পরিবারপূজাই যদি হয় রাজনীতি, ‘বিরাজনীতিকরণে’ সমস্যা কী

অন্তর্বর্তী সরকারের বয়স দুই মাস পেরিয়েছে। এর মধ্যে শব্দযুদ্ধ চলছে বেশ। লক্ষ্য, প্রধান উপদেষ্টা ও তাঁর কয়েকজন সহকর্মী। তাঁরা কে কখন কী বললেন, তা নিয়ে হামলে পড়েন অনেকেই। আবার তাঁরাও প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে কথা বলছেন বেশি। এত কথার কী দরকার? মানুষ কথার কারবারিদের অনেক দেখেছেন। এখন দেখতে চান কাজ।

এই সরকারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আসলে কারা? একদিক থেকে বলে যায়, ক্ষমতাপ্রত্যাশী সব রাজনৈতিক দলই এই সরকারের প্রতিপক্ষ। কারণ, যত দিন এই সরকার আছে, তত দিন কোনো ‘রাজনৈতিক সরকার’ হবে না। থাকতে হবে অপেক্ষায়। সবার সেই ধৈর্য নেই।

আরেক দিক থেকে বলা যায়, এই সরকারের প্রধান প্রতিপক্ষ হলো আওয়ামী লীগ, যে দলের সরকার দুই মাস আগে ক্ষমতা হারিয়েছে। ক্ষমতাচ্যুত দলের ও সরকারের প্রধান দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। এটা কি প্রাণভয়ে চম্পট দেওয়া, নাকি সমঝোতার মাধ্যমে ‘সেফ এক্সিট’, বিষয়টি এখনো পুরোপুরি খোলাসা নয়। তবে দুটি উপাদানেরই মিশেল আছে। এটা বুঝতে ও জানতে আরও সময় লাগবে।

ক্ষমতা হারিয়ে দলের নেতা-কর্মীরা দিশাহারা। তাঁরা প্রকাশ্য হচ্ছেন না। অনেকেই ফেসবুকে আশ্রয় নিয়েছেন, ইচ্ছেমতো বয়ান দিচ্ছেন। তাঁদের পোস্ট পড়লে মনে হয়, এই বুঝি মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার পড়ে গেল। চায়ের আড্ডায় কিংবা খোশগল্পে যখন-তখন সরকার ফেলে দেওয়া যায়। বছরের পর এমনটা চলে আসছে এ দেশে। এটি অনেকের ধ্যানজ্ঞান, অনেকের কাছে বিনোদন।

ফেসবুকে ‘পরাজিত শক্তি’ খুবই তৎপর। আমি ভাবছি একটা কথা, আওয়ামী লীগ তো অনেক পুরোনো ও পোড় খাওয়া দল। দলের নেতারা সব সময় দাবি করতেন, এটি দেশের সবচেয়ে বড় ও জনপ্রিয় দল। প্রতিটি গ্রামেই এই দলের সমর্থক আছেন।

আগস্টের ৫ তারিখ যখন হাজারো মানুষ মিছিল করে আসছিলেন, তখন আওয়ামী লীগের লাখো নেতা-কর্মী কী করছিলেন? তাঁরা কেন গণভবনের আশপাশে গিয়ে তাঁদের প্রিয় নেত্রীকে সাহস ও শক্তি জোগাতে ছুটে গেলেন না? এখন সব হারিয়ে শুধু ফেসবুকে ভর করলে কি হবে?

ঠিক এমনটাই হয়েছিল ১৯৭৫ সালের আগস্টে। তখন স্লোগান ছিল—এক নেতা এক দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ। নেতা নেই, তাঁর লোকেরা মুহূর্তে কোটরে ঢুকে গিয়েছিলেন।

২০২৪ সালে একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি হলো। অনুগত অনুসারীরা বুলন্দ আওয়াজ তুললেন—নেত্রী তোমার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই। নেত্রী দলের সবাইকে এতিম করে গোপনে দেশ ছাড়লেন। তাঁর দলকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

এখন প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী লীগের মুখপাত্র হলেন পলাতক সভাপতির প্রবাসী পুত্র। ঘুরেফিরে সেই ‘পরিবার’। শুনেছি তিনি আরেকটি দেশের নাগরিক। দেশের মধ্যে দলটির প্রতিনিধিত্ব করার একজনও কি নেই? এ কেমন দল যে নেতা পরিবারের বাইরে অন্য কাউকে বিশ্বাস করেন না, আস্থায় নেন না?

শেখ হাসিনার দল অনেক দিন ধরেই নেই। দল বলতে আওয়ামী লীগ। তিনি নির্ভর করতেন আমলা, পুলিশ আর গোয়েন্দা সংস্থার ওপর। পুষতেন হেলমেটধারী লাঠিয়াল বাহিনী। চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিলেন সুবিধাভোগী আত্মীয়স্বজন আর মোসাহেব। তাঁরা রোবটের মতো শিখিয়ে দেওয়া কথা বলতেন। দলটাকে তিনি মেরে ফেলেছিলেন অনেক আগেই। তবে তাঁর একটা বড় সমর্থক গোষ্ঠী আছে। নানান পদ, পদক, ভাতা, ব্যবসা দিয়ে তিনি একটা অনুগত গোষ্ঠী তৈরি করেছিলেন। এরা এখন দেশের ভেতরে ও বাইরে থেকে ফেসবুকে নড়াচড়া করছে।

মানুষের ওপর হাসিনার আস্থা ছিল না। তাই নির্বাচনের নামে তামাশা করে তিনি একের পর এক মেয়াদ পার করেছেন। ভেবেছিলেন, এভাবেই যায় যদি দিন যাক না। কিন্তু সবকিছুরই একটা শেষ আছে। যখন ঘটনা একটা ঘটেই গেল, তখন অনুগত গোষ্ঠীর চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেল। তারা ফেসবুকে সরব হলো। বলল, এটা স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন ছিল না, তলেতলে অনেক দিন ধরেই পরিকল্পনা ছিল। আবিষ্কার হলো ষড়যন্ত্রতত্ত্বের, পেছনে আমেরিকা কলকাঠি নেড়েছে।

তো পরিকল্পনা ছাড়া কি আন্দোলন হয়? বিজয়ী ব্যক্তিরা বলেন পরিকল্পনা, পরাজিত ব্যক্তিরা বলেন ষড়যন্ত্র। পরাজিতদেরও একটা পরিকল্পনা ছিল। সেটা হলো পুলিশ, গোয়েন্দা আর ভাঁড় দিয়ে আজীবন রাজত্ব করে যাওয়া। সেই পরিকল্পনা মার খেয়েছে তরুণদের পরিকল্পনার কাছে। তরুণদের পরিকল্পনার মূলে ছিল একটি বিষয়—যতই গুলি করো, মারো, পিছু হটব না। অর্থ, বিত্ত, পদ, পদক পাওয়া অনুগত গোষ্ঠীর ওই মনোবল ছিল না। কারণ, তারা তো নানান ধান্দায় জুটেছিল।

এ দেশে সব স্তরের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে শামিল হয়েছিলেন। বলা হয়ে থাকে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। আমি দেখেছি, জেনেছি, প্রধান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তার শতভাগ নিশ্চয়তা পেয়ে গ্রেপ্তার বরণ করেছিলেন। আওয়ামী লীগের নেতারা কলকাতায় কামড়াকামড়ি করেছেন ওই সময়টিতে। এমপি সাহেবদের মুজিবনগর সরকার মাসিক ভাতা দিত। তাঁদের নীতিনৈতিকতাহীন জীবনযাপনের নানান খবর চাউর হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে তাঁরা একঘরে করে রেখেছিলেন। যুদ্ধের ঝাপটা গেছে অবরুদ্ধ দেশের কোটি কোটি মানুষের ওপর দিয়ে। সশস্ত্র প্রতিরোধে যোগ দিয়েছিলেন প্রধানত পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বাঙালি সদস্য এবং গ্রামের তরুণেরা। যদিও মুক্তিযুদ্ধের ফসল ছিনতাই করে নিয়েছিল একটি দল, একটি পরিবার। মুক্তিযুদ্ধের চাপিয়ে দেওয়া বয়ান বেশি দিন আর টেকানো যাবে না।

আমরা অতীতে ফিরে যেতে চাই না। তার মানে অতীত মুছে ফেলা নয়। এটা মুছে ফেলা যায় না। কোনো দলের বয়ান শুরু ’৭১ থেকে, কারও বয়ান শুরু ’৭৫ থেকে। অথচ বাঙালির জীবনযাপন ও লড়াইয়ের ইতিহাস তো অনেক পুরোনো। অতীতের জাবর কেটে তো জীবন চলবে না। আমাদের তাকাতে হবে সামনের দিকে।

এ প্রসঙ্গে কাজী নজরুল ইসলামের ‘চিরঞ্জীব জগলুল’ কবিতার দুটি লাইন উদ্ধৃত করার লোভ সামলাতে পারছি না:

কবে আমাদের কোন সে পুরুষে ঘৃত খেয়েছিল কেহ/

আমাদের হাতে তারি বাস পাই, আজো করি অবলেহ!

আমরা শব্দ নিয়ে মারামারি করি বেশি। মাস্টারমাইন্ড, রিসেট বাটন, দ্বিতীয় স্বাধীনতা ইত্যাদি। ইংরেজিতে বলে ‘ফ্রেইজ-মংগারিং’। আমাদের শব্দযুদ্ধ থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। আমরা দেখতে চাই কাজ। আসলে আমরা কী চাই? যে গণতন্ত্রের জন্য, বৈষম্যের অবসানের জন্য আমরা স্বাধীনতা চেয়েছিলাম, তা থেকে গেছে অধরা। পরপর তিনটি প্রজন্ম ভোটবঞ্চিত ছিল। এ দেশের শতকরা ৮০ ভাগ লোকের বয়স ৫০-এর নিচে, তাঁরা ’৭১ দেখেননি। তাঁরা বড় হয়েছেন, বেড়ে উঠেছেন কর্তৃত্ববাদী একটা অনুদার, নৃশংস রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে। এটি পাল্টাতে হবে। এখন সময় জেগে ওঠার, ঘুরে দাঁড়ানোর।

এটাও অস্বীকার করার উপায় নেই, এ দেশে পরস্পরবিরোধী দুটি স্রোতোধারা আছে। এটার শিকড় অনেক গভীরে। ’৭১-এও এমনটা ছিল। তখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণে আমরা ছিলাম দিশাহারা। অনেক দ্বন্দ্বই তখন চাপা পড়েছিল, দ্বন্দ্বের মীমাংসা হয়নি। ’৭২-এর সংবিধানেই একনায়ক তৈরির সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল। সেই সংবিধান আমরা মলম দিয়ে দিয়ে এখনো টেনে বেড়াচ্ছি।

আরেকটা কথা মাঝেমধ্যেই চাউর হয়, দেশে নাকি বিরাজনীতিকরণের প্রক্রিয়া চলছে। রাজনৈতিক দলগুলো মনে করে, তারাই দেশের মালিক। তারাই কেবল ক্ষমতার চর্চা করবে। তাদের মতে, রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় নেই মানে রাজনীতি নেই। অথচ রাজনৈতিক সচেতনতা আর দলবাজি তো এক জিনিস নয়। দেশটা তো ১৭ কোটি মানুষের। সবাই স্বপ্ন দেখে। সবাই দল করে না।

আমার বুঝে আসে না, একজন লেখাপড়া জানা মানুষ কী করে একটি পরিবারের পূজা করতে পারেন। অথচ রাজনীতির নামে আমরা এত দিন কী দেখেছি? এ দেশে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর চলেছে ব্যক্তিপূজা, পরিবারপূজা, নেতার কবরপূজা। এটাকে যদি রাজনীতি বলি, তাহলে ‘বিরাজনীতিকরণে’ তো কোনো সমস্যা দেখি না। আমি চাই বিরাজমান রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় পরিবর্তন আসুক। আমার চাওয়াটা আমি প্রকাশ করলাম। আমরা সবাই যদি পরিবর্তন চাই, তাহলেই রাজনীতিটা বদলাবে, দেশ বদলে যাবে।

  • মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক