ঢাকা ও কলকাতা। দুই বাংলার দুই প্রধান মহানগর। ঢাকা স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের রাজধানী। ৩০০ বর্গকিলোমিটারের বেশি এলাকা নিয়ে ঢাকা শহরে দুটি সিটি করপোরেশন—ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। দুই করপোরেশনের জনসংখ্যা প্রায় ১০ মিলিয়ন। বিপরীতে ঢাকা জেলার আয়তন ১৪৬৩ দশমিক ৬ কিলোমিটার এবং জনসংখ্যা ১ কোটি ৪৭ লাখ ৩৮ হাজার ৭০১ জন (২০২২)।
ঢাকা জেলার জন্য রয়েছে দেশের অন্যান্য জেলার মতো সুগঠিত একটি জেলা প্রশাসন। তা ছাড়া রয়েছে বিভিন্ন সেবা-পরিষেবার জন্য কেন্দ্রীয় বা জাতীয় সরকারের ৫৬টি অধিদপ্তর, পরিদপ্তর, করপোরেশন ইত্যাদি। নগর হিসেবে কলকাতার থেকে অনেক প্রাচীন ঢাকা। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ব্রিটিশরাজের সরাসরি শাসনের প্রথম ১৫০ বছর (১৯০৫ সাল পর্যন্ত) তৎকালীন পূর্ব বাংলা বা বর্তমান বাংলাদেশ নানাভাবে অবহেলিত ছিল।
১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের পর ঢাকা ও পূর্ববঙ্গ কিছুটা স্বাতন্ত্র্য ও উন্নয়নের ছোঁয়া পায়। বঙ্গভঙ্গ রদ হয়ে রাজধানী কলকাতা ফিরে গেলেও পূর্ব বাংলা তার স্বাতন্ত্র্যবোধকে ধারণ করে নতুনভাবে এগোতে থাকে। ১৬১০ সালে সুবেদার ইসলাম খানের রাজমহল থেকে রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তরকে ঢাকার পুনরুত্থান ধরা হলেও খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতক থেকে নানাভাবে ঢাকা এ অঞ্চলের শাসন কেন্দ্র ছিল। ১৭৯০ সালের দিকে জব চার্নকের সুতানুটি, চন্দননগর ও গোবিন্দপুর নিয়ে কলকাতার পত্তন ধরা হলে ঢাকা শহর হিসেবে কলকাতার চেয়ে অনেক প্রাচীন। অবশ্য সে ইতিহাস নিয়ে অনেকের মতভেদ আছে।
১৯১১ সালে দিল্লিতে স্থানান্তরের আগপর্যন্ত কলকাতাই ছিল ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী। সে হিসাবে ভারত সরকারের সব কেন্দ্রীয় স্থাপনা ও দপ্তর কলকাতাতেই স্থাপিত হয়। কলকাতার মহাকরণ, হাইকোর্ট, নানা অফিসের সদর দপ্তর, হেয়াররোডের সরকারি বাসভবন, গড়ের মাঠ, রেলস্টেশন দেখলেই তা বোঝা যায়। ১৯১১ সালের পর থেকে ক্যালকাটা বা কলকাতা শুধু বাংলা, আসামসহ কিছু অঞ্চল ও রাজ্যের রাজধানী। পরে ১৯৪৭ সালের পর থেকে শুধু পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী।
বর্তমান কলকাতা মহানগরী প্রশাসনিকভাবে একদিকে একটি পৃথক জেলা হিসেবে স্বীকৃত। আবার সে একই কলকাতা মহানগরের সেবা-পরিষেবা ব্যবস্থাপনায় কলকাতা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনকে (কেএমসি) একটি একক সংস্থা হিসেবেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। কলকাতা একটি জেলা হলেও এ জেলায় কোনো জেলা শাসক, প্রশাসক, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, কালেক্টর ও জেলা পরিষদ নেই, যা পাশের হাওড়া, চব্বিশ পরগণা ও মেদিনীপুর জেলায় রয়েছে। ২০৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের কেএমসির জনসংখ্যা সাড়ে চার মিলিয়ন।
ঢাকার দুই করপোরেশনের জনসংখ্যা প্রায় ১০ মিলিয়ন। প্রতি বর্গকিলোমিটারের ঢাকার জনসংখ্যা ৩০ থেকে ৩১ হাজার এবং কলকাতায় তা প্রায় ২৪ হাজার। ঢাকার দুই করপোরেশনের মোট ওয়ার্ডসংখ্যা ১২৯ (উ: ৫৪ + দ: ৭৫)। কেএমসির মোট ওয়ার্ড ১৪৪ এবং রয়েছে ১৬টি ব্যুরো কাউন্সিল। মেয়র ছাড়াও একজন ডেপুটি মেয়র এবং মেয়রের নির্বাহী কাউন্সিলে আরও নয়জন সদস্য রয়েছেন, যাঁরা প্রত্যেকে কেন্দ্রীয় বা রাজ্যস্তরের মন্ত্রীর মতো এক বা একাধিক সেবা-পরিষেবা বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত। ঢাকায় কোনো ডেপুটি মেয়র বা ‘মেয়র কাউন্সিল’ নেই। মেয়ররা এককভাবে সবকিছু দেখেন। আঞ্চলিক অফিস থাকলেও কোনো ব্যুরো কাউন্সিল ধরনের আয়োজন নেই।
২০২৪ সালের ৫ দিনের এক সংক্ষিপ্ত ব্যক্তিগত সফরে কলকাতা গিয়ে মহানগরীর সেবা ব্যবস্থাপনার কয়েকটি বিষয় চোখে পড়েছে, যা আমাদের ঢাকা মহানগরের ব্যবস্থাপকেরা একটু ভেবে দেখতে পারেন।
১. কেএমসি কলকাতা জেলার একক সেবা-পরিষেবা সংস্থা হওয়ায় তারা কতিপয় নির্ধারিত সেবার জন্য এককভাবে দায়বদ্ধ। প্রতিটি সেবার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কাউন্সিলর থাকেন এবং ওই ১০ জনের ‘মেয়র কাউন্সিল’–এর বিপরীতে ১০টি স্থায়ী কমিটি থাকে। নাগরিকেরা সেবাবিষয়ক যেকোনো প্রতিকারের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, দায়িত্বপ্রাপ্ত কাউন্সিলর বা স্থায়ী কমিটির সভাপতি—যেকোনো কারও কাছে যেতে পারেন। ঢাকায় সে ব্যবস্থা অনুপস্থিত। বাংলাদেশের কাউন্সিলরা দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসেবে সেবার চেয়ে সালিস-নালিশ ও বিচারে অনেক সময় ব্যয় করেন। কলকাতা বা ভারতের এর নজির খুব কম। সেখানে বিরোধ মীমাংসা ও বিচার-আচার পুলিশ ও আদালতের এখতিয়ার। স্থানীয় সরকারের বিচার বা আদালত বসানোর কোনো এখতিয়ার নেই।
২. কলকাতা শহরের পাঁচ দিনের অবস্থানে কোনো মশা দেখা গেল না। মশারি ছাড়াই ঘুমালাম। ‘রাতে মশা দিনে মাছি,/ এই নিয়ে কলকাতা আছি’—এ কথা এখন আর সত্যি নয়। ম্যাজিকটা কী? উত্তর যা পেলাম, সংক্ষেপে তা হচ্ছে, উত্তম স্যানিটেশন, পরিচ্ছন্নতা ও ড্রেনে মশার প্রজননরোধী ওষুধ প্রয়োগ।
৩. কলকাতা পুলিশ ও পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ—দুই ধরনের পুলিশি ব্যবস্থা কলকাতায় রয়েছে। আমার একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনায় ১০০ নম্বরে পাবলিক কলে কলকাতা পুলিশের সাহায্য চাইলাম। ফোনে ঘটনার একটি বিবরণ নিল এবং পাঁচ মিনিট পরে পুলিশ ফোন করে বলে, আমি যেন অকুলস্থলে থাকি, তারা আসবে। আমি বললাম, আপনাদের আসতে হবে না, আমি নিজেই নিকটস্থ পুলিশ স্টেশনে আসছি। আমি গেলাম, একটি এজাহার দিলাম। ৪০ থেকে ৪৫ মিনিট পর ১ জন এসআই, ১ জন এএসআই, দুজন কনস্টেবল আমাকে গাড়িতে করে নিয়ে ঘটনাস্থলে আসেন এবং পরবর্তী এক ঘণ্টায় বিষয়টি সুরাহা করে তাঁরা প্রস্থান করেন। এত দ্রুত পুলিশি সেবাও আমাকে অভিভূত করেছে।
৪. হোটেল, রেস্তোরাঁ কিংবা স্ট্রিট ফুড—যা–ই বলুন, দাম বাংলাদেশের ঢাকা শহরের তুলনায় সস্তা। স্ট্রিট ফুড, তা ফলের প্লেট কিংবা লুচি-তরকারি, যা–ই বলুন, ৪০ থেকে ৬০ টাকার মধ্যে খাওয়া সারা যায়। বোতলের পানি দরকার হয় না, কলের পানি নিরাপদ। অবশ্য আমরা বাংলাদেশের মানুষ তা সহজে বিশ্বাস করতে পারি না।
৫. কলকাতা শহরে খোলামেলাভাবে হোটেলে-রেস্তোরাঁয় গরুর মাংস পাওয়া যায়, যা ভারতের অন্য অনেক রাজ্যে সম্ভব নয়। দামও নাগালের মধ্যে। সারা দিন লাইসেন্সপ্রাপ্ত দোকানে মদ বিক্রি চলছে। সন্ধ্যার পর তো রীতিমতো লাইন। কিন্তু সড়কে কিংবা অলিগলিতে মাতলামি চোখে পড়েনি।
সম্প্রতি ইউনিয়ন সরকারের নগর গৃহায়ণ মন্ত্রণালয়ের ভারতের এক লাখের ওপর জনসংখ্যা–অধ্যুষিত শহরগুলোর এক জরিপে কলকাতা ভারতের নবম ‘অপরিচ্ছন্ন’ নগর হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম প্রতিবাদে এটিকে কেন্দ্রীয় সরকারের বাংলাকে হেয়প্রতিপন্ন করার অপচেষ্টা হিসেবে অভিহিত করেন।
বাংলাদেশ বা ঢাকার তুলনায় ও দেশে মদ্যপায়ীর সংখ্যা ও হার মনে হলো অনেক বেশি। ফুটপাতে, রাস্তায়, দোকানে—সর্বত্র বাঁ হাতের তালুতে ডান হাতের বুড়ো আঙুল ঘষে ঘষে নেশাজাতীয় একটি বিশেষ জিনিস বানিয়ে সেবন করতে দেখেছি, যা বাংলাদেশে বিরল। সর্বস্তরে মেয়েদের কঠোর পরিশ্রম করতে দেখেছি। নানা জাতের নেশার প্রবণতা পুরুষদের মধ্যেই প্রবল। নিম্ন আয়ের নারীদের অনেকের অভিযোগ, তাঁদের পুরুষেরা নেশা-ভাং খেয়ে আয়ের একটি বড় অংশ ব্যয় করে। এমনকি উপার্জনকারী নারীদের অর্থকড়িতেও তারা হাত দেয়। না দিলে নির্যাতন করে। কিন্তু কর্মজীবী নারীর আয়-উপার্জনের সবটাই সংসারে খরচ হয়।
সারা ভারতের কথা বলা যাবে না, পশ্চিমবঙ্গের মানুষের ভ্রমণনেশাও বেড়েছে। এমনকি ‘কাজের মাসিরা’ও বছর শেষে কিছু টাকা জমিয়ে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার চিন্তা করেন। বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্তের অনেক মেয়ে পশ্চিম বাংলার একই শ্রেণির ব্যবসায়ী ও পেশাজীবী বরের পাণিগ্রহণ করছেন। আসা-যাওয়ার সময় অনেক নারী যাত্রী পেলাম, যাঁরা পশ্চিম বাংলায় স্বধর্মীয় ছেলেদের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ।
সংক্ষিপ্ত এ সফরে চারদিকে চোখ মেলে সব সময় দেখার চেষ্টা করেছি। কিছু বন্ধুবান্ধব ও প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীর আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়েছি। কলকাতা বইমেলা, বেলুড় মঠ, শান্তিনিকেতন এবং হাওড়া জেলা পরিষদও ঘুরে এসেছি। সবখানে অনেক বিষয় দেখেছি, যা থেকে আমাদের কিছু কিছু শেখার আছে; বিশেষত জেলা পরিষদ প্রসঙ্গে বলব। আমাদের স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় বা আমাদের জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানসহ স্থানীয় সরকার নেতারা কি চিকিৎসা, ভ্রমণ বা কেনাকাটার জন্য কলকাতা যান না? তাঁরা ওখানকার জেলা পরিষদ, পঞ্চায়েত সমিতি, গ্রাম পঞ্চায়েত, পৌরসভাগুলো কেন দেখে আসেন না। হাওড়া জেলা পরিষদের সভাধিপতি অজয় ভট্টাচার্যের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে (২০১৬) একটি সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছে। সে সুবাদে ওদিকে গেলেই হাওড়া যাওয়ার চেষ্টা করি। এবারেও গেলাম। প্রতিবারই নতুন কিছু দেখি।
বিভিন্ন বয়সের বহু বাংলাদেশি নারী-পুরুষের সঙ্গে হোটেল, রেস্তোরাঁ, নিউমার্কেটসহ নানা শপিং মলে দেখা হলো। সবারই মূলত দুটি কারণে, কলকাতা যাওয়া। এক. চিকিৎসা, দুই. কেনাকাটা। চিকিৎসা যাঁরা করাচ্ছেন, তাঁরা বললেন, আসা-যাওয়ার পথখরচা, হোটেলে থাকা ও চিকিসার খরচ মিলিয়েও বাংলাদেশের চেয়ে কম বা সমান খরচ। মাঝখানে কেনাকাটা ও বেড়ানো বোনাস। চিকিৎসার গুণগত মান ও সফলতা-বিফলতা সম্পর্ক আমি ভালো বলতে পারব না। তবে প্রচুর মানুষ বাংলাদেশ থেকে যাচ্ছেন। উপকার না পেলে তাঁরা কেন যাবেন?
কম সময়ের এ সফরের আমার সব পর্যবেক্ষণ হয়তো সর্বাংশে সঠিক না–ও হতে পারে, যা দেখলাম বা বুঝলাম, তা দেশের মানুষকে একটু জানানোর চেষ্টা করলাম।
ড. তোফায়েল আহমেদ অধ্যাপক লেখক ও শাসনবিশেষজ্ঞ।