বটতলার বাবুরা গুপী গাইনের গান শুনে খুব ‘সুখ্খ্যাত’ করলেন। তাঁদের উৎসাহ পেয়ে গুপী রাজাকে গান শোনাতে গেল। সূর্য ওঠার আগে রাজার শোবার ঘরের পাশের পাচিল ঘেঁষে আয়েশ করে বসে গুপী গান ধরল, ‘দ্যাখো রে নয়ন মেলে...’। রাজা অতি বিরক্ত হয়ে চোখ রগড়াতে রগড়াতে বললেন, ‘ধরে আনতো ব্যাটাকে!’
রাজার তলব পেয়ে গুপী এল।
—নাম কী?
—আজ্ঞে, আমার নাম গুপী গাইন।
—চেঁচাইছিলি কেনে?
—আমি তো চেঁচাইনি রাজামশাই, গান গাইছিলাম। ভৈরবী রাগিণী।
রাজা ভ্রু কুঁচকে বললেন:
—গান গাইছিলি! তা, সাত সুর জানা আছে? মানে সা রে গা মা. ..
—আজ্ঞে জানি।
—তৃতীয় সুর কী?
গুপী আঙুলের কর গুনে বলল, ‘গা’।
রাজা বললেন, ‘উত্তর সঠিক হয়েছে। এবার বল, ষষ্ঠ সুর কোনটা?’
গুপী আবার আঙুলের কর গুনে বলল, ‘ধা’।
রাজা বললেন, ‘এবার দুটো মিলে কী হয়?’
গুপী বলল, ‘গা আর ধা মিলে হয় “গাধা”’
রাজা বললেন, ‘ওরে কে আছিস, এই গাধাটাকে এখনই গাধার পিঠে চড়িয়ে গাঁয়ের বাইরে বের করে দিয়ে আয়।’
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’-এর সেই গুপীর দশায় পড়েছেন হিরো আলম। ইউটিউব, ফেসবুকের ‘বটতলার বাবুরা’ লাইক, কমেন্ট, শেয়ারের মাধ্যমে তাঁকে বেশুমার ‘সুখ্খ্যাত’ করেছেন। কিন্তু রাজরাজড়াদের কানে সেই গান যাওয়ায় শেষ পর্যন্ত ডিবি কার্যালয়ে তাঁকে তলব করা হয়েছে। সেখানে তাঁর কাছ থেকে মুচলেকা নেওয়া হয়েছে।
ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশিদ জানিয়েছেন, ‘অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি’ হিরো আলমের নামে নালিশ করে বলেছেন—হিরো আলম ফেসবুক, ইউটিউবে যেসব করে বেড়াচ্ছেন, তা মানার মতো না। তিনি রবীন্দ্রসংগীতকে বিকৃত করে গেয়েছেন। কনস্টেবলের পোশাক পরে ডিআইজির চরিত্রে অভিনয় করেছেন। হারুণ অর রশিদ বলেছেন, ‘এগুলো (হিরো আলমের গান) এ দেশের কৃষ্টি–সংস্কৃতির সঙ্গে মিলে না এবং বিকৃত।’ হিরো আলম পুলিশের পোশাক পরে যে অভিনয় করেছেন, তাকে নিয়মে লঙ্ঘন দাবি করে হারুণ বলেছেন, ‘পুলিশের পোশাক পরে অভিনয় করতে হলে অনুমতির প্রয়োজন রয়েছে। হিরো আলম সেটা নেন না। এসব বিষয় নিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে ভুল মেসেজ যায়।’
দীর্ঘ সময় ডিবি অফিসে জেরা শেষে হিরো আলম সেখান থেকে বেরিয়ে এসে বলেছেন, ‘আর কোনো দিন নজরুলগীতি ও রবীন্দ্রসংগীত গাব না।’
নেটাগরিকদের কেউ এটিকে ‘সামান্য ঘটনা’ হিসেবে দেখছেন। কেউ বলছেন, উঁহু, এটা মোটেও সামান্য ঘটনা নয়; এর একটি সমাজতাত্ত্বিক তাৎপর্য আছে।
ফেসবুকারদের একটি বড় অংশ তাঁর ‘রবীন্দ্র-অবমাননা’কে সাংস্কৃতিক দূষণ ও নব্য প্রজন্মের অধঃপতন হিসেবে দেখছেন। আবার কেউ বলছেন, হিরো আলম প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার মূর্ত রূপ। কেউ কেউ তাঁকে অলটারনেটিভ সংস্কৃতির অগ্রদূত বলতেও ছাড়ছেন না। কেউ বলছেন, সমাজে যে ‘অপরিবর্তনযোগ্য’ রবীন্দ্র-ন্যাকামি আছে, তার ওপর হিরো আলম এক সুবিশাল সাবভার্সনের মতো থাপ্পড় মেরেছেন।
অর্থাৎ হিরো আলমের জন্য গালমন্দ ও পিঠ-চাপড়ানি—দুই-ই আছে। তাঁর একদিকে অঢেল নিন্দুক এবং আরেক দিকে বিস্তর অনুগামী। হিরো আলম আসলেই রবীন্দ্রসংগীতের ‘অবমাননা’ করে রাবীন্দ্রিক লোকজনের ‘সাংগীতিক অনুভূতিতে’ আঘাত করেছেন কি না, তা এক বিরাট গবেষণার বিষয় হতে পারে।
বাস্তবতা হলো, আমরা অনেকে এগিয়েছি। জ্ঞানে-গানে-শিক্ষায় এগিয়েছি। কিন্তু আমাদের মধ্যে ‘হিরো আলম’ আছে। রোমান্টিসিজমের মতোই সে উগরে ওঠে। সে এক দুর্নিবার ‘স্পন্টেনিয়াস ওভারফ্লো অব পাওয়ারফুল ফিলিংস’। হিরো আলমের এই থাকাটা লজ্জার কিছু নয়। তাকে ঢেকে রাখার চেষ্টা, যাকে আমরা গালভরা নামে ‘সূক্ষ্ম রুচি’ বলে ডাকি, সেই চেষ্টার মধ্যেই লজ্জা আর সংকীর্ণতা আছে
প্রথমত, হিরো আলম জীবনে কোনো দিন গানের ওস্তাদের কাছে যাননি। যেতে পারেননি। যে বয়সে তাঁর ইশকুলে যাওয়ার কিংবা হারমোনিয়ামে সারগাম সাধার কথা ছিল, সেই বয়সে তাঁকে পেটের পীড়নে রোজগার করতে হয়েছে। তাল, লয়, সুর, উচ্চারণ সম্পর্কে সুশীল মাত্রার ধারণা পেতে যে সুশীল পরিবেশ-প্রতিবেশে থাকতে হয়, তা তাঁর কপালে জোটেনি। ফলে তিনি তাঁর নিজের মুরোদে পাওয়া সুরবোধের সবটা খাটিয়ে গান গেয়ে থাকেন। অর্থাৎ, তিনি প্রকৃত সুর মেনে গাইতে পারেন, কিন্তু ইচ্ছা করে তা না গেয়ে বিকৃতভাবে গান—বিষয়টা মোটেও এমন নয়। আদতে তিনি প্রতিষ্ঠিত সুরে বা উচ্চারণে গাইতেই পারেন না।
এখন একজন মানুষ যদি ফেসবুক বা ইউটিউবের মতো উন্মুক্ত পরিসরে নিজের গাওয়া গান আপলোড করেন, তাহলে তাঁকে ‘সাতসুর জানা আছে?’ জিজ্ঞাসা করা বা ‘গাধার পিঠে চাপিয়ে গাঁ থেকে বের করে দেওয়া’ যাবে কোন আইনে? আজ পর্যন্ত রবীন্দ্রভারতীও রবীন্দ্র-সংস্কৃতি নিয়ে এ ধরনের নীতিপুলিশি করেছে বলে শুনিনি। তাই হিরো আলমকে ডিবি কার্যালয়ে ডেকে নেওয়া ও রবীন্দ্রসংগীত না গাওয়ার মুচলেকা নেওয়া কতটা আইনসিদ্ধ হয়েছে সেই প্রশ্নও তুলেছেন অনেক নেটাগরিক।
এই ফেসবুকের আমলে ‘আমাকে দেখুন’ প্রজন্ম যে ঘোরতর নার্সিসিজমে ডুবে আছে, তা অনেক সময় ‘আমাদের’ দেখিয়ে দিচ্ছে। ‘আমাদের’ মানে মধ্যবিত্ত সুশীলদের। ‘লুঙ্গি বাউলের’ প্যান্ট-শার্ট পরা যে নাতিপুতিরা বাপ–দাদার লুঙ্গি পরা ইতিহাস উন্মোচনে সম্মানহানির অনুভূতিতে কুঁকড়ে যায়, সেই ধোপদুরস্ত ‘ভদ্রসমাজে’ হিরো আলমের জায়গা হওয়ার কথা নয়। কারণ, তাঁর এই অশুদ্ধ ও ‘খ্যাৎ’ উচ্চারণের রবীন্দ্রসংগীতচর্চা প্যান্ট-শার্ট পরা প্রজন্মকে তাঁদের মালকোঁচা মারা ‘বিব্রতকর’ আত্মপরিচয়কে সামনে নিয়ে আসে।
উৎপল দত্তের ‘টিনের তলোয়ার’ নাটকের ময়না চরিত্রটি চাষির মেয়ে। ক্ষুধার তাড়নায় সে কলকাতায় এসে আলু–পটোল বেচত। পরে সে থিয়েটারের ‘হিরোইন’ হয়ে ভারী গয়না জড়ানো ‘সোসাইটি গার্ল’ হয়। গরিব আর ময়লা কাপড় পরা মেয়ে দেখলে সে রেগে যায়। কারণ, তাদের চেহারা তাকে মনে করিয়ে দেয়, সে দরিদ্র চাষির মেয়ে। অথচ সে তা আর মনে করতে চায় না। একসময় যে মেথর মথুর সঙ্গে ময়নার ভাব ছিল, ‘সমাজে প্রতিষ্ঠার পর সে সেই মথুকে বলে, ‘এইখানে দাঁড়িয়ে সবার সামনে তোর সঙ্গে কথা কওয়াটা ভালো দেকায় না।’
সম্ভবত এ মধ্যবিত্তের একটি অংশ সেই ‘ময়না সিনড্রমে’ আক্রান্ত হয়েছে। হিরো আলমের সংগীতচর্চাকে তাদের কাছে নিজেদের ধোপদুরস্ত কাপড়ের আড়াল করে রাখা তালি মারা অংশ মনে হচ্ছে। তালি মারা অংশ বের হলেই তাদের মনে হচ্ছে ‘মান–ইজ্জত সব গেল’।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমরা অনেকে এগিয়েছি। জ্ঞানে-গানে-শিক্ষায় এগিয়েছি। কিন্তু আমাদের মধ্যে ‘হিরো আলম’ আছে। রোমান্টিসিজমের মতোই সে স্বতঃস্ফূর্তভাবে উগরে ওঠে। কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থের ভাষায় সে এক দুর্নিবার ‘স্পন্টেনিয়াস ওভারফ্লো অব পাওয়ারফুল ফিলিংস’। হিরো আলমের এই থাকাটা লজ্জার কিছু নয়। তাকে ঢেকে রাখার চেষ্টা, যাকে আমরা গালভরা নামে ‘সূক্ষ্ম রুচি’ বলে ডাকি, সেই চেষ্টার মধ্যেই লজ্জা আর সংকীর্ণতা আছে। আর যারা ঢাকতে চাই না, তারা বলতেই পারি, ‘...স্পন্দিত বুকে মনে হয় আমিই হিরো আলম’।
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
sarfuddin2003@gmail.com