জনগণের তেল তো বেশিই হয়ে গিয়েছিল। আকাশে মাথা তুলে দেখত মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু, দেখত স্যাটেলাইট, লেজার শো আর উন্নয়নের বিলবোর্ড। মাটির দিকে চোখ ছিল না কারও। অথচ পথটা কেবল ভাঙাচোরাই ছিল না, টাঙ্গাইলের সাম্প্রতিক বাস ডাকাতির মতো সেই পথে ছিল ডাকাত দল আর সামনে ছিল খাদ। এমন পথে শুধু গণডাকাতিই হয় না, খাদেও পড়তে হয়। সবই মধ্যরাতের ব্যাপার।
প্রথমে সয়াবিনের দাম বাড়ল। দোহাই এল ইউক্রেন যুদ্ধের। এখন তো তেলের দাম, গমের দাম কমেছে, তারপরও কেন জ্বালানি তেলের দাম একলাফে এত বেড়ে গেল? তাও আবার দাম বাড়ানোর আইনি এখতিয়ার যাদের, সেই বিইআরসিকে পাশ কাটিয়ে? ডিজেল-পেট্রল-অকটেনের ব্যবসা তো স্বয়ং সরকারের। কোনো ব্যবসায়ী পণ্যের দাম একলাফে ৫০ শতাংশ অর্থাৎ দেড় গুণের মতো করার সাহস করেন না। কিন্তু আমাদের সরকার এখানে ঐতিহাসিক রেকর্ড গড়ল। এই এক বছরে সেচের তেলের দাম বাড়ল, সারের দাম বাড়ল, পরিবহন খরচ বাড়াল, ওষুধের দাম বাড়ল, বাজারের প্রায় সব জিনিসের দাম বাড়ল। রান্নার গ্যাসের দাম বেড়েছে, বিদ্যুতের দাম আরেক দফা বাড়ানোর তোড়জোড় চলছে। ওয়াসার সাত লাখ টাকা বেতনের এমডি পানির দামও বাড়িয়ে যাচ্ছেন। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, বোধ হয় বিরাট কোনো অপরাধে গণশাস্তি দেওয়া হচ্ছে।
অথচ শাস্তি কাদের পাওয়ার কথা ছিল? বৈদেশিক মুদ্রার মজুত এমন চাপে পড়ল কেন? যদি গুরুতর চাপই না হবে, তাহলে আইএমএফ এল কেন? কেন তেলের দাম বাড়ানোর মাধ্যমে অর্থনীতির সংকোচন ঘটিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা বাঁচানোর এই মরিয়া চেষ্টা? মুদ্রা পাচার (বছরে ৭.৫৩ বিলিয়ন ডলার। সূত্র: জিএফআই) ঠেকানো হলো না কেন? শ্রীলঙ্কান মতো উন্নয়নশীল দেশকেও কেউ যখন ঋণ দিচ্ছিল না, তখন আমরা দিলাম। আমাদের ডলার কি বেশি হয়ে গিয়েছিল? এক বছর ধরে রেকর্ড রপ্তানির পরও রেকর্ড পরিমাণ বাণিজ্যঘাটতি হচ্ছিল, কেউ কেন খতিয়ে দেখেনি যে আন্ডারইনভয়েসিংয়ে ডলার পাচার হচ্ছে কি না। বিনিয়োগ করা ডলারকেও ফরেন রিজার্ভের খাতায় দেখানোকে আইএমএফ ঠিক মনে করে না। আইএমএফ নিজেই ঢাকায় এসে বলেছে, এটা আন্তর্জাতিক সংস্থার স্বীকৃত রীতি নয়।
কিন্তু মুদ্রাখেকোদের ক্ষুধা তো মেটার কথা নয়। তাই জনগণকে নিংড়ানোর নতুন নতুন বন্দোবস্ত করা হচ্ছে। যতভাবে মানুষের আয়ে ভাগ বসানো যায়, তার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। জনগণ যেন আখের মতো, যত চিপবে, তত রস বেরোবে। অর্থনীতির রক্তক্ষরণের মধ্যে যদি মানুষের রক্ত পানি করা শ্রমঘাম দেখা যায়, তবে তা ধীরে ধীরে মানুষের প্রাণশক্তি শুষে নেবে।
মানুষ অনিশ্চয়তার দিকে তাকিয়ে ভীত। ধনীরাও দেশে টাকা রাখা নিরাপদ মনে করছে না বলেই পাচার করছে। অথবা পুরো টাকাটাই অবৈধ বলেই সরাচ্ছে। ২০২১ সাল শেষে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা অর্থের পরিমাণ ছিল ৯১৭ বিলিয়ন ডলার। এক বছরে বেড়েছে ৫৫ শতাংশ। কী আশ্চর্য কাকতাল। তেলের মূল্যবৃদ্ধির হারের প্রায় সমান হার। এটা কেবল সুইস ব্যাংকের হিসাব; দুবাই, সিঙ্গাপুর, কানাডায় কত জমেছে সেই হিসাব পাওয়া বাকি।
বেসরকারি কোম্পানিগুলো প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ (মার্চ ২০২২ পর্যন্ত) নিয়ে বসে আছে (সূত্র: বাংলাদেশ ব্যাংক)। এক বছর আগে এটা ছিল প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলার। এক বছরের মধ্যে ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি কি স্বাভাবিক? যখন আমার মুদ্রা অতি মূল্যায়িত, তখন ডলারে এত পরিমাণ ঋণ নেওয়া উচিত ছিল না। এই টাকা ফেরত দিতে না পারলে টাকার অবমূল্যায়ন আরও হবে। ফলে তারা জিনিসপত্রের দাম আরও বাড়িয়ে দেবে। সয়াবিন তেলের দাম লিটারপ্রতি আরও ২০ টাকা বাড়ানোর কথা বলেছেন ব্যবসায়ীরা। ঢাকা ওয়াসার বিদেশি ঋণ ২১ হাজার কোটি টাকা। চট্টগ্রাম ওয়াসার ঋণ ৬ হাজার ২২২ কোটি টাকা। এসবের খেসারত কারা দেবে? পানির দাম আরও বাড়াচ্ছে ওয়াসা।
জাতীয় গ্রিডে এক ইউনিট বিদ্যুতের জোগান না দিয়েও বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের দেশি ও বিদেশি মালিকদের ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ তিন বছরে দেওয়া হয়েছে ৫৪ হাজার কোটি টাকা! (প্রথম আলো, ২৯ জুলাই)। কারও কিছু হলো না, জনগণ পেল অসহনীয় লোডশেডিং। গাছে পানি দেওয়া দেখতে আমলাদের বিদেশ সফরও বন্ধ হয়নি। অপচয় ও দুর্নীতি যাঁরা করবেন, তাঁরা পুরস্কৃত হচ্ছেন। ঋণখেলাপির শাস্তি নেই, দুর্নীতির শাস্তি নেই, ভুল প্রকল্পের সংশোধন নেই, টাকা পাচার থামানো নেই, শুধু আছে দাম বাড়ানোর গণশাস্তি।
বিশ্ববাজারে তেলের দাম গত ছয় মাসের মধ্যে এখন কম। তাই বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয়ের যে যুক্তি সরকারের মুখপাত্ররা দিচ্ছেন, তা সত্য না। আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ পাওয়ার শর্ত হিসেবে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোও বৃথা অজুহাত। যদি বাজার সমন্বয় করাই উদ্দেশ্য হতো, সে ক্ষেত্রে একবারে ধাক্কা না দিয়ে ২-৩ বছর নিয়ে করাই নিয়ম। টাকা যদি অতি মূল্যায়িত হয়ে থাকে, সেটাও ধাপে ধাপে সমন্বয় করা উচিত ছিল। ভর্তুকি কমাতে হলে আগে লুটপাটকারীদের ভর্তুকি, ঋণ মওকুফ, কুইকরেন্টাল বন্ধ ইত্যাদি করতেন!
মানুষ এখন দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাবেই। অর্থনীতিক সংকটের সঙ্গে রেকর্ড পরিমাণ টাকা পাচার, অবিশ্বাস্য পরিমাণ খেলাপি ঋণ, বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খরচের অবকাঠামো প্রকল্পের যোগাযোগ বের করছেন বিশ্লেষকেরা।
যারা রাজনীতি বুঝতে চাইনি, তাদের এখন অর্থনীতি বুঝতে হচ্ছে। আগামী কয়েক বছর পেট টাইট করে চলতে হবে। যা হওয়ার তা হয়েছে। কিন্তু যারা মিথ্যা তথ্য দিয়ে কাল্পনিক সমৃদ্ধির গল্প বলে জাতিকে ঘুম পাড়িয়ে রাখল, সেই জাতিকে যারা বারবার মধ্যরাতে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে ধাক্কাটা দিল; সেসবের কী শাস্তি হবে? মাশুল দেবে কেবল সাধারণ মানুষ? এসব কি দূরদর্শিতার অভাব নয়? যাঁরা দায়িত্বে ছিলেন, তাঁরা কি ঠিক কাজটা করেছেন? ইউক্রেন যুদ্ধ তো সেদিনের ঘটনা, পরিসংখ্যানগুলো তো কোভিডের সময়ের। সে সময়েও এমন অপচয় ও নিয়ন্ত্রণহীনতা চলেছে বলেই আজ এ অবস্থা। কোভিড পরিস্থিতির পরও পরিস্থিতি ক্রমে উন্নত হতে থাকবে, সরকার কী করে এমন গোলাপি স্বপ্নে বিশ্বাস রাখল? খারাপ পরিস্থিতির জন্য তৈরি থাকাই তো দরকার ছিল, তাই না? এ কেমন উল্টো রাজার দেশ হলো আমাদের।
অদূরদর্শিতা বলি, অপচয় ও লুটপাট বলি, সরকারের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। যাঁরা দেশ চালান, তাঁরা কি নিজেরাই জানতেন কী ঘটছে? নাকি সব এতই ছেড়ে দিয়ে রেখেছিলেন যে কিছুই আর সামলাতে পারছেন না।
এসব করে করে এখন তহবিলে টান পড়েছে। প্রবাসীদের পাঠানো ডলার পাচার হয়ে গেছে, অপচয় হয়ে গেছে। কিন্তু মুদ্রাখেকোদের ক্ষুধা তো মেটার কথা নয়। তাই জনগণকে নিংড়ানোর নতুন নতুন বন্দোবস্ত করা হচ্ছে। যতভাবে মানুষের আয়ে ভাগ বসানো যায়, তার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। জনগণ যেন আখের মতো, যত চিপবে, তত রস বেরোবে। অর্থনীতির রক্তক্ষরণের মধ্যে যদি মানুষের রক্ত পানি করা শ্রমঘাম দেখা যায়, তবে বোঝা যাবে তা মানুষের প্রাণশক্তি শুষে নেওয়ারই আয়োজন।
ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও প্রতিচিন্তার নির্বাহী সম্পাদক।
faruk.wasif@prothomalo.com