অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ঢাকা, ২৭ নভেম্বর
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ঢাকা, ২৭ নভেম্বর

মতামত

কার সঙ্গে কার ঐক্য, কার সঙ্গে কার বিভেদ

কয়েক দিন ধরে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তৃতা–বিবৃতিগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে শুনেছি, পড়েছি। সেখানে তিনি জাতীয় ঐক্যের ওপর জোর দিয়েছেন। একই সঙ্গে ঐক্য ধরে রাখতে না পারলে ফ্যাসিবাদের পুনরাগমনেরও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। কেবল বক্তৃতা–বিবৃতি নয়, বুধবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেও বিএনপির মহাসচিব জাতীয় ঐক্য বজায় রাখার কথা বলেছেন। 

এর এক দিন পর জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমানও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ঐক্যের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। জাতীয় ঐক্যের কথা বলছে অতীতে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী প্রতিটি দল ও সংগঠন। ঐক্যের কথা বলছেন জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রনেতারাও। 

তাঁদের সবার অভিন্ন লক্ষ্য ছিল জবরদস্তিভাবে ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনার সরকারকে হটানো। সেই কাজটি শেষ হওয়ার পর আন্দোলনকারী দল ও ছাত্রনেতৃত্ব কিন্তু এখন ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানে। এক দলের সঙ্গে আরেক দলের নীতি ও আদর্শেরও মিল নেই।

ইতিমধ্যে বাম–ডান ও মধ্যপন্থার বিতর্ক সামনে এসেছে। এমনকি অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ, সংস্কার, নির্বাচন ইত্যাদি বিষয়েও তাঁরা একমত হতে পারছেন না। আন্দোলনকারী দলগুলোর সঙ্গে সরকারের দূরত্ব বেড়েছে। যে অন্তর্বর্তী সরকার নিজেদের ছাত্র আন্দোলনের ফসল বলে দাবি করছে, সেই ছাত্ররাও তাদের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নাকচ করে দিচ্ছে। এ এক অদ্ভুত পরিস্থিতি। 

 বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছে, যেকোনো মূল্যে পতিত স্বৈরাচারের পুনরাগমন ঠেকাতে হবে। মাত্র সাড়ে তিন মাসের ব্যবধানে ঠেকানোর প্রশ্ন আসে কেন? তাহলে আন্দোলনকারীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের অভাব আছে? কোনো দেশে এত অল্প সময়ে বিতাড়িতরা ফিরে আসতে পারে না। ভবিষ্যৎ যা–ই হোক না কেন, বাংলাদেশ আর  ৫ আগস্টের আগের অবস্থায় ফিরে যাবে না।

তবে অন্তর্বর্তী সরকার জনগণের মৌলিক সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হলে, তাদের জানমালের নিরাপত্তা দিতে না পারলে, বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের ন্যায্য দাবি পূরণ করতে না পারলে তাদের মন থেকে স্বৈরাচারের ক্ষত অল্প সময়ে মুছে যাবে। সাড়ে তিন মাসে মানুষ ৫ আগস্টের আগের ও পরের অবস্থার তুলনা করতে শুরু করেছে।  

জাতীয় ঐক্য হয় সম–আদর্শ ও সমচিন্তার মানুষের মধ্যে। আওয়ামী লীগ পুরো দেশকে নিজেদের ছাঁচে তৈরি করতে গিয়ে বিপত্তি ঘটিয়েছিল। জুলাই–আগস্ট আন্দোলনে জয়ীরা সেই পথে যাবে না বলেই আমাদের বিশ্বাস। অনেকেই বলেছেন, স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগের সঙ্গে আন্দোলনে বিজয়ী শক্তির সমঝোতা হতে পারে না। এর কারণ তারা জনগণের ভোটাধিকার হরণ করেছে। এর কারণ তারা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ করেছে। তাদের যুক্তি মানলাম। 

কিন্তু আওয়ামী লীগ বিতাড়িত হওয়ার পরও সংবাদমাধ্যম আক্রমণ ও আক্রোশের শিকার হচ্ছে। যারা এ কাজটি করছে, তাদের সঙ্গে কী করে সমঝোতা বা ঐক্য হতে পারে। যাঁরা বলছেন ফ্যাসিবাদী রাজনীতি রুখে দাঁড়াবেন, আমরা তঁাদের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। কিন্তু তঁাদের বুঝতে হবে গণতান্ত্রিক রাজনীতি দিয়েই ফ্যাসিবাদকে রুখতে হয়।

যাঁরা বৈষম্যবিরোধী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে চান, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাও তঁাদের নিশ্চিত করতে হবে।  যঁারা বাংলাদেশকে একটি পরিবার বলে দাবি করেন, তাঁদের কর্তব্য হবে এর মধ্যে বিভেদ তৈরিকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়া। ধর্ম–বর্ণনির্বিশেষে সব মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে জাতীয় ঐক্য যে সম্ভব নয়, সে কথা উঠে এসেছে গণতান্ত্রিক অধিকার নাগরিক কমিটির বিবৃতিতে।

তাঁরা বলেছেন, ‘গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে মাজার–খানকায় হামলা হলো, প্রোপাগান্ডা বাদ দিলেও হিন্দুদের বাড়িঘর–স্থাপনায় হামলার কিছু ঘটনাটা ঘটেছে, শ্রমিকের ওপর গুলি চলল, অন্য জাতিগেষ্ঠীর মানুষের ওপর হামলা হলো, রিকশাচালকদের ‘ভিলেন’ বানানোর চেষ্টা চলল, নারীবিদ্বেষী প্রোপাগান্ডা চলল, বাজারে সিন্ডিকেটবাজি চলল; কিন্তু এই সবকিছুতেই সরকারের ভূমিকা আশ্চর্যজনকভাবে প্রায় নিষ্ক্রিয় এবং অকার্যকর থাকল।’

তাদের মতে, যেকোনো গণতান্ত্রিক দাবির আন্দোলনকেই ফ্যাসিবাদের দোসরদের কাজ বলে ট্যাগ দেওয়ার চেষ্টা, গণ-অভ্যুত্থানকারী শক্তিগুলোর মধ্যে বিভাজন সৃষ্টিকারী বক্তব্য প্রদান বা দায়িত্বজ্ঞানহীন মতামত প্রকাশ, সর্বোপরি পরিস্থিতি সামাল দিতে চরম ব্যর্থতা—এ সবকিছুই নানা রকম বিভাজনকে উসকে দিয়ে পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করে তুলছে।’ 

বিএনপি, জামায়াত, গণতন্ত্র মঞ্চ, বাম গণতান্ত্রিক জোটসহ অনেক দলই জাতীয় ঐক্য ধরে রাখার কথা বলেছে। কিন্তু সেই ঐক্য কার বিরুদ্ধে, কাদের ঐক্য, সে কথা স্পষ্ট করে বলছেন না। 

যেকোনো ঐক্য গড়ে তোলার জন্য ন্যূনতম কিছু শর্ত পালন করতে হয়। ঐক্যপ্রয়াসীদের বলতে হবে, তাঁরা দেশটাকে কোন দিকে নিয়ে যেতে চান? তাঁরা কি বাংলাদেশকে একটি সত্যিকার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে চান? তাঁরা কি সব ধরনের ধর্মীয় ও জাতিগত বৈষম্যের অবসান চান? তাঁরা কি গরিষ্ঠসংখ্যক মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি চান? তাঁরা কি লাখ লাখ তরুণকে বেকারত্বের দুঃসহ যন্ত্রণা থেকে রক্ষা করতে টেকসই কোনো পরিকল্পনা নেবেন? তাঁরা কি দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করা ৪ কোটি ১০ লাখ মানুষকে ওপরে নিয়ে আসার জন্য আশু কর্মসূচি নেবেন?

যদি মানুষের অর্থনৈতিক সংস্কার না হয়, এসব হাওয়াই সংস্কার খুব বেশি কাজে লাগবে না। মূল কথা আন্দোলনকারীরা কি ভদ্রলোকের বাংলাদেশ চান, না গণমানুষের বাংলাদেশ চান, সেই কথাটি স্পষ্ট করে বলতে হবে।  

আওয়ামী লীগ জাতিকে বিভক্ত করেছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে। স্বাধীনতার পক্ষের ও বিপক্ষের শক্তির নামে। এখন অনেকে পক্ষে–বিপক্ষে নানা মতাদর্শের নামে বিভক্ত করতে চাইছে। পীরের দরগাহ জ্বালিয়ে দিচ্ছে। বাউলগানের আসর বন্ধ করে দিচ্ছে গায়ের জোরে। নানা তকমা লাগিয়ে পত্রিকা অফিসে হামলা চালাচ্ছে। যাকেই নিজের মতের বিরোধী মনে করছেন, তাকেই ফ্যাসিবাদের  দোসর হিসেবে গণ্য করছেন। সরকারি অফিস, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে মব জাস্টিস। এমনকে পেশাজীবী প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনগুলোও এর বাইরে নয়। এ অবস্থায় জাতীয় ঐক্য কীভাবে হবে? 

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে তাদের বিরুদ্ধে যারা ঐক্যবদ্ধ ছিল, তারা এখন নানা ভাগে বিভক্ত। এক দল অন্য দলকে সহ্য করছে না। এক নেতা আরেক নেতার দেশপ্রেম নিয়ে কটাক্ষ করছেন। 

মাত্র সাড়ে তিন মাসে কেন এই অবস্থা হলো? ৫ আগস্টের পর মানুষ যে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছিল, সেই স্বপ্ন কেন ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে যাচ্ছে, সেই প্রশ্নের উত্তর সরকারকেই খুঁজতে হবে। 

রাজনৈতিক দলগুলোর মত ও পথের ভিন্নতা যা–ই থাকুক, একটি বিষয়ে তারা একমত যে সমস্যাগুলো মোকাবিলায় সরকারের যেভাবে সক্রিয় হওয়ার কথা, সেভাবে সক্রিয়তা দেখা যাচ্ছে না। ফলে একের পর এক অঘটন ঘটছে। 

আমরা দেখলাম চট্টগ্রামে আদালত প্রাঙ্গণেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। পারলে আইনজীবী হত্যার ঘটনা ঘটত না। একের পর এক কলেজে ছাত্রদের সংঘর্ষেও তাদের ভূমিকা যথাযথ ছিল না। এ অবস্থায় মানুষ সরকারের প্রতি ভরসা রাখবে কীভাবে? ঐক্য তখনই হতে পারে, যখন পরস্পরের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। অন্যথায় ঐক্য বিভেদের চোরাগলিতে হারিয়ে যায়। 

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

sohrabhassan55@gmail.com