কাতার ইতিহাস গড়ছে। রোববার (আজ ২০ নভেম্বর) দেশটি বিশ্বের বৃহত্তম ক্রীড়া ইভেন্টের সেই আয়োজক হিসেবে স্বীকৃত হচ্ছে, যে এযাবৎকালে এই অনুষ্ঠানের আয়োজকদের মধ্যে আকারে সবচেয়ে ছোট দেশ। এই বৈসাদৃশ্যকে উদ্যাপন করতে ফিফা বিশ্বকাপের আগের দুটি বিশাল আয়োজক দেশের কথা ভাবুন: একটি রাশিয়া, আরেকটি ব্রাজিল।
যদিও কাতারকে কূটনীতিকদের চোখে অনেকে ‘সফট পাওয়ার’ এবং ‘স্মার্ট পাওয়ার’ হিসেবে এই মুহূর্তে কৃতিত্ব দিচ্ছেন, তবে বিশ্বকাপ ফুটবলকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের চোখে দেখার চেয়ে তার চেয়ে বেশি বিস্তৃত নজরে দেখতে হবে।
এডওয়ার্ড সাঈদ এবং গায়ত্রী স্পিভাকের মতো উত্তর-ঔপনিবেশিক পণ্ডিতেরা যুক্তি দিয়েছেন, প্রাচ্যের কোনটি ভালো, কোনটি মন্দ তা ইউরোপ-আমেরিকানদের কল্পনাপ্রসূত সিদ্ধান্তই নির্ধারণ করে থাকে। এবারের বিশ্বকাপ সেই ভাষ্যকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার একটা মোক্ষম সুযোগ করে দিয়েছে।
সব মিলিয়ে কাতারে বিশ্বকাপ আয়োজনের মধ্যে জাদুকরি কিছু আছে। বিশ্বকাপের ২২তম আসরের আয়োজক দেশ হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে দোহা বিশ্বের সামনে উপস্থাপনের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেছে। এর জন্য তারা হাইড্রোকার্বন শিল্প থেকে উপার্জিত আয়কে দেশের নানা ধরনের অবকাঠামো, বিশেষ করে রাস্তাঘাট, পরিবহন এবং প্রযুক্তির আধুনিকীকরণের জন্য ব্যবহার করেছে।
কাতারিরা দ্রুত নিজেদের তথ্যপ্রযুক্তির আগ্রহী ব্যবহারকারীতে রূপান্তরিত করেছে। দোহা নিজেকে বলা যায় একটি গ্রাম থেকে একটি ঝকমকে শহরে এবং বিভিন্ন প্রবাসী সম্প্রদায়ের বাসযোগ্য জনপদে পরিণত করতে দ্রুতগতিতে আধুনিকীকরণে ব্যস্ত রয়েছে। এটি এখন অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে সজ্জিত এমন এক শহর, যা কাতারিদের আরও বেশি ডিজিটাল অ্যাক্সেসিবিলিটি নিশ্চিত করেছে; আরও বেশি কানেকটিভিটি দিয়েছে; ই-গভর্ন্যান্স এবং ব্যাংকিং বা স্বাস্থ্য পরিষেবাকে আরও অনেক বেশি দক্ষ করে তুলেছে।
যদিও ফুটবলের মাঠ আন্তর্জাতিক ঐক্য এবং ক্রীড়াঙ্গনের ভ্রাতৃত্ববোধকে অনুপ্রাণিত করে বলে মনে করা হয়, তথাপি ফুটবলের বৃহত্তম এই কার্নিভ্যালেও ‘আমরা বনাম অন্যরা’ধর্মী শ্রেণি বিভক্তি থেকে কাতার রেহাই পায়নি। এই নিরিখেই বিশ্বকাপের আগপর্যন্ত পশ্চিম একটানা কাতারের বিরুদ্ধে বর্ণবাদী ও কুরুচিপূর্ণ প্রচার চালিয়ে গেছে।
কাতারিরা বিদেশিদের সঙ্গে ওঠাবসায় অভ্যস্ত এবং বিশ্বকাপ এটি প্রমাণ করতে তাদের সামনে একটি সুযোগ করে দিয়েছে। পশ্চিমে গৎবাঁধা ধারণা হিসেবে কাতারিদের ‘ধর্মান্ধ মুসলিম’ মনে করা হয়। তার জের ধরেই সম্প্রতি কাতারের জাতীয় ফুটবল দলকে ব্যঙ্গ করে প্যারিসে ইসলামবিদ্বেষী কার্টুন আঁকা হয়েছে। তাদের সেই ধারণা মিথ্যা প্রমাণ করার এবং বহু সংস্কৃতির সঙ্গে সখ্য প্রদর্শনের আরেকটি সুযোগ কাতারের সামনে এনেছে এই বিশ্বকাপ।
কাতার বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ হওয়ার পর যতটা অবমাননার শিকার হয়েছে, এর আগে অন্য কোনো দেশ ততটা হয়েছে কি? চরমভাবাপন্ন জলবায়ুর কারণে ভেন্যু হিসেবে কাতারকে বেছে নেওয়া ঠিক হয়নি বলে অনেকে সমালোচনা করলেও ইতিপূর্বে এ ধরনের আয়োজক অন্য ছোট দেশগুলো সে ধরনের সমালোচনার মুখে পড়েনি। যেমন ১৯৫৪ সালে সুইজারল্যান্ড আয়োজক ছিল। সেখানকার আবহাওয়াও দুর্বিষহ চরমভাবাপন্ন ছিল।
কিন্তু তা নিয়ে তখন তেমন কোনো সমালোচনা ওঠেনি। ১৯৯৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসে বিশ্বকাপের ফাইনাল আয়োজিত হয়েছিল। ওই অঙ্গরাজ্যে কয়েক দশকের মধ্যে দেশের সবচেয়ে খারাপ বর্ণবাদী দাঙ্গার মাত্র দুই বছর পর সেখানে ফাইনাল খেলার আয়োজন করা হয়।
মুসোলিনির ফ্যাসিবাদী শাসনাধীন ইতালিতে বিশ্বকাপ আয়োজিত হয়েছে; আর্জেন্টিনার নৃশংস সামরিক জান্তার অধীনে বিশ্বকাপ আয়োজিত হয়েছে। কিন্তু সেখানে এর আয়োজন করা উচিত হয়নি—এমন কথা কেউ বলেনি। ব্রাজিলে ২০১৪ সালে বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজনের সময় বিদেশিদের নজর থেকে দেশটি দারিদ্র্য আড়াল করতে বহু স্থানীয় গরিব মানুষকে উচ্ছেদ করেছিল। প্রবলভাবে সমকামী বিরোধীদের উত্থানের মধ্যে ২০১৮ সালে রাশিয়ায় বিশ্বকাপ আয়োজিত হলেও কাতারের মতো তাদেরও সমালোচনার মুখে পড়তে হয়নি।
এই দেশগুলো যা-ই করুক না কেন, তাদের বৈধ আয়োজক হিসেবেই দেখা হতো বা হয়; কারণ, পশ্চিমে ফুটবলকে শুধু তাদেরই ‘সম্পদ’ হিসেবে মনে করা হয়। বিপরীতে, কাতার যখন আয়োজক হিসেবে সবাইকে টক্কর দিয়ে প্রতিযোগিতায় জিতে গেল, ঠিক সেই মুহূর্ত থেকে বিষয়টিকে ঘৃণার সঙ্গে দেখা হচ্ছিল। কাতারের এই সুযোগ প্রাপ্তিকে পশ্চিমারা বহিরাগত অভিজাতদের অবৈধ অনুপ্রবেশ হিসেবে দেখছিল।
প্রকৃতপক্ষে, অন্যান্য আরব, এশীয়, আফ্রিকান এবং দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকার দেশগুলোর মতো ফুটবল কাতারে এসেছিল ঔপনিবেশিকতার মাধ্যমে (যখন দেশটি ১৯১৬ থেকে ১৯৭১ সালে পর্যন্ত ব্রিটিশ শাসনাধীন ছিল)। ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম (বিপি) যে আদি কোম্পানি থেকে উদ্ভূত, সেই অ্যাংলো-পার্সিয়ান অয়েল কোম্পানি (এপিওসি) ১৯৩০–এর দশকের শেষের দিকে কাতারে তেল অনুসন্ধান ও উৎপাদন শুরু করে। ১৯৪০–এর দশকে দেশটিতে ফুটবল খেলা শুরু হয়। উপসাগরীয় অঞ্চলে প্রথম ঘাসের পিচসহ ফুটবল মাঠ ছিল দোহা স্টেডিয়াম। দেশটি স্বাধীন হওয়ার কয়েক বছর আগে সেখানে ১৯৬০ সালে লিগ প্রতিযোগিতা শুরু হয়।
মজার বিষয় হলো, উত্তর-ঔপনিবেশিকতার গবেষণায় ফুটবল সম্পর্কে তেমন কিছু বলা হয়নি। অথচ সাবেক উপনিবেশের অনেক বস্তি থেকে অনেক ফুটবল তারকার জন্ম হয়েছে। যেমন ব্রাজিলের সাও পাওলো থেকে পেলে; জ্যামাইকার কিংসটন থেকে রহিম স্টার্লিং। আলজেরিয়ার রাবাহ মাদজার থেকে মিসরের মোহাম্মদ সালাহ—এমন অনেক আরব খেলোয়াড় ইউরোপের বড় বড় ক্লাবে যুক্ত হয়েছেন।
এখনকার ফুটবল বিশ্বকাপ সাবেক ঔপনিবেশিক শক্তির সাংস্কৃতিক অনুকরণে অনুশীলন করা ঠিক হবে না। কিন্তু এখনো ফুটবলে বর্ণবাদ ও ঔপনিবেশিক মানসিকতার প্রকাশ ঘটে। পশ্চিমে ফুটবল যখন বর্ণবাদকে মোকাবিলা করার জন্য লড়াই করছে, তখন সম্প্রতি প্যারিসে ব্রাজিলিয়ান খেলোয়াড় রিচার্লিসনের দিকে বর্ণবাদী আচরণ করে কলা ছুড়ে মারা হয়েছে।
কাতারের স্টেডিয়ামে যাতে বিশ্বকাপের সময় এ ধরনের ঘটনা না ঘটে, সে জন্য অ্যালকোহলমুক্ত স্টেডিয়ামগুলো ভূমিকা রাখতে পারে। ইউরোপীয় ফুটবল অঙ্গনে অ্যালকোহলঘটিত সহিংসতা, বর্ণবাদ এবং নোংরা ভাষায় গালি দেওয়ার ঘটনা অহরহ ঘটে থাকে। সে ধরনের ঘটনা যাতে না ঘটে, সে জন্য কাতার স্টেডিয়ামে অ্যালকোহল নিষিদ্ধ করেছে। তবে তারা খেলাটি উপভোগ করার বিকল্প উপায় রেখেছে, যা কাতারের স্থানীয় মূল্যবোধকে উপেক্ষা করবে না।
কাতারিরা বিদেশিদের সঙ্গে ওঠাবসায় অভ্যস্ত এবং বিশ্বকাপ এটি প্রমাণ করতে তাদের সামনে একটি সুযোগ করে দিয়েছে। পশ্চিমে গৎবাঁধা ধারণা হিসেবে কাতারিদের ‘ধর্মান্ধ মুসলিম’ মনে করা হয়। তার জের ধরেই সম্প্রতি কাতারের জাতীয় ফুটবল দলকে ব্যঙ্গ করে প্যারিসে ইসলামবিদ্বেষী কার্টুন আঁকা হয়েছে। তাদের সেই ধারণা মিথ্যা প্রমাণ করার এবং বহু সংস্কৃতির সঙ্গে সখ্য প্রদর্শনের আরেকটি সুযোগ কাতারের সামনে এনেছে এই বিশ্বকাপ।
কাতার সেই ধারণা ভালোভাবে বদলে দিতে পারবে বলে আশা করা যায়।
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
লারবি সাদিকি কাতার ইউনিভার্সিটির আরব ডেমোক্রেটাইজেশনের অধ্যাপক