এসআইদের অব্যাহতি, ভেরিফিকেশন ও বাজে সংস্কৃতি

এক যুগ ধরে ক্রমে কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠা শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটল ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে। আন্দোলনটা মূলত শুরু হয়েছিল সরকারি চাকরিতে কোটাকেন্দ্রিক বৈষম্য নিরসনের দাবিতে। চাকরিতে এ দেশের তরুণেরা কোনো ধরনের বৈষম্য চান না। সেটি না চাওয়ার অনড় অবস্থান থেকেই একটি চরম স্বৈরাচার সরকারের পতন ঘটল। কিন্তু এর পরপরই পুলিশ একাডেমিতে প্রশিক্ষণরত একটি এসআই ব্যাচের বিপুলসংখ্যক সদস্যকে অব্যাহতি দিয়ে তাঁদের ক্ষেত্রে বৈষম্যের অভিযোগ উঠল।

যে অভিযোগে এসআইদের অব্যাহতি

পুলিশের ৪০তম ব্যাচের ক্যাডেট হিসেবে অল্প কিছুদিনের মধ্যে চাকরিতে যোগদানের কথা ছিল সারদায় পুলিশ একাডেমিতে প্রশিক্ষণরত আট শতাধিক সাব-ইন্সপেক্টর বা উপপরিদর্শককে (এসআই)। সেখান থেকে আড়াই শতাধিক উপপরিদর্শককে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে বাদ দেওয়া হয়েছে। এরপর অর্ধশতাধিককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে, তা–ও শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে।

একাডেমি কর্তৃপক্ষ থেকে এসআইদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ সম্পর্কে আমরা জানতে পারছি, নাশতা না খেয়ে হইচই করে মাঠের মধ্যে চরম বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি করা, একাডেমি কর্তৃপক্ষকে হেয়প্রতিপন্ন করে চরম বিশৃঙ্খলা ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করা, ক্লাসে শৃঙ্খলার সঙ্গে না বসে এলোমেলোভাবে বসে হইচই করা।

পুলিশের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একাডেমিতে ছোট-বড় নানা ধরনের শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ ঘটে। টানা এক বছর কঠোর আবাসিক অনুশীলনের মধ্যে থাকতে গিয়ে অনেক ধরনের ঘটনা ঘটে, যার মধ্যে আছে মারামারি, হাতাহাতিও। এসব অভিযোগের জন্য নানা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে মূলত। সে অর্থে এসআইদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তেমন গুরুতর না।

তবে ঢাকায় কর্মরত একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার দিলেন ভিন্নমত। তাঁর সঙ্গে কথা হলে তিনি জানালেন, পুলিশের চাকরির ক্ষেত্রে বিসিএসের মাধ্যমে এএসপি এবং বিসিএস ছাড়া সার্জেন্ট পদে নিয়োগপ্রাপ্তরা একাডেমিতে ‘ইন সার্ভিস ট্রেইনিংয়ে’ থাকেন। অর্থাৎ চাকরিতে যোগদানের পর তাঁদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। ফলে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগের ক্ষেত্রে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় সরকারি চাকরিবিধি অনুসারে।

আর কনস্টেবল ও এসআইদের ক্ষেত্রে বিষয়টি ভিন্ন। তাঁদের চাকরিতে যোগদানই হয় প্রশিক্ষণের পর। ফলে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে তাঁদের বিরুদ্ধে সরকারি চাকরির বিধিমালা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ নেই। আর একটি ডিসিপ্লিনড বাহিনীর ক্ষেত্রে যেকোনো শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগই গুরুতর, বাইরে থেকে সেটি যতটাই লঘু মনে হোক না কেন। এ ক্ষেত্রে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে শাস্তি হিসেবে তাঁদের অব্যাহতি দেওয়াটা অযৌক্তিক নয়।

তবে ভুক্তভোগী কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাঁদের দাবি, এখানে আসলে ওই অর্থে শৃঙ্খলাভঙ্গের ঘটনা ঘটেনি। ২০ অক্টোবর বিসিএস পুলিশ কর্মকর্তাদের (এএসপি) ৩০ অক্টোবর নিজেদের পাসিং আউট উপলক্ষে এক মাস আগ থেকে তাঁদের কুচকাওয়াজের অনুশীলন শুরু হয়।

কিন্তু প্রচন্ড গরমে কঠোর অনুশীলনের সময় বিরতিতে মাঠের পাশেই খাবার (ছোলা ও ডিম) পরিবেশন করা হতো। এ খাবারে অনেকের পেটে গোলযোগ দেখা দিচ্ছিল। এ ছাড়া ছোলার বাটিতে চামচ না থাকা, হাত ধোয়ার জন্য পানি না থাকা ইত্যাদি কারণসহ খাবার পরিবেশনা নিয়ে একধরনের অসন্তোষ তৈরি হয় প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্যে।

১ অক্টোবর তাঁরা সবাই মানে অনুশীলনে থাকা ছয় শতাধিক প্রশিক্ষণার্থী (মোট প্রশিক্ষণার্থী আট শতাধিক হলেও কুচকাওয়াজের জন্য নির্বাচিত ছিলেন ছয় শতাধিক) খাবার বর্জন করেন। তাঁদের সঙ্গে একাডেমি কর্তৃপক্ষ কথা বলে এক দিন পর থেকে খাবারের মেনুতে পরিবর্তনও আনে।

তবে ৭ অক্টোবর অনুশীলন চলাকালে আড়াই শতাধিক উপপরিদর্শককে আলাদা করে ফেলা হয় এবং তাঁদের তিন দিনের ভেতরে কারণ দর্শনোর নোটিশ দেওয়া হয়। তাঁরা সেটি যথাসময়ে জমাও দেন। পরে তাঁদের পাঁচ দিনের ছুটিতে বাড়িতে পাঠানো হয়।

ছুটিতে থাকা অবস্থায় তাঁরা জানতে পারেন এবং চিঠি পান যে তাঁদের চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

এখন তাঁদের প্রশ্ন, প্রতিবাদ করলাম সবাই, কিন্তু শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ আনা হলো শুধু আড়াই শতাধিকের বিরুদ্ধে, এটি কেন হলো?

বিএনপির অভিযোগ, রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা এবং অতঃপর...

বিএনপি একটি দাবি তোলার পাঁচ দিন পর সারদায় শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে আড়াই শতাধিক এসআইকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। ১৭ অক্টোবর গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আমরা বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পেরেছি, পতিত ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকার তার ক্ষমতাকে প্রলম্বিত করতে, পুলিশ প্রশাসনে নিরঙ্কুশ আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে বিদায় নেওয়ার পূর্বে পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর পদে মোট ৮০৩ জনকে নিয়োগ প্রদান করেছে। এর মধ্যে ২০০ জনের বাড়ি গোপালগঞ্জ এবং ৪০৩ জনই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনকারীদের হত্যাকারী সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগের সদস্য।’ তিনি এসব পুলিশ কর্মকর্তার নিয়োগ বাতিলের দাবি তোলেন।

ঢাকায় র‍্যাবে কর্মরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তার মতে, কেউ আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন অর্থাৎ ছাত্রলীগের (বর্তমানে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধঘোষিত) সঙ্গে অতীতে যুক্ত ছিলেন, সরাসরি ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও পরিবার বা ঘনিষ্ঠ স্বজনদের কেউ আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন বা সমর্থক ছিলেন, তাঁদেরই আসলে বেছে বেছে বাদ দেওয়া হয়েছে।

তিনি এটাও বললেন, পুলিশ ভেরিফেকিশনের সময় এমন ঘটনাও ঘটে—কারও ক্ষেত্রে হয়তো রাজনৈতিক কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই, কিন্তু ভেরিফিকেশন করতে আসা পুলিশ কর্মকর্তা অল্প কিছু টাকার বিনিময়ে এবং পরে যাতে জবাবদিহি করতে না হয়, তখন নিজে থেকেই প্রার্থীর যাচাই–বাছাইপত্রে লিখে দেন—প্রার্থীর পরিবার আওয়ামী রাজনীতির সমর্থক বা তারা আওয়ামী লীগের ভোটার।

অনেকের ক্ষেত্রে এমনটিও দেখা যায়, নিজেরা হয়তো আওয়ামী লীগের রাজনীতি করে না, কিন্তু এলাকার বা আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত কারও সুপারিশে সেই বাধা পার হয়ে গেছেন।

এককথায় ধারণা করা যায়, এসআই ব্যাচটির যাদের ক্ষেত্রেই নথিপত্রে আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগ সংশ্লিষ্ট কিছু দেখা গেছে, তাদের বাদ দেওয়া হয়েছে।

অব্যাহতি পাওয়া কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা সবাই ছাত্রলীগের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকার বিষয়ে অস্বীকৃতি জানান এবং ছাত্রলীগের কোনো অপরাধমূলক কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না দাবি করেন। জড়িত থাকলেও স্বাভাবিকভাবেই এখন সেটি কেউ স্বীকার করতে চাইবেন না, কারণ অতীতের সব ভয়াবহ কর্মকাণ্ডের কারণে ছাত্রলীগ চরমমাত্রায় বিতর্কিত ও সমালোচিত; যার জেরে এখন নিষিদ্ধ সংগঠন হিসেবেও ঘোষিত হয়েছে।

তবে চট্টগ্রাম শহরের বাসিন্দা একজন ভুক্তভোগী বললেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার শুরুর দিকে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরে রাজনীতি থেকে দূরে সরেও আসেন তিনি। টিউশনি বা কোচিংয়ে ক্লাস নেওয়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন এবং হল ছেড়ে পরিবারের সঙ্গেই থাকতেন। পরে ক্যারিয়ারের দিকে মনোযোগী হন। সারদায় তাঁর ব্যাচে যোগ্যতাগুণে শীর্ষ প্রশিক্ষণার্থীদের একজন ছিলেন তিনি।

চট্টগ্রামের আরেকজন ভুক্তভোগী, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে ক্যাম্পাসে উপজেলাভিত্তিক সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। অব্যাহতি পাওয়া এই প্রশিক্ষণার্থীর সঙ্গে যোগাযোগ হলে বলেন, সংগঠনের দায়িত্ব পালনের সময় নানা দাবিদাওয়া নিয়ে নিজ উপজেলার আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যের কাছে যেতেন। তার সঙ্গে ছবিও আছে তাঁর। আওয়ামী লীগের সঙ্গে শুধু এই সংশ্লিষ্টতার বিষয়টিই জানান তিনি।

তাঁর দাবি, তাঁর মা-বাবা দুজনই সরকারি চাকরি করেন, তাঁরা কোনো দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন। তিনি বলেন, এমপি যদি অন্য দলের বা অন্য সরকারের হতেন, উপজেলাভিত্তিক সংগঠনের প্রয়োজনে তিনি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। চাকরির প্রয়োজনে তাঁর সুপারিশই নিতেন।

আরেকজন ভুক্তভোগী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীর একটি ফেসবুক পোস্ট ভাইরাল হয়, যেখানে দাবি করেছিলেন, তিনি হলে থাকাকালে ছাত্রলীগের কোনো ধরনের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, এ ধরনের প্রমাণও কেউ দেখাতে পারবেন না। যদিও পরে ছাত্রলীগের সঙ্গে তাঁর নানা সংশ্লিষ্টতা প্রকাশ হয়ে পড়লে তিনি তাঁর পোস্ট সরিয়ে নেন।

অনেকের ধারণা, পুলিশে চাকরি করতে আগ্রহ মানেই ঘুষ খাওয়া বা দুর্নীতি করে দ্রুত ওপরে ওঠার ধান্দা। সেটি বেশিরভাগ প্রার্থীর ক্ষেত্রে সত্য নয় বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। কারণ ঘুষ বা অনিয়ম করার সুযোগ আরও অন্যান্য সরকারি চাকরিতেও আছে। পুলিশের চাকরির প্রতি পেশাগত একটি আকর্ষণ তরুণদের মধ্যে সব দেশেই কাজ করে। সেটি ছাড়াও বেকারত্বের জাঁতাকল থেকে মুক্তি পাওয়া ও একটি নিশ্চিত ভবিষ্যতের আশায় সরকারি চাকরির প্রতিই আমাদের তরুণেরা মোটাদাগে নির্ভরশীল। সেই জায়গা থেকেও অনেকে পুলিশের চাকরিতে ঢুকে থাকেন।

রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার একজন ভুক্তভোগীর পরিবার বলছে, তাদের সন্তান কোনো ধরনের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। দরিদ্র পরিবার হওয়ায় ঘুষ দেওয়ার সামর্থ্যও তাদের নেই। সন্তান পুলিশে যোগ দিলে তাঁরা এই দারিদ্র্যের কশাঘাত থেকে মুক্তি পাবেন, সেই আশায় বুক বেঁধেছিলেন। সন্তান টিউশনি করে বা কোচিংয়ে ক্লাস করিয়ে খেয়ে না–খেয়ে এত দূর এসেছেন। রাজনীতি করার সুযোগ কখন পাবেন।

আরও ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলে এমন আরও প্রশিক্ষণার্থীর সম্পর্কে জানা গেল। দারিদ্র্যের কশাঘাত সয়ে অনেক সংগ্রাম করে নিজ যোগ্যতায় এত দূর এসেছিলেন তাঁরা। প্রশিক্ষণ ফি হিসেবে প্রতি মাসে মাত্র ১৮২০ টাকা দেওয়া হতো তাঁদের। সচ্ছল পরিবারের অন্য সহকর্মীদের মতো বাড়ি থেকে বাড়তি খরচের টাকাও আনতে পারতেন না।

নিয়োগ–বাণিজ্য ও চরম দলীয়করণের সংস্কৃতি

এটি অস্বীকারের উপায় নেই যে আওয়ামী লীগ সরকার ক্রমে কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠার বড় ভরসা ছিল পুলিশ বাহিনী। পুলিশ বাহিনীর ওপর ভর করে কীভাবে একের পর এক বিতর্কিত নির্বাচন করে সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকল তা–ও আমরা দেখেছি। সর্বশেষ জুলাই অভ্যুত্থানে দেখেছি, পুলিশ কীভাবে ছাত্র–জনতার ওপরে নির্বিচার গুলি চালিয়েছে।

এ বাহিনীকে কীভাবে চরমপর্যায়ে দলীয়করণ করা হয় তার নানা অভিযোগ আমরা বিগত বছরগুলোয় দেখতে পাই। ২০১৩ সালে প্রথম আলোতেই প্রতিবেদন হয়েছিল—ঠিকানা জালিয়াতি করে এক হাজার পুলিশ কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। জেলাভিত্তিক কোটা শেষ করে অন্য জেলার কোটাও খেয়ে দেওয়া হয়েছে ঠিকানা জালিয়াতি করে। এমনও দেখা গেছে, ঢাকা জেলায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ২৫৮ জন, তাঁদের ২০০ জনেরই বাড়ি আবার গোপালগঞ্জ জেলায়। প্রার্থীদের একেকজনের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে তিন-পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ।

এ ধরনের বহু অভিযোগ আছে পুলিশে নিয়োগের ক্ষেত্রে। সম্প্রতি পুলিশ সদর দপ্তরে গোপন প্রতিবেদন সূত্রে পত্রিকান্তরে জানা যাচ্ছে, বিগত সরকারের সময় পুলিশের এসআই ও সার্জেন্ট পদে নিয়োগের মাধ্যমে শতকোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। একেকজন চাকরিপ্রার্থীর কাছ থেকে ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের নেতৃত্বাধীন একটি সিন্ডিকেট এই বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেয়।

এমনকি সরকার পতনের পর এমন নথিপত্রও দেখা গেছে, যেখানে সরকারদলীয় সংসদ সদস্য চাকরির জন্য সুপারিশ করছেন, যাকে বলা হয় ডিও লেটার।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন একজন ভুক্তভোগী জানালেন, তাঁর উপজেলা বিএনপি-জামায়াত–অধ্যুষিত বলে পরিচিত। ফলে চাকরির নিশ্চয়তার জন্য ভেরিফিকেশনের সময় তাঁর ছাত্রলীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ জরুরি হয়ে পড়েছিল। তিনি তখন তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রলীগ নেতাকে দিয়ে বিষয়টি নিশ্চিত করেছিলেন।

ভেরিফিকেশন: একটি ঔপনিবেশিক চর্চা

নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয় বিবেচনার বিষয়টি বরাবরই সমালোচনার বিষয় ছিল হাসিনা সরকারের আমলে। ক্ষমতাসীন রাজনীতির সঙ্গে কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতা না থাকলে কারও চাকরি পাওয়া সহজ ছিল না। যোগ্যতা ও মেধার ভিত্তিতে উত্তীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও অসংখ্য প্রার্থীর চাকরি হয়নি, এরকম ভুরি ভুরি উদাহরণ আছে। শেষ মুহুর্তে ভেরিফিকেশনের জালে তাঁদের আটকে দেয়া হয়েছে। আমরা এই ভয়াবহ বৈষম্য ও অধিকারহীনতার বিরুদ্ধেই সরব ছিলাম।

সরকারি চাকরিতে সুপারিশপ্রাপ্তদের ক্ষেত্রে ভেরিফিকেশনে পরিবারের কেউ বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা এমনকি কোনো আত্মীয়স্বজন থাকলেও তাঁদের আর চাকরি হয়নি। এমন অভিযোগের বিষয়ে বিগত সরকার আমলের সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খানের সঙ্গে ছাত্রজনতার আন্দোলন চলাকালে আলাপ হয়।

তখন এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘বিষয়টি খুব বিব্রতকর এবং সংবিধানবিরোধী। ভেরিফেকিশন বিষয়টি একটি কলোনিয়াল ব্যবস্থা, যেটিকে আমরা এখনো বজায় রেখেছি। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনকারীরা যাতে গণকর্মচারী হয়ে না যায়, এ জন্য সেটি চালু করা হয়েছিল। পাকিস্তান আমলেও কমিউনিস্ট পার্টি করেছে, এমন কেউ চাকরি পাননি। রক্ত দিয়ে আমরা স্বাধীন হলেও সেই কলোনিয়াল মানসিকতা থেকে তো আমরা স্বাধীন হইনি। এখন এটি করার ফলে দলীয়করণ তৈরি হয়। এটি প্রশাসনের মেধাভিত্তিক ও গুণগত মানের হানি হয়। একজন যুদ্ধাপরাধীর পরবর্তী প্রজন্মও তো রাষ্ট্রের নাগরিক, তার তো অধিকার আছে চাকরি পাওয়ার। পূর্ববর্তী প্রজন্মের কর্মকাণ্ডের দায় তো তার হতে পারে না।’

চাকরির ক্ষেত্রে এমন অনিয়ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন গড়ে ওঠার পেছনে নিশ্চয়ই ক্ষোভ হিসেবে কাজ করছিল। পুলিশকে দলীয় বাহিনী বানানোর পেছনে আওয়ামী লীগ সরকারের অপচেষ্টার শেষ ছিল না। কিন্তু তার ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে, তা নিশ্চয়ই আমরা চাই না।

এখন কারও নিয়োগে যদি অনিয়ম হয়ে থাকে, কারও ব্যাপারে যদি বিগত সরকারের দলীয় কারও সুপারিশ থেকে থাকে, কেউ যদি রাজনীতির কারণে অপরাধসংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ডে যুক্ত থেকে থাকেন, কেউ যদি নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠনের সদস্য হয়ে থাকেন—তাঁদের ব্যাপারে অনুসন্ধান বা তদন্ত করে ব্যবস্থা নিলে নিশ্চয়ই কারও আপত্তি থাকার কথা না। জনগণের এমনকি ভুক্তভোগীদের সে ব্যাপারে সুস্পষ্টভাবে জানার অধিকারও আছে। এতে বরং লুকোছাপারও কিছু থাকল না, সরকারের সিদ্ধান্ত নিয়েও সমালোচনা বা বিতর্ক থাকল না।

কিন্তু এসআইদের বাদ দেওয়ার ব্যাপারে তেমন কিছুই আমরা দেখছি না। কারণ, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা থেকে শুরু করে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষই বলছেন—শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগই একমাত্র কারণ। সেখানে রাজনৈতিক কোনো বিষয় নেই।

তরুণ উপদেষ্টার বক্তব্য ও ভুক্তভোগীর দাবি

২৪ অক্টোবর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে বলেন, ‘নিষিদ্ধ সংগঠনের কোনো সদস্য প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত হতে পারবেন না। যেসব নিয়োগ এখনো প্রক্রিয়াধীন আছে, সেখান থেকেও তাদের বাদ দেওয়া হবে। পরবর্তী সার্কুলারে শূন্য পদগুলোতে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হবে।’

আসিফ মাহমুদের কথায় এটি স্পষ্ট যে তিনি নিষিদ্ধ সংগঠন বলতে ছাত্রলীগের কথাও বুঝিয়েছেন।

অব্যাহতি পাওয়া এসআইরা মনে করেন, এটিই যদি সরকারের সিদ্ধান্ত হয় তাহলে বিষয়টি খোলাখুলিভাবেই প্রকাশ করা উচিত, তাঁদের আসলে কী কারণে অব্যহতি দেওয়া হয়েছে।

ক্যাম্পাসে উপজেলাভিত্তিক সংগঠন করা ওই তরুণ বলেন, ‘আমার এখনো সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়স আছে। আমি অবশ্যই একটি সরকারি চাকরি চাই। কষ্ট করে প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষায় টেকার পর আবারও আমাকে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা দেখিয়ে বাদ দেওয়া হবে না, তার নিশ্চয়তা কী? এ জন্য সত্যিকার অর্থে কী জন্য আমাকে বাদ দেওয়া হয়েছে, তার কারণ আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দিলে ভালো হয়। তাহলে জীবন নিয়ে নতুন করে ভাবতে পারব।’

সংস্কার শুরু হোক এখান থেকেই

ঢাকায় কর্মরত একজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা বলছেন, আড়াই শতাধিক এসআইকে যেভাবে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, এটি আসলে ‘ব্যাড কালচার অব বাংলাদেশ’। প্রতিটি নতুন সরকার এলেই এমন ঘটনা ঘটে। আগের আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সব সরকারের আমলেই এটি ঘটেছে। এখন এ সরকারের সময়ও দেখা গেল।

তাঁর প্রশ্ন, এটি শুধু পুলিশকে নিয়েই কেন বেশি হয়? তাঁর মতে, কোনো সরকারই আসলে চায় না পুলিশ ভালো থাকুক বা প্রকৃত অর্থে জনবান্ধব হোক। পুলিশ বাহিনীকে থাকতে হবে সরকারের আজ্ঞাবহ। কারণ পুলিশই হচ্ছে সরকারের ক্ষমতাচর্চার বড় হাতিয়ার।

আবার আমরা এও জানি, পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। অবৈধভাবে ক্ষমতাপ্রয়োগ, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, গ্রেপ্তার বাণিজ্য, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড—বলে শেষ করা যাবে না। সেসবের যথাযথ বিচার হয় না। বিচার প্রক্রিয়াই এমন তাতে আসলে কোনো দৃষ্টান্ত তৈরি হওয়ার সুযোগ নেই বললে চলে।

তবে পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার বন্ধ করা না গেলে এ বাহিনীর কোনো উত্তরণ ঘটবে না, সেটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। সে ক্ষেত্রে মনোযোগ দিতে হবে নিয়োগ প্রক্রিয়ায়।

পুলিশ সংস্কারের জন্য একটি কমিশন গঠন করা হয়েছে আমরা জানি। আশা করি তাদের কার্যক্রমে এ বিষয়গুলো প্রাধান্য পাবে। সেখানে এসআইদের অব্যাহতি দেয়ার এ ঘটনাকে কেস স্টাডি হিসেবে নেয়া যেতে পারে। রাজনৈতিকভাবে সুবিধাভোগী ছাড়াও এখানে অনেকে ভুক্তভোগী আছেন যারা আসলে ‘সিস্টেমের ভিক্টিম’। আমাদের তরুণেরা পুলিশের নিয়োগের ক্ষেত্রে কীভাবে এ বেড়াজাল থেকে মুক্তি পেতে পারে, একটি স্বচ্ছ, বিশ্বাসযোগ্য ও নির্ভরযোগ্য প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে পারে সেটি নিশ্চিত করাই হবে প্রকৃত একটি সংস্কার।

  • রাফসান গালিব প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী। ই–মেইল: rafsangalib1990@gmail.com