মিয়ানমার নিয়ে আশপাশের দেশগুলোর উদ্বেগের শেষ নেই। তার সঙ্গে যদি পারমাণবিক বোমা তৈরির উপাদান ইউরেনিয়াম বেচাকেনার খবর যুক্ত হয়, তাহলে নিশ্চিতভাবে উৎকণ্ঠা আরও বাড়ে। ইদানীং তা–ই হচ্ছে। অনেকগুলো বিদেশি সংবাদমাধ্যমে বলাবলি হচ্ছে, মিয়ানমারে ইউরেনিয়ামের চোরাই ব্যবসা চলছে। প্রশ্ন উঠেছে, ব্যাপারটা কি ব্যবসাতেই সীমিত—নাকি রাষ্ট্র হিসেবে তাদের এ–সংক্রান্ত কোনো কর্মসূচিও আছে?
সাম্প্রতিক সংবাদগুলোর আগেই এটা প্রচারিত ছিল, মিয়ানমারে শান স্টেটসহ কয়েকটি জায়গায় ইউরেনিয়ামের খনি আছে। আবার স্বর্ণখনির উপজাত হিসেবেও ইউরেনিয়াম পায় তারা। খনিজ হিসেবে ইউরেনিয়ামের প্রতি বিশ্বব্যাপী আকর্ষণের কারণ হলো পারমাণবিক বোমায় এর ব্যবহার উপযোগিতার কারণে।
মিয়ানমারের শান স্টেট গেরিলা উপদ্রুত এলাকা। এখানকার যে এলাকায় ইউরেনিয়ামের খনি আছে বলা হচ্ছে, সেটা ‘রেস্টোরেশন কাউন্সিল অব শান স্টেট’ দলের প্রভাবিত এলাকা। বহির্বিশ্বে এরা ‘আরসিএসএস’ নামে পরিচিত। এদের সশস্ত্র শাখার নাম শান স্টেট আর্মি-দক্ষিণ। এর নেতা হলেন ইয়ার্ড শার্ক—খ্যাতনামা গেরিলা নেতা।
ইয়ার্ড শার্কের উত্থান ‘গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গালে’র গডফাদার খুন সার যোদ্ধাসমাজ থেকে। একদিকে শান জাতীয়তাবাদ এবং অন্যদিকে মাদকের অস্বচ্ছ ব্যবসার অন্যতম প্রধান এক চরিত্র তিনি। মিয়ানমারে ইউরেনিয়ামের চোরাই বেচাকেনার প্রতিবেদনগুলোতে এই ইয়ার্ড শার্কের নাম আসছে বারবার। বলা হচ্ছে, মিসাইলসহ আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র জোগাড় করতে তিনি ও তাঁর দল আরসিএসএস ইউরেনিয়াম বিক্রি করতে জাপানের ‘ইয়াকুজা’ মাফিয়াদের দায়িত্ব দিয়েছিল।
এ রকম অস্পষ্ট অবস্থার মধ্যে এখনকার বড় প্রশ্ন হলো মিয়ানমারে পরিশোধিত ইউরেনিয়াম পাওয়া যাচ্ছে কীভাবে? মিয়ানমারের পারমাণবিক বোমা তৈরির বিষয়টা দূরকল্পনা হিসেবে গুরুত্বের সঙ্গে আমলে না নিলেও গৃহযুদ্ধে সেখানকার অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক কাঠামো যে ঢিলেঢালা চেহারা নিয়েছে, তাতে ইউরেনিয়ামের মতো সামগ্রীর চোরাই সিন্ডিকেট নিশ্চিতভাবে আশপাশের সব দেশের জন্য উৎকণ্ঠার কারণ।
যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দারা গত চার বছর সময় ব্যয় করে নিজেদের ইরানি জেনারেলের ছদ্ম পরিচয় দিয়ে থাইল্যান্ডে এই সিন্ডিকেটের তাকেশি ইবিসাওয়া নামের একজনের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। এভাবেই ব্যাপারটা ফাঁস হয়। ইবিসাওয়া তার কয়েকজন সহযোগীসহ আমেরিকার জিম্মায় আছেন এখন।
মাসুদ রানা সিরিজের গল্পের মতো এসব কাহিনির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষ করে এই ঘটনায় জাপানের ইয়াকুজাদের নাম যুক্ত হওয়ায়। এদের জাপানে প্রকাশ্যে সন্ত্রাসী মাফিয়া বলা হলেও ভেতরে-ভেতরে জাপানিরা তাদের খুব পছন্দ করে। জাপানের প্রশাসনও ইয়াকুজাদের সমীহ করে তাদের জাতীয়তাবাদী চরিত্রের কারণে। মাফিয়া হলেও এশিয়াজুড়ে জাপানের স্বার্থ দেখা কর্তব্য জ্ঞান করে তারা।
স্বভাবিক কারণেই ইয়াকুজারা পশ্চিমাদের ভালো চোখে দেখে না। পশ্চিমারাও এদের নিন্দায় পঞ্চমুখ থাকে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে ইউরেনিয়াম চোরাচালানের এই ঘটনার বিশ্বাসযোগ্য অনেক তথ্যই দেওয়া হয়েছে। তারা বলছে, ইউরেনিয়ামের যেসব নমুনা ওয়াশিংটনের এজেন্টরা জাপানি সিন্ডিকেট থেকে জোগাড় করেছে, সেগুলো পারমাণবিক বোমার উপযোগী।
‘ফ্রন্টিয়ার মিয়ানমারে’ প্রকাশিত তথ্যমতে ইয়ার্ড শার্কের সূত্রে ইবিসাউয়ার কাছে শানের দুই হাজার কেজি থোরিয়াম–২৩২ এবং এক শ কেজি ইউ-৩০৮ (ট্রাইউরেনিয়াম অক্টক্সাইড) ছিল। থাই পুলিশের সাহায্য নিয়ে এসবের নমুনা জোগাড় করে যুক্তরাষ্ট্র তাদের ল্যাবে পরীক্ষা করেছে।
মিয়ানমারে ইউরেনিয়ামের কেনাবেচার প্রচারিত গল্প সত্য হলে উদ্বেগের দিক দুটি। প্রথমত, খনি এলাকার সবগুলো সরকার নিয়ন্ত্রণ করছে না। কিছু কিছু ইউরেনিয়াম খনি গেরিলাদের নিয়ন্ত্রণেও আছে—যে গেরিলারা অর্থের জন্য মরিয়া। পণ্য হিসেবে ইউরেনিয়াম তাদের কাছে অর্থ জোগাড়ের একটা উৎস হওয়া বিচিত্র নয়। অন্যদিকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা খনি নিয়েও উদ্বেগ আছে। কারণ, দেশটির সামরিক সরকার কাজকর্মে স্বচ্ছ নয় এবং তারাও অর্থনৈতিক সংকট কাটাতে সব উপায়ে চেষ্টা করছে।
‘ফ্রন্টিয়ার মিয়ানমার’ সংবাদমাধ্যম গত এপ্রিলে তাদের এক প্রতিবেদনে লিখেছে, জাপানি ইয়াকুজাদের থেকে ধরা পড়া শান প্রদেশের ইউরেনিয়ামগুলো প্রাথমিক মাত্রায় পরিশোধিত ছিল। প্রশ্ন উঠেছে, এই পরিশোধনকাজটি কোথায় হয়েছে? মিয়ানমারের ভেতরেই কি তবে সেই প্রযুক্তি রয়েছে? ইয়ার্ড শার্ক ইতিমধ্যে কোনো কিছুতে যুক্ত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন। বলেছেন, ইউরেনিয়াম কেমন জিনিস, সেটাও জানা নেই তাঁর।
অতীতে মিয়ানমারে বহুবার পারমাণবিক বোমা তৈরির ‘স্বপ্নে’র কথা শোনা গেছে। যে দেশে ইউরেনিয়াম আছে, তাদের এ রকম প্রত্যাশার সুযোগ খানিকটা থাকেই। মিয়ানমার সশস্ত্র বাহিনী তাতমাদো এর ‘অ্যাটমিক ইউনিট’ বলে একটা বিভাগও ছিল একদা। পাশাপাশি এ কাজে উত্তর কোরিয়া ও রাশিয়ার সহযোগিতার কথাও শোনা যায়। তবে দেশটির এ রকম কর্মসূচির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্নও ছিল বরাবর।
তা ছাড়া ২০১৬ সালে অং সান সু চির আমলে পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা বন্ধে আন্তর্জাতিক এক উদ্যোগেও শামিল হয় মিয়ানমার। আবার বৈশ্বিক বর্জনের মুখে ২০২২ সালের অক্টোবরে রাশিয়া এ দেশে ‘শান্তিপূর্ণ প্রয়োজনে’ একটা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করারও ঘোষণা দেয়। সম্প্রতি যেসব বামার সেনা কর্মকর্তা মস্কোতে প্রশিক্ষণে গিয়েছেন, তাঁদের কেউ কেউ এ প্রযুক্তি নিয়ে লেখাপড়া করছেন বলেও সংবাদ আছে। এ রকম পটভূমিতে ইউরেনিয়াম বেচাকেনার সাম্প্রতিক খবর স্বভাবত চারদিকে বাড়তি উদ্বেগ ছড়িয়েছে।
২০০৪ সালে প্রথম এ রকম খবর সামনে আসে যে পারমাণবিক বোমা তৈরির বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারকে তীক্ষ্ণ নজরদারিতে রেখেছে। ওয়াশিংটনের সন্দেহ, উত্তর কোরিয়া বামার জেনারেলদের এ রকম কর্মসূচিতে সহযোগিতা করতে পারে।
২০০৮-এর নভেম্বরে জেনারেল শুয়ে মানের নেতৃত্বে মিয়ানমার সশস্ত্র বাহিনী বা তাতমাদোর ১৭ সদস্যের একটা দল পিয়ংইয়ং ও মাইয়োংঙ সফরে গেলে ওই সন্দেহ আরও বাড়ে। শেষোক্ত এলাকায় পর্বতের নিচে উত্তর কোরিয়া তাদের পারমাণবিক যুদ্ধাস্ত্রভান্ডার জমা রেখেছে বলে প্রচার রয়েছে। ২০১০-এ প্রথম তাতমাদোর একজন জেনারেল স্বীকার করেন, উত্তর কোরিয়া থেকে তারা এই প্রযুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করেছেন।
ইতিমধ্যে অবশ্য মিয়ানমার সরকার এ রকম একটা বিবৃতিও দিয়েছে যে তাদের পারমাণবিক বোমা তৈরির ইচ্ছা নেই, তবে ‘শান্তিপূর্ণ প্রয়োজনে’ এই প্রযুক্তির উন্নয়ন সাধনের অধিকার অবশ্যই আছে। বলা বাহুল্য, এই বিবৃতির পরও এ বিষয়ক সন্দেহ কমেনি। অন্তত যুক্তরাষ্ট্র যে এ বিষয়ে তাদের নজরদারি অব্যাহত রেখেছে, সেটা জাপানি সিন্ডিকেটকে শনাক্ত করার ঘটনায় স্পষ্ট।
তবে মিয়ানমারে পারমাণবিক রহস্য নিয়ে চূড়ান্ত কথা বলা যাচ্ছে না এখনই। পারমাণবিক নিরাপত্তা বিষয়ে যেকোনো উদ্বেগ নিরসনে বিশ্বের খ্যাতনামা সংস্থা হলো ‘ইনস্টিটিউট ফর সায়েন্স অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি’ বা আইএসআইএস। এই সংস্থা তাদের এক অনুসন্ধানে বলেছে, বিভিন্ন পদ্ধতিতে যাচাই করে মিয়ানমারের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির প্রকল্প আছে এমন কোনো নিশ্চিত প্রমাণ পায়নি তারা। তবে এর মানে এই নয় যে মিয়ানমারের কাছে এ ধরনের কোনো প্রকল্প নেই। বিশেষ করে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে দেশটির সম্পর্ক সন্দেহ বাড়াচ্ছে।
এ রকম অস্পষ্ট অবস্থার মধ্যে এখনকার বড় প্রশ্ন হলো মিয়ানমারে পরিশোধিত ইউরেনিয়াম পাওয়া যাচ্ছে কীভাবে? মিয়ানমারের পারমাণবিক বোমা তৈরির বিষয়টা দূরকল্পনা হিসেবে গুরুত্বের সঙ্গে আমলে না নিলেও গৃহযুদ্ধে সেখানকার অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক কাঠামো যে ঢিলেঢালা চেহারা নিয়েছে, তাতে ইউরেনিয়ামের মতো সামগ্রীর চোরাই সিন্ডিকেট নিশ্চিতভাবে আশপাশের সব দেশের জন্য উৎকণ্ঠার কারণ।
আলতাফ পারভেজ: ইতিহাস বিষয়ে গবেষক।