগুলো খুবই সত্যি কথা। ক্ষমতার ‘লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা’ বা রাষ্ট্রভাষা হচ্ছে আইন। রাষ্ট্র, সরকার, ক্ষমতা সবাই এই ভাষায় কথা বলে। এখন এই ভাষা না বুঝলে বা অন্তত বোঝার একটা সচেতন চেষ্টা না থাকলে জনগণ রাষ্ট্রীয় ‘কলকবজার অর্কেস্ট্রা’ বুঝবে কীভাবে?
এমন তো নয় যে রাষ্ট্র বা ক্ষমতাকে এড়িয়ে আমরা বেশ চলতে পারব। মানুষের ইতিহাসের এই পর্যায়ে এসে আমাদের একে উপেক্ষা করার উপায় নেই। এর ভেতরেই নিজেদের স্থাপন করে নিতে হবে। বড়জোর আমরা একটা উন্নততর রাষ্ট্র গঠন করতে পারি। আবার ধরুন ক্ষমতা, রাজনীতি, রাষ্ট্র, সরকার—এর সবকিছুতেই নাগরিকের একটা ন্যায্য হিস্যা আছে। রাষ্ট্রের কাছ থেকে সেই অধিকার আপনি বা আমি বুঝে নেব কীভাবে?
আইনকানুন, বিচারব্যবস্থাসহ অন্যান্য ‘স্টেট এপারেটাস’ দিয়ে রাষ্ট্র বা নানা কর্তৃপক্ষ, করপোরেশন আমাকে-আপনাকে সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখে বড় ভাইয়ের মতো করে। একদিকে নানাবিধ মতাদর্শের উৎপাদন, পুনঃপুন বিতরণের মাধ্যমে আমাদের চোখ আর মগজ দুটোই বোঝাই করে রাখে। অন্যদিকে, নানা ইলেকট্রনিক গেজেট ও অ্যাপস অন্তর্জালে সারাক্ষণ নজরদারিতে রাখে বিগ-ব্রাদারের মতো।
গোদের ওপর বিষফোড়া হিসেবে আজকালকার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, বিগ ডেটা অ্যানালাইসিসের মাধ্যমে আমাদেরকে অনুসরণ করে, আমাদের মন ও আচরণ বোঝার চেষ্টা করে। মোটামুটি এলেম হাসিল করে আমাদেরকে তাদের ছকে একবার ফেলে দিতে পারলেই কেল্লা ফতে। এবার কিন্তু আমি বা আপনিই অজান্তে, নিজে থেকে এগিয়ে এসে তাদের ধ্যানধারণা, চিন্তা, মতবাদ, কর্মপদ্ধতির সাবস্ক্রাইবার, ফ্যান, ফলোয়ার হয়ে উঠি।
এই অন্তহীন আইনি ও গোপন নজরদারির ভেতরে থেকেই আমাদের আইন-বিচারব্যবস্থাগুলোকে ক্রমাগত অধ্যয়ন, পর্যালোচনা, নিত্যনতুন ডিসকোর্স নির্মাণ-বিনির্মাণের ভেতর দিয়ে রাষ্ট্র ও ক্ষমতাকেই কাউন্টার সার্ভিল্যান্সের ওপর রাখতে হবে। ক্ষমতার ভাষা বুঝে, রাষ্ট্রের মন পড়ে রাষ্ট্রের সঙ্গে ডায়ালগে লিপ্ত হওয়া না গেলে রাষ্ট্র ‘ওয়াকওভার’ পেয়ে যায়। সে বুঝে যায় যে আপনি তার সঙ্গে ডিল (মোকাবিলা) করতে সক্ষম নন। আর একবার যদি ক্ষমতা বুঝে যায় যে, আপনি ‘দুধভাত’; আপনাকে খড়বিচালি, মুড়িমুড়কি বা হাওয়াই মিঠাই দিয়ে ব্যতিব্যস্ত রাখা যায়, তাহলে তার নাগাল আর পাবেন না।
আইন-আদালতকে আমাদের পাশ কাটিয়ে যাওয়ার প্রবণতার নানা কারণের মধ্যে আমার কাছে দুটি কারণকে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য মনে হয়। সাধারণ মানুষ যে কারণে পাশ কাটিয়ে যেতে চায় তা হলো ইংরেজির প্রাধান্য। আইনকানুনগুলোর সিংহভাগই এখনো ইংরেজিতে লেখা। উচ্চ আদালতের ভাষাও ইংরেজি।
আর দ্বিতীয় কারণটি মনে হয়, যে ইংরেজি আইন-আদালতে চলছে সেটা মুখের কথা, খবরের কাগজ, সাহিত্য বা গল্প-উপন্যাসের মতো সাবলীল নয়। এই ভাষা জটিল, ঘোরানো-প্যাঁচানো, পরিভাষা আর জারগনে ভরপুর। আমার মনে হয়, আইনের জগতের বাইরের মানুষদের দেশের সংবিধান, আইনকাঠামো বা বিচারব্যবস্থা বোঝার ক্ষেত্রে কিছু শব্দ, ধারণা, তত্ত্ব, আইনি ভাষা, পদ্ধতি, পরিভাষা ইত্যাদি প্রতিবন্ধকের ভূমিকায় দাঁড়িয়ে থাকে। এগুলোকে সহজভাবে ব্যাখ্যা করা জরুরি।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, পৃথক্করণ—এগুলো নিছক উকিল আর বিচারকদের বিষয় নয়। সমগ্র দেশের প্রত্যেক নাগরিকেরই প্রতিদিনের ন্যায্য হিস্যা যুক্ত আছে, এসব বিষয়ের সঙ্গে। তাই এগুলো কী, সেটা পড়া ও বোঝার হক যেমন আছে, তার চেয়ে বেশি আছে দায়িত্ব।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে নতুন একটি রাষ্ট্র গঠন করার গাঠনিক ক্ষমতা অর্জন করে এ দেশের নাগরিকেরা। এর বলে ১৯৭২ সালে যে রাষ্ট্র গঠনতন্ত্রটি প্রণয়ন করা হয়, সেটি প্রায় একতরফাভাবেই রচনা করা হয়েছিল। জনগণের সম্পৃক্ততা ছিল খুবই কম। বিদ্ব্যৎ-সমাজ থেকেও যথাযথ পর্যালোচনা ও চাপ পরিলক্ষিত হয়নি সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়ায়। তাই গণসার্বভৌমত্বের অমিয়সুধাও জোটেনি জনতার পাত্রে।
স্বাধীনতার লাভের গুড় গণবিরোধী পিঁপড়াদের খেয়ে নেওয়ার ব্যবস্থাই কায়েম করেছিলেন সেই সময়ের নেতারা। ১৯৯০ সালে আরেকবার যখন গাঠনিক ক্ষমতা এ দেশের জনগণের হাতে আসে, তখনো এর গুরুত্ব হয়তো আমরা পুরোটা বুঝতে পারিনি। তার সর্বশেষ পরিণতি হয় জাতির ঘাড়ে জোয়ালের মতো জেঁকে বসা ফ্যাসিবাদী শাসন।
আইন-আদালত, রাষ্ট্রকাঠামো, ন্যায়বিচার, এগুলোকে সারাক্ষণ পাহারা দিয়ে রাখতে হয়। তা না হলে এসব অধিকার নাগরিকের বেহাত হয়ে যায়। আইনকানুন পড়ে জজ সায়েবেরা বেতন আর উকিল সাহেবেরা ফি পান। আর নাগরিকেরা সচেতন না থাকলে পাবেন বিপদ। বিপদে যাতে পড়তে না হয় তার জন্য লাগবে বিচারব্যবস্থা, আইন-সংবিধানের পঠনপাঠন ও জানাবোঝা। তাহলেই কেবল প্রতিরোধ করা যাবে, সাংবিধানিক ফ্যাসিবাদ, তৈরি হবে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামো।
মিল্লাত হোসেন লেখক ও আইনবিদ