মতামত

মহাসমাবেশের পর অবস্থান, এরপর কী

পথে পথে পুলিশ ও সরকারদলীয় লোকজনের বাধা সত্ত্বেও বিপুল উপস্থিতি নিয়ে বিএনপির মহাসমাবেশ। রাজধানীর নয়াপল্টন, গতকাল
ছবি: প্রথম আলো

ঢাকায় একই দিনে দুই বড় দলের সমাবেশ–মহাসমাবেশ জনগণকে কতটা আশ্বস্ত করতে পেরেছে, তা জানা না গেলেও হাজার হাজার মানুষকে যে ভোগান্তিতে ফেলেছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কেবল বিএনপির নেতা–কর্মীরা নন, পথে পথে বাধার সম্মুখীন হয়েছেন সাধারণ যাত্রীরাও। সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও নানা প্রয়োজনে মানুষকে রাস্তায় নামতে হয়। ডেঙ্গুর প্রকোপে কম্পিত ঢাকায় পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়। শ্রমজীবী মানুষ ঘরের বাইরে না গেলে খাবার জোটে না। 

আগেই খবর পাওয়া গিয়েছিল, পথে পথে পুলিশ চেকপোস্ট বসিয়ে ঢাকাগামী সব যানবাহন তল্লাশি করেছে। যেসব যানবাহনে যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের শান্তি সমাবেশের যাত্রী ছিলেন, পুলিশ তাঁদের ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলে ছেড়ে দিয়েছে। যেসব যানবাহনে বিএনপির মহাসমাবেশের যাত্রী ছিলেন, সেসব গাড়ি আটকে দিয়েছে, কিংবা গাড়ি থেকে আরোহীদের নেমে যেতে বলেছে। গণতান্ত্রিক দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গণতান্ত্রিক আচরণই বটে! 

বিএনপির মহাসমাবেশে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থেকে আসা এক মধ্যবয়সী ভদ্রলোক বললেন, বাস ছিল না বলে তাঁরা সাইনবোর্ড পর্যন্ত সিএনজিচালিত অটোরিকশায় এসেছেন। সেখানে পুলিশ তাঁদের নামিয়ে দেওয়ায় যাত্রাবাড়ীগামী লেগুনায় চড়ে বসেছেন। এরপর যাত্রাবাড়ী থেকে লোকাল বাসে কমলাপুর হয়ে হেঁটে সমাবেশস্থলে এসেছেন। যাঁরা আরও দূর থেকে এসেছেন, তাঁদের ভোগান্তি আরও বেশি হয়েছে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) দুই দলের কর্মসূচি কর্মদিবস থেকে ছুটির দিনে নিয়ে গিয়ে একটি ভালো নজির স্থাপন করেছে। নিকট অতীতে পুলিশ সরকারি দলকে সমাবেশের তারিখ পরিবর্তন করতে বলেছে, এ রকম কোনো উদাহরণ নেই। মার্কিন ভিসা নীতি ঘোষণার পর বিরোধী দল সহজেই জনসভার অনুমতি পেয়ে যাচ্ছে। আগে গোলাপবাগ ও বাঙলা কলেজ মাঠ নিয়ে দর–কষাকষি করতে হতো। 

বিএনপির সমাবেশে আসা মানুষকে যেভাবে পুলিশ পথে পথে বাধা দিয়েছে, হোটেলে–গাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে অনেক নেতা–কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে, সেটা আমাদের ভিসা নীতি–পূর্ববর্তী সময়ের কথাই মনে করিয়ে দেয়। কেবল তা–ই নয়, পুলিশ তঁাদের মুঠোফোনও তল্লাশি করেছে। এটা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। ডিএমপি কমিশনার বলেছেন, তাঁরা কোনো নিরীহ লোককে গ্রেপ্তার করেননি। যাঁদের বিরুদ্ধে মামলা আছে, তাঁদেরই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিএনপির নেতা–কর্মীরা এসেছেন ঢাকার বাইরের বিভিন্ন স্থান থেকে; সেখানে কার নামে কী কী মামলা আছে, সেটি ঢাকার পুলিশ জানল কীভাবে? 

এর মাধ্যমে পুলিশ আবারও প্রমাণ করল, তারা নিরপেক্ষ নয়। ক্ষমতাসীনদের পক্ষে যেমন তারা প্রচণ্ড অনুরাগ দেখিয়ে থাকে, তেমনি বিরোধী দলের প্রতি তীব্র বিরাগ। অথচ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে তারা কারও পক্ষে বা বিপক্ষে থাকতে পারে না। বেলা দুইটায় কারওয়ান বাজার থেকে সহকর্মী মনোজ দেকে নিয়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় প্রেসক্লাব যেতে দেখলাম, পথে হাজার হাজার মানুষ সমাবেশস্থলের দিকে যাচ্ছেন। আমরা রমনা, মৎস্য ভবন হয়ে যাচ্ছিলাম। ওই পথে শান্তি সমাবেশের যাত্রীরাই বেশি ছিলেন। মহাসমাবেশের যাত্রীরা পশ্চিম থেকে কাকরাইলের দিকে যাচ্ছিলেন। 

অটোচালককে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি আজকের সমাবেশ সম্পর্কে কিছু জানেন কি না। তিনি বললেন, ‘জানলে কী হবে, আমাদের তো কাজ করেই খেতে হবে।’ তাঁকে বললাম, দেশে গণতন্ত্র ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যই তো এই সমাবেশ। তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, এক হাজার টাকা কেজি কাঁচা মরিচের শান্তি আমরা দেখছি। সরকার তো আমাদের কথা ভাবে না। ব্যবসায়ীদের কথা ভাবে।’ 

সিরডাপের সামনে অটোরিকশা থামিয়ে হাঁটতে শুরু করলে দেখলাম, উত্তর ও পশ্চিম দিক থেকে মিছিল করে মানুষ গুলিস্তানের দিকে যাচ্ছেন। প্রায় সবাই বয়সে তরুণ। অনেকের মাথায় নানা রঙের ক্যাপ। সামনে নিজ নিজ এলাকার নামসংবলিত ব্যানার। একটিতে লেখা গাজীপুর যুবলীগ। তাঁদের সবার মাথায় হলদে রঙের ক্যাপ। দেখেই বোঝা গেল তাঁরা আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত নেতা ও গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের অনুসারী। এর আগে শান্তি শোভাযাত্রায়ও তাঁর সরব উপস্থিতি ছিল। একটির পর একটি মিছিল আসছে। কোনোটি বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়–কলেজ থেকে। কোনোটি ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে। 

হঠাৎ অঝোরে বৃষ্টি নামলে বয়স্ক ব্যক্তিরা আশপাশে দাঁড়িয়ে পড়লেও তরুণেরা মিছিল নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকেন। তখন সমাবেশস্থল থেকে স্লোগান দেওয়া হচ্ছে, ‘শেখ হাসিনা তুমি এগিয়ে চলো, আমরা আছি তোমার সঙ্গে’, ‘তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব’। বৃষ্টির মধ্যেই শান্তি সমাবেশের কাজ শুরু হয়। নেতারা বক্তৃতা দিচ্ছেন। কর্মীরা মুহুর্মুহু স্লোগান দিচ্ছেন। 

জিপিও মোড় থেকে পুরানা পল্টন হয়ে আমরা কাকরাইলের দিকে রওনা হলাম। তখনো গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছিল। কিছু দূর যেতেই দেখলাম, মানুষের স্রোত দক্ষিণ থেকে উত্তরে যাচ্ছে। এখানে তরুণদের চেয়ে বয়স্ক মানুষই বেশি। রাস্তার পাশে চায়ের দোকানে একজন রিকশাচালকের সঙ্গে আলাপ হলো। তিনি রিকশা বন্ধ করে সমাবেশে এসেছেন। কেন এসেছেন? বললেন, নেতারা বলেছেন। নেতাদের নির্দেশেই কর্মী ও সাধারণ মানুষ এসব সমাবেশে আসেন। গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু সেই কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্র আর আসে না। 

গতকাল বিএনপির মহাসমাবেশ ও আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশের চেহারা ছিল বেশ উদ্দীপ্ত। দুই পক্ষই বেশি লোকসমাগম করে নিজেদের শক্তি দেখাতে চেয়েছে। তবে পরিবেশ শান্ত ছিল। দুই দলের সমাবেশ থেকে কোনো কোনো নেতা উসকানিমূলক কথা বললেও কর্মী-সমর্থকেরা উত্তেজনা দেখাননি। তাঁরা সম্ভবত ধরে নিয়েছেন, নির্বাচনের আগে আরও অনেক সমাবেশ করতে হবে। এখনই শক্তি ক্ষয় করে কী লাভ? 

গতকালের সমাবেশ দেখে ১৯৯৬ সালের কথা মনে পড়ল। সেই সময় আওয়ামী লীগ ছিল বিরোধী দলে। আর বিএনপি ক্ষমতায়। আজ বিএনপি বিরোধী দলে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। ২৭ বছর পরও মানুষকে ভোটের দাবিতে আন্দোলন করতে হচ্ছে। ১৯৯৬ সালে প্রেসক্লাবের সামনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে জনতার মঞ্চ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল একই দাবিতে। সেখানে প্রতিদিন সমাবেশ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। বিরোধী দলের আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ৩০ মার্চ বঙ্গভবনে গিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করলেন। তৎকালীন িবরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা সমাবেশ করলেন তোপখানা রোডে। দুই সমাবেশই দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। আওয়ামী লীগ সেদিন গণতন্ত্রের বিজয় সমাবেশ করেছিল। আজ বিএনপি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন করছে। 

সেদিন দুই দলের সমাবেশেই বিপুলসংখ্যক লোক হয়েছিল। গতকাল শান্তি সমাবেশ না মহাসমাবেশে বেশি লোক হয়েছে, সেই বিতর্কে না গিয়েও বলা যায়, এই দুটি দলেরই বড় জনসমর্থন আছে। নির্দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত চারটি নির্বাচনের পরিসংখ্যান নিলেও সেটা প্রমাণিত হয়। আবার আওয়ামী লীগ বা বিএনপির কারও এমন জনসমর্থন নেই যে নিজস্ব ভোটে জয়ী হতে পারে। যারা যখন নিজের বলয়ের বাইরের ভোট টানতে পারে, তারাই জয়ী হয়। জনসমর্থন কারও স্থায়ী সম্পত্তি নয়। 

তার চেয়েও জরুরি কথা হলো আওয়ামী লীগ বা বিএনপির মধ্যে যেকোনো একটি দলকে বাদ দিয়ে (কোনো দলকেই নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বাইরে রাখা যাবে না)  নির্বাচন করার অর্থ কেবল দলের নেতা–কর্মী নয়, তাঁদের ভোটারদেরও বঞ্চিত করা। 

বিএনপি এক দফা দাবিতে গতকাল মহাসমাবেশ ডেকেছিল। মহাসমাবেশের পর আজ ঢাকার প্রবেশপথগুলোতে অবস্থান কর্মসূচি পাালন করবে। আওয়ামী লীগও হয়তো পাল্টা কর্মসূচি নেবে। এরপর কী হবে?

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

sohrabhassan55@gmail.com