মানুষের বিশ্বাস অতি বিচিত্র। ক্ষুদ্র বরইপাতা থেকে শুরু করে অতিকায় বটগাছ নিয়ে মানুষের হরেক পদের বিশ্বাস আছে। পাখি নিয়েও আছে নানা ধারণা, সংস্কার ও বিশ্বাস। আর পাখির মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি মিথ, সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস, সবচেয়ে বেশি সংস্কার, সবচেয়ে বেশি কুসংস্কার চালু আছে ঘুঘু নিয়ে।
ধর্মীয় সম্প্রদায়, অঞ্চল ও সংস্কৃতিভেদে ঘুঘু নিয়ে সংস্কার-কুসংস্কারে পার্থক্য আছে বিস্তর। এই পাখিটি নিয়ে যেহেতু মানুষের আগ্রহ বেশি, সেহেতু শিকারির নিশানায় তারা পড়ে বেশি।
‘ঘুঘু’ আর ‘ঘাঘু’—এ দুটো শব্দ যেন মাসতুতো ভাই। তাই বোধ হয় ঘুঘু দিয়ে ঘুঘু ধরা ঘাঘু লোকের পক্ষেও সোজা ব্যাপার হয়ে ওঠে না। পেছনে ভয়ঙ্কর ফাঁদ পাতা আছে কিনা, তা না দেখেই ‘বুকে আয় ভাই’ বলে পোষা ঘুঘুর সঙ্গে খাতির জমাতে গিয়ে আটকা পড়ে বুনো ঘুঘু। ফাঁদ–সংক্রান্ত বিপদের ব্যাপারে আইডিয়া না থাকা সেই বুনো ঘুঘুর মরণ–দশা যে প্রবাদের জন্ম দিয়েছে, তা হলো: ‘বাছাধন, ঘুঘু দেখেছ, ফাঁদ দেখনি।’
তো, সেই রকমের এক ঘুঘু শিকারে গল্প বলব আজ। পাখি শিকার কত নির্মম হতে পারে, তা অনেক সময় আমাদের কল্পনাকেও হার মানায়। কিন্তু তার আগে বলা যাক আরও কিছু ঘুঘুকাহিনি।
ইবনে সিরিন নামে বসরায় এক জ্ঞানী ব্যক্তি ছিলেন। বর্তমানে ইরাকের অন্তর্ভুক্ত বসরার এই ব্যক্তি ছিলেন বেশ বিখ্যাত ও জনপ্রিয় স্বপ্নবেত্তা, মানে স্বপ্নের ব্যাখ্যাকারী। ৬৫৪ খ্রিষ্টাব্দে জন্ম নেওয়া ইবনে সিরিনের স্বপ্নের ব্যাখ্যাগুলো আজও চর্চিত হয়ে থাকে।
স্বপ্নে ঘুঘু দেখা নিয়ে ইবনে সিরিনের বিস্তর ব্যাখ্যা আছে। যেমন তিনি বলেন, যদি কোনো ব্যক্তি নিজেকে ঘুঘুর সঙ্গে খেলতে বা স্বপ্নে এই পাখি বহন করতে দেখেন, তাহলে এর অর্থ হতে পারে এমন—তার জীবনে এমন কিছু লোক রয়েছে, যারা তাকে সান্ত্বনা ও প্রশান্তি দেয়। যদি কোনো ব্যক্তি ঘুঘু পাখিকে তার হাতে বা মাথায় অবতরণ করতে দেখেন, তাহলে এর অর্থ হতে পারে—ওই ব্যক্তি সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে আশীর্বাদপ্রাপ্ত বা তার জীবনে একটি ভালো সুযোগ আসবে।
বাড়িতে ঘুঘু পাখি দেখার স্বপ্নেরও অনেক ব্যাখ্যা দিয়েছেন ইবনে সিরিন। যেমন ঘুঘু গার্হস্থ্য জীবনের ও মনের শান্তির প্রতীক। ঘুঘু পাখি এমনকি ঘুঘুর ডিম স্বপ্নে নানাভাবে দেখা নিয়ে নানা স্বপ্নের বিস্তর ব্যাখ্যা দিয়ে গেছেন সিরিন।
অনলাইন ঘেঁটে সেগুলো সহজেই পাওয়া যায়। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, ইবনে সিরিন আসলেই স্বপ্নবেত্তা ছিলেন কি না, বা তাঁর নামে প্রচলিত স্বপ্নের ব্যাখ্যাগুলো আসলে তাঁরই কি না, তা নিয়েও আছে নানা সংশয়। যাক, সে অন্য আলোচনা।
আবার বাংলা অঞ্চলে ঘুঘু নিয়ে যে ধারণা, তার বেশির ভাগই ইবনে সিরিনের চিন্তার বিপরীত। বাংলায় একটি প্রবাদ আছে, ভিটেয় ঘুঘু চড়ানো। এর মানে হচ্ছে, ভিটেশূন্য করা বা নির্বংশ করে দেওয়া। একপ্রকার অভিশাপই বলা যায়। ঘাঘুর কথা তো শুরুতেই বললাম, অনেকের ‘ঘুঘুনাথ’ শব্দটাও শোনার কথা। এর অর্থ হচ্ছে, খুবই ধুরন্ধর লোক, সুযোগসন্ধানী বা লোভী মানুষ। ঘুঘু পাখি কিছুটা নির্জনতা পছন্দ করে বলে সেখান থেকে এসেছে ‘ঘুঘুটে’ শব্দ। সেখান থেকেই কি ‘ঘুটঘুটে’ আসল? আর কে না জানে, ঘুঘুটে বা ঘুটঘুটে রাত মানে বিপদ–আপদের আশঙ্কা।
আবার এ অঞ্চলে এমনও বিশ্বাস দেখা যায় যে ঘরে ঘুঘু পাখি বাসা বাঁধা অমঙ্গলজনক। তবে হিন্দু ধর্মে বলা হয়ে থাকে যে ঘুঘু পাখি হচ্ছে দেবী লক্ষ্মীর ভক্ত। ফলে বাড়িতে ঘুঘু আসার অর্থ হচ্ছে সৌভাগ্যের দেখা মেলা। এখানে এসে ইবনে সিরিনের ব্যাখ্যার সঙ্গে আমরা মিল খুঁজে পাই। তার মানে নেতিবাচক ধারণা এড়িয়ে মোটা দাগে বলা যায় যে ঘুঘু পাখি হচ্ছে সুখ, শান্তি ও সৌভাগ্যের প্রতীক। ‘রূপসী বাংলা’য় জীবনানন্দ কি এ কারণেই বলেছিলেন—এখানে ঘুঘুর ডাকে...শান্তি আসে মানুষের মনে।
কিন্তু এই ঘুঘু পাখিকে যেভাবে শিকার করা হয়, তা খুবই নির্মম ও নিষ্ঠুর। যে ঘুঘু মানুষের জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনে, সেই মানুষের হাতে তার কেন এমন পরিণতি হবে! পাখি শুধু মানুষের নয়, প্রকৃতিরও সৌভাগ্যের প্রতীক, সেটি সব পাখির বেলায়ই সত্য। তবে অনেক সময় নির্দিষ্ট কোনো কিছু যেমন ট্যাবু হয়ে ওঠে, ঘুঘু পাখিকে ঘিরেও আদিকাল থেকে নানা সংস্কৃতিতে ইতিবাচক–নেতিবাচক ধারণার উৎপত্তি বা প্রচলনও তেমনই।
৩ এপ্রিল ঘুঘু শিকার নিয়ে প্রথম আলোর এক সচিত্র প্রতিবেদন বেশ আলোড়ন তৈরি করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সবার একটাই বক্তব্য, মানুষ এতটা নিষ্ঠুর হতে পারে!
প্রতিবেদনটিতে আমরা দেখি, কীভাবে ঘুঘু পাখিকে অন্ধ করে দিয়ে শিকারি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে তার স্বজাতিকে ধরার জন্য। সেই ঘুঘু পাখির ছবিটির দিকে তাকানো যায় না। চিকন সুতা দিয়ে সেলাই করে দেওয়া হয়েছে ঘুঘুর ছোট্ট দুটি চোখ। শুধু তা–ই নয়, তার ওপর আঠা দিয়ে আটকে দেওয়া হয়েছে। এভাবে ঘুঘু পাখিকে দৃষ্টিহীন করা হয়। এরপর ওই ঘুঘুকে বেঁধে জাল পেতে আরও পাখি শিকার করছিলেন একদল শিকারি।
ঘুঘুই যদি না থাকত, পৃথিবীর এ সৌন্দর্য কি এভাবে ধরা দিত জীবনানন্দের কবিতায়? ঘুঘু ছাড়া কি আদৌ একটি রূপসী বাংলা আমরা কল্পনা করা যায়? যেভাবে ঘুঘু শিকার করা হচ্ছে—নিষ্ঠুর, নির্মম ও চরম অমানবিকতায়, তাতে সৌভাগ্য ও শান্তির পাখিটির অস্তিত্ব হয়তো ইবনে সিরিনের স্বপ্নব্যাখ্যা, বাংলার কিছু প্রচলিত প্রবাদবাক্য আর জীবনানন্দের কবিতা ছাড়া আর কোথাও মিলবে না। এমন দুর্ভাগা দিনই কি অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য?
এ ঘটনা সুন্দরবনসংলগ্ন বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার সাউথখালী ইউনিয়নের বকুলতলা গ্রামের। স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবীরা সেখানে গিয়ে দুই অন্ধ শিকারি ঘুঘুকে উদ্ধার করেন। আর শিকারিরা পালিয়ে যান। পাখি দুটির চোখের আঠা তুলে ও সুতার সেলাই কেটে প্রকৃতিতে অবমুক্ত করে দেওয়া হয়।
২০২১ সালে সরকার এয়ারগানের ব্যবহার ও বহন নিষিদ্ধ করায় পরিবেশবিদ ও বিশেষজ্ঞরা আশাবাদী হয়েছিলেন, এবার বোধহয় যত্রযত্র পাখি শিকার বন্ধ হবে।
তবে নদী গবেষক তুহিন ওয়াদুদ তিস্তা নদী এলাকায় পাখি শিকার নিয়ে একটি লেখায় বলেন, বন্দুকের সব যন্ত্রাংশ আলাদা করে নৌকায় এমনভাবে নেওয়া হয়, যাতে কেউ বুঝতে না পারে যে ভেতরে বন্দুক আছে। আবার বন্দুক এমন পদ্ধতিতে চালানো হয়, যাতে বেশি দূরে সেই শব্দ না যায়। এক দিনে শত শত পাখি একেক শিকারি দল মেরে নিয়ে যায়।
এয়ারগান নিষিদ্ধ করার কারণে শিকারিরা বরং আরও অনেক উপায় বেছে নিয়েছেন। যেমন, বাঁশ বা লম্বা লাঠির মাথায় বেঁধে পাখি দিয়ে পাখি ধরা হয়। শীতের শুরু থেকেই সাউন্ড বক্সে পাখির ডাক বাজিয়ে পাখির ফাঁদ পেতে পাখি ধরা হয়। আর বিষ দিয়ে পাখি হত্যার ঘটনা তো আছেই।
ঘুঘুর ফাঁদে ঘুঘু শিকারের আরেকটা পদ্ধতিও জানা যায়। ঘুঘুর দুই পাখার বড় দুটি পালক ফেলে দেওয়া হয়। এতে করে ঘুঘুটি আর উড়তে পারে না। এরপর দীর্ঘদিন একধরনের শিস বাজানো হয় ঘুঘুর সামনে। শিস শুনে শুনে ঘুঘুটি নিজেই ডাকাডাকি শুরু করে। তার ডাকে অন্য ঘুঘুও চলে আসে খাঁচার ভেতর। এ খাঁচাও অনেকটা ঘুঘুর বাসার মতো করে তৈরি করা হয়। খাঁচায় বসিয়ে রাখা হয় ডানাকাটা শিকারি ঘুঘুকে। সেই খাঁচায়ই ধরা দেয় আরও ঘুঘু।
দেশের আইনে পাখি নিধন সম্পূর্ণ অপরাধ। এর দায়ে আছে জেল–জরিমানা উভয় দণ্ড। একই অপরাধ আবার করলে শাস্তি ও জরিমানা দ্বিগুণের বিধানও রয়েছে। আইনের অধীনে অনেক শিকারি ব্যক্তিকে শাস্তিও দেওয়া হয়। কিন্তু পাখি শিকার বন্ধ হয় না আর আমাদের পরিবেশ থেকে দিন দিন পাখির সংখ্যা কমতে থাকে।
মাংস খাওয়ার জন্য ঘুঘু শিকারের প্রবণতা বেশি। শরীরের শক্তিবৃদ্ধিতে বা দুর্বল পুরুষের সবল হতে ঘুঘুর মাংস খাওয়ার অদ্ভুত এক ধারণা প্রচলিত আছে এ অঞ্চলের কিছু মানুষের মধ্যে। যার কারণে পরিযায়ী পাখির বাইরে মাংস খাওয়ার জন্য ঘুঘু পাখিকেই বেশি শিকার হতে দেখি আমরা। সংবাদমাধ্যমে খুঁজলে ঘুঘু পাখি শিকারের অসংখ্য শিরোনাম পাওয়া যায়।
এ ছাড়া ধান খাওয়া বা ফসল নষ্ট করার জন্যও মারা হয় ঘুঘু পাখি। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে লালমনিরহাটে ধান খাওয়ার ‘অপরাধে’ শতাধিক ঘুঘুকে বিষ দিয়ে মেরে ফেলেছিলেন এক চাতালমালিক। সেখানে ছিল অনেক ঘুঘু। সেসব পাখির মৃতদেহ সামনে রেখে স্কুলের পোশাক পরা এক শিশু প্রতিবাদ জানিয়েছিল। শিশু সাথী আকতারের সেই ছবিও সে সময় বেশ আলোড়ন ফেলেছিল।
ছোট্ট মেয়ে সাথীর কাছে আমাদের মনুষ্যত্ব আসলে হার মানে। পাখির প্রতি এই মমতাবোধ নিয়েই প্রতিটি শিশু বেড়ে উঠে। কিন্তু বড় হতে হতে সেই মমতাবোধও যেন উড়ে পালায় পাখিরই মতো, হায়!
আবারও জীবনানন্দের শরণ নিই, ‘রূপসী বাংলা’ থেকেই:
পৃথিবীর সব ঘুঘু ডাকিতেছে হিজলের বনে;
পৃথিবীর সব রূপ লেগে আছে ঘাসে;
পৃথিবীর সব প্রেম আমাদের দুজনার মনে;
আকাশ ছড়ায়ে আছে শান্তি হয়ে আকাশে আকাশে।
ঘুঘুই যদি না থাকত, পৃথিবীর এ সৌন্দর্য কি এভাবে ধরা দিত জীবনানন্দের কবিতায়? ঘুঘু ছাড়া কি আদৌ একটি রূপসী বাংলা আমরা কল্পনা করা যায়? যেভাবে ঘুঘু শিকার করা হচ্ছে—নিষ্ঠুর, নির্মম ও চরম অমানবিকতায়, তাতে সৌভাগ্য ও শান্তির পাখিটির অস্তিত্ব হয়তো ইবনে সিরিনের স্বপ্নব্যাখ্যা, বাংলার কিছু প্রচলিত প্রবাদবাক্য আর জীবনানন্দের কবিতা ছাড়া আর কোথাও মিলবে না। এমন দুর্ভাগা দিনই কি অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য?
রাফসান গালিব প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী।
ই–মেইল: rafsangalib1990@gmail.com