পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে ‘নির্বোধ’ হতে চাইবেন কে

সক্রেটিসের ঐতিহাসিক একটা কথা আছে। তিনি নির্বোধ ব্যক্তিদের সম্পর্কে বলেছিলেন, তাঁরা যে জানেন না, তাঁরা সেটাও জানেন না। আমাদের আশপাশে এ রকম অনেক নির্বোধ মানুষের বসবাস। উচ্চশিক্ষিত, সুবেশী, দক্ষ লোকদের কিছু কিছু আচরণ আমাদের রীতিমতো হতাশ করে। কারণ, তাঁরা মাঝেমধ্যে এমন সব সিদ্ধান্ত নেন যে তাঁদের নির্বোধ না বলে উপায় থাকে না। অথবা তাঁরা জনসাধারণকে বোকা বানানোর চেষ্টা করেন।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজেরাই নিজেদের বোকামির জালে আটকে পড়েন। যদিও এই বোকামিকেই সফলতা বলে প্রচার করে কৃতিত্ব নিতে চান। অন্যরা যে তাঁদের বোকামি ধরে ফেলেছেন, এই বিষয়ও তাঁরা বুঝতে পারেন না।

এই রকম একটি নির্বোধপনার জ্বলন্ত উদাহরণ হচ্ছে দেশ থেকে পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার সুযোগ দেওয়া। চলতি অর্থবছরে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার সুযোগ দিয়েছিল সরকার। নীতিনির্ধারকেরা মনে করেছিলেন এই সুযোগে সুর সুর করে পাচারকারী ব্যক্তিরা অর্থ ফিরিয়ে আনবেন। যদিও বাজেট ঘোষণার পর অনেকেই এর সমালোচনা করেছিলেন। যাঁরা অর্থ খাতের এই বিষয়ে কমবেশি খোঁজ রাখেন বা অর্থ পাচার নিয়ে জানেন-বোঝেন, তাঁদের অনেকেই বলেছিলেন পাচার হওয়া অর্থ ফেরত পাওয়া দুরূহ এক আশা।

অর্থ বছরের ১০ মাস চলে গেছে। এখন পর্যন্ত এক টাকাও ফেরত আসেনি। এ নিয়ে প্রথম আলোতে বিস্তারিত সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ওই প্রতিবেদন অনুসারে রাজস্ব বোর্ড এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জানতে চেয়ে শূন্য হাতে ফিরেছে। কারণ, বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে এক টাকাও কেউ ফিরিয়ে আনেননি। পাচার করা টাকা ফিরিয়ে আনার কথাও নয়।

কারণ, পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনলে ৭ শতাংশ হারে কর দিতে হবে। যে টাকা চলে গেছে সেই টাকা কর দিয়ে ফিরিয়ে আনবেন কে? যাঁরা নানা কৌশল অবলম্বন করে, ফাঁকি দিয়ে দেশে থেকে টাকা বের করে নিলেন, তাঁরা আবার কর প্রদান করবেন—এ ধরনের ভাবনা কীভাবে এল নীতিনির্ধারকদের মনে?

মনে রাখতে হবে অর্থ পাচারকারী ব্যক্তিরা নিরীহ গোছের কেউ নন। তাঁরা বোকাও নন। পাচারকারী অনেকের রাজনীতির সঙ্গে সংযোগ ও ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকতে পারে। ফলে কেউই অর্থ ফিরিয়ে এনে পাচারকারীর কালিমা গায়ে লাগাতে চাইবেন না। কেউ কি স্বেচ্ছায় নিজেকে চোর ঘোষণা করবেন?

বস্তুত পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আসার খুব একটা সুযোগও নেই। কারণ, এই টাকা বিদেশে বিভিন্ন খাতে খরচ হয়ে গেছে। সম্ভবত পাচার করা অর্থের সিংহভাগই বিভিন্ন দেশের বেগম পাড়ার স্থাবর সম্পত্তি ক্রয়ে খরচ করা হয়েছে। কানাডা, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ায় বেগম পাড়ার গল্প আমরা শুনেছি। সম্প্রতি সরকারদলীয় সংসদ সদস্য আবদুস সোবহান গোলাপের যুক্তরাষ্ট্রে বাড়ি থাকার তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।

সরকারি প্রকল্পের জন্য ছয় হাজার টাকায় বালিশ কেনা হয়।বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে বসিয়ে বসিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা দিতে হয়েছে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে। ভবিষ্যতে আরও দিতে হবে। ব্যাংক থেকে টাকা ঋণের নামে হাওয়া হয়ে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে সারা দেশে যে দুর্নীতির পরিস্থিতি বিরাজ করছে সেখানে পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে এনে গণরোষের শিকার হতে কে চাইবেন?

আবদুস সোবহানের মতো আমাদের রাজনীতিবিদ অনেকেরই বিদেশে স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি রয়েছে। তাঁরা এসব সম্পদ বিক্রি করে দেশে অর্থ ফিরিয়ে আনবেন বলে মনে হয় না। দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডায়। আমাদের রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের বিদেশে বিভিন্ন ধরনের সম্পদের তথ্য নানা দিকে শুনতে পাওয়া যায়। কিন্তু এসব অভিযোগের কোনো অকাট্য প্রমাণ নেই। হলফ করে বলা যাবে না অমুক ব্যক্তি তমুক খাতে দেশ থেকে অর্থ পাচার করে বিনিয়োগ করেছেন।

তবে দেশ থেকে অর্থ পাচার হচ্ছে এ কথা সত্য। সম্প্রতি আলোচনায় আসা আরাভ খানের দুবাইয়ে ব্যবসায় বিনিয়োগের উৎস নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। তিনি দুবাইয়ে স্বর্ণ ব্যবসায় বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের অর্থ কোথায় পেলেন। খুনের মামলা মাথায় নিয়ে ভারত হয়ে দুবাই পালিয়ে গেছেন আরাভ খান। খুব অল্প সময়ে তিনি অগাধ বিত্তের অধিকারী হয়েছেন। এমনও হতে পারে এখানে আরাভ খানের কোনো বিনিয়োগ নেই। তিনি অন্যের পাচারের অর্থ পাহারা দিচ্ছেন কেবল। পাচারের জন্য আরাভ খানের মতো পাহারাদার পাওয়া যাবে। কিন্তু ফিরিয়ে আনার জন্য কোনো আরাভ খান স্বেচ্ছায় পাচারকারীর খাতায় নাম লেখাতে রাজি হবেন না।

কয়েক বছর ধরেই দেশ থেকে অর্থ পাচারের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। বিশেষ করে, বর্তমান সরকারের আমলে পাচারের হার ভয়াবহ আকারে বেড়ে গিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটির তথ্য অনুসারে, ২০০৬ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত দেশ থেকে প্রায় ৫ লাখ ২৯ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। বর্তমানে পাচারের পরিমাণ আরও বেশি হতে পারে। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে অর্থ পাচার রোধ করা সম্ভব। মূলত পণ্য আমদানির নাম করে অর্থ পাচার হয়ে যায়। আরও নানা পন্থায় অর্থ পাচার হতে পারে, কিন্তু রোধ না করে বরং পাচারের সুযোগ করে দিয়েছে সরকার।

সরকারও জানত এই অর্থ ফিরে আসবে না। প্রকারান্তরে বিভিন্ন সময় সরকারের মন্ত্রীরা এটা স্বীকারও করেছেন। এটা অনেকটা স্বেচ্ছায় চুরির সুযোগ দেওয়ার পর চোরকে পণ্য ফিরিয়ে দেওয়ার ভদ্রোচিত আহ্বান।

সমালোচনার পথ বন্ধ করার জন্য সরকার পাচারের অর্থ ফিরিয়ে আনার লোক দেখানো উদ্ভট নীতি ঘোষণা করেছিল। যুক্তি হিসেবে অনেক দেশের উদাহরণ সরকারের লোকজন দিতে পারেন। কিন্তু ওই সব দেশের পরিস্থিতি আর আমাদের দেশের পরিস্থিতি এক নয়। আমাদের মতো অর্থনৈতিক সংকট ওদের নেই। লাগামহীন দুর্নীতিতে আমাদের জনজীবন বিপর্যস্ত। পণ্যমূল্য আকাশছোঁয়া। লাফিয়ে লাফিয়ে পণ্যের দাম বাড়ছে। ডলার-সংকটে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লা আমদানি বন্ধ থাকে মাঝেমধ্যেই।

সরকারি প্রকল্পের জন্য ছয় হাজার টাকায় বালিশ কেনা হয়। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে বসিয়ে বসিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা দিতে হয়েছে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে। ভবিষ্যতে আরও দিতে হবে। ব্যাংক থেকে টাকা ঋণের নামে হাওয়া হয়ে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে সারা দেশে যে দুর্নীতির পরিস্থিতি বিরাজ করছে সেখানে পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে এনে গণরোষের শিকার হতে কে চাইবেন?

  • ড. মারুফ মল্লিক লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক