ইউক্রেন যুদ্ধ যতই তীব্র হচ্ছে, রাশিয়াকে শায়েস্তার জন্য ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের ‘অসম্ভব’ একটা পথ খুঁজে বের করার চেষ্টা ততই বাড়ছে। বৈশ্বিক তেল ও গ্যাস সরবরাহব্যবস্থায় কোনো ধরনের বিঘ্ন হবে না কিংবা দাম আকাশ ছোঁবে না অথচ জ্বালানি বিক্রি থেকে ভ্লাদিমির পুতিনের আয়ের পথ বন্ধ করা যাবে—এমন একটা পথ তারা খুঁজছে। কিন্তু সত্যিই কি কোনো বিকল্প পথ আছে?
সর্বশেষ যে সিদ্ধান্ত নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, তা হলো রাশিয়ার তেল কেনার ওপর প্রাইস ক্যাপ (সর্বনিম্ন মূল্য বেঁধে দেওয়া) বসানো। অথচ এ থেকে কিছুটা কার্যকর একটা পরিকল্পনা আছে, তবে সেটা সেভাবে আলোচনায় আসছে না।
গত ৩১ মে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২০২২ সালের পর রাশিয়া থেকে পরিশোধিত কিংবা অপরিশোধিত কোনো ধরনের পেট্রোলিয়াম পণ্য আর আমদানি করবে না; এ-সংক্রান্ত একটি চুক্তিতে পৌঁছায়। ইউরোপ তার পূর্ব দিকের প্রতিবেশী রাশিয়া থেকে সমুদ্রপথে জাহাজে করে দুই-তৃতীয়াংশ জ্বালানি আমদানি করে। সেটা তারা বন্ধ করে দিতে চায়। পোল্যান্ড ও জার্মানিও পাইপলাইনের মাধ্যমে জ্বালানি আমদানি বন্ধ করতে সম্মত হয়েছে। এই দুটি সিদ্ধান্ত যদি বাস্তবায়িত হয়, তাহলে রাশিয়ার জ্বালানি ইউরোপে প্রবেশে একটি পথই খোলা থাকবে। সেটা হলো দক্ষিণ দিকের দ্রুজবা পাইপলাইন। এই পাইপলাইন দিয়ে স্লোভাকিয়া, চেক রিপাবলিক এবং ক্রেমলিন-সমর্থিত হাঙ্গেরিতে জ্বালানি সরবরাহ হয়।
গত বছর রাশিয়ার ৫৬ শতাংশ অপরিশোধিত ও ৭০ শতাংশ শোধিত পেট্রোলিয়াম পণ্য পশ্চিমা দেশগুলোতে রপ্তানি হয়েছিল। এর সিংহভাগ আমদানি হয়েছে জার্মানি, নেদারল্যান্ডস ও পোল্যান্ডে। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ব্রিটেন ও অস্ট্রেলিয়া রাশিয়া থেকে সামান্য পরিমাণ তেল আমদানি করে। এ দেশগুলোও রাশিয়া থেকে তেল আমদানি বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে। পশ্চিমা ক্রেতারা যখন রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধ করছে, রাশিয়া তখন তার তেলের বাজার এশিয়াতে সম্প্রসারণ করছে। বিশেষ করে ভারতে। এর আগে রাশিয়ার জ্বালানির প্রধান ক্রেতার তালিকায় ভারত ছিল না। রাশিয়া এখন চীনেও তাদের জ্বালানি বিক্রি কিছুটা বাড়িয়েছে।
যে পথ অনুসরণ করা হোক না কেন, তাতে তেল উৎপাদক দেশগুলোর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়বেই। বর্তমানে মস্কো পেট্রোলিয়াম উৎপাদক ও রপ্তানিকারক দেশগুলোর সঙ্গে সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছে। রাশিয়ার তেলের ওপর পশ্চিমাদের সরাসরি নিষেধাজ্ঞায় মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোকে লাভবান করবে।
এশিয়ায় জ্বালানি বিক্রি বাড়াতে রাশিয়া ব্যারেল প্রতি ৩০ মার্কিন ডলার পর্যন্ত ছাড়ের ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু দাম এতটাই বেড়ে গেছে (মার্চ থেকেই ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলারে উঠে গেছে) যে যুদ্ধ শুরুর আগেই রাশিয়া জ্বালানি রপ্তানি করে বিপুল আয় করে ফেলেছে। গত বছরের প্রথম চার মাসের তুলনায় এ বছরের প্রথম চার মাসে তেল রপ্তানি করে ৫০ শতাংশ বেশি আয় করেছে রাশিয়া।
আপাতত এশিয়ায় রাশিয়ার নতুন বাজারকে নিরাপদ বলে মনে হচ্ছে। পশ্চিমারা যদি এশিয়ার বাজারে সমুদ্রপথে রাশিয়ার জ্বালানি আসার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা দেয়, তাহলে ভারতের মতো আমদানিকারকদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হবে। এটা এড়াতে গেলে ইরান ও ভেনেজুয়েলার তেলের ওপর কয়েক বছর ধরে যে নিষেধাজ্ঞা চলছে সেটা তুলে নিতে হবে। না হলে এখন বিশ্বে তেলের দাম যতটা উঁচুতে উঠেছে, সেটাকে আরও উঁচুতে উঠতে দেওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।
রাশিয়ার জ্বালানি নিয়ে বর্তমান অচলাবস্থা বৈশ্বিক মহামন্দা ডেকে আনতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও ইউরোপের অনেক দেশের সরকারপ্রধানদের নির্বাচনী ভাগ্য তাতে বিপদাপন্ন হতে পারে। এতে রাশিয়া যে পশ্চিমাদের ওপর রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করেছে, সেটা স্বীকার করে নিতে হবে। আগে থেকেই বিপদ আঁচ করতে পেরে পশ্চিমাদের মিত্রদেশ জাপান আরও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার জোর দাবি জানিয়েছে।
গত মাসে জার্মানিতে অনুষ্ঠিত জি-৭ সম্মেলনে সরকারপ্রধানেরা রাশিয়ার তেল যাতে নির্দিষ্ট একটা দামের ওপরে আমদানিকারকেরা কেনে, সে জন্য ‘প্রাইস ক্যাপ’ বসানোর ব্যাপারে আলোচনা করেছে। ব্যারেলপ্রতি সর্বনিম্ন দাম ৪০-৬০ ডলার করা হতে পারে বলে শোনা যাচ্ছে। কিন্তু এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হলে বেশ কিছু সমস্যা মোকাবিলা করতে হবে।
প্রথমত, ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার তেল-গ্যাসের ওপর যে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেটা নতুন করে পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে। অনেক তর্ক-বিতর্ক, আলাপ-আলোচনা শ্রমসাধ্য প্রচেষ্টার পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন ঐকমত্যে আসতে সক্ষম হয়। দ্বিতীয়ত, রাশিয়ার তেলের ওপর প্রস্তাবিত ‘প্রাইস ক্যাপ’ অনেক বেশি। রাশিয়ার কোম্পানিগুলোর এক ব্যারেল তেল উৎপাদনের জন্য খরচ হয় ২০ ডলারের একটু বেশি। দেশটির সরকার তেল কোম্পানিগুলোর ওপর উচ্চ কর আরোপ করার পর তেলের দাম হয় ২৫ ডলারের মতো। তৃতীয়ত, ১৯৯০-এর দশকে ইরাকে ‘তেলের বিনিময়ে খাদ্য’ কর্মসূচির ক্ষেত্রে প্রাইস ক্যাপ বসানো হয়েছিল। কিন্তু সেটা টেবিলের নিচের লেনদেনের ক্ষেত্র তৈরি করেছিল। প্রাইস ক্যাপ বসানো হলে রাশিয়া তার ভূরাজনৈতিক স্বার্থে তেল বিক্রির ক্ষেত্রে ‘ভাগ করো ও শাসন করো’ নীতিতে এগোবে। চতুর্থত, তেল রপ্তানি রাশিয়া নিজ থেকেই কমিয়ে দিতে পারে। ইউরোপে গ্যাস রপ্তানির ক্ষেত্রে এরই মধ্যে রাশিয়া এই কৌশলটির প্রয়োগ শুরু করেছে। রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ জাপানকে সতর্ক করে দিয়েছেন যে প্রাইস ক্যাপ বসানোর প্রস্তাবে সমর্থন দিলে তাহলে জাপানে তেল সরবরাহ কমিয়ে দেবে রাশিয়া। তাতে জাপানে ব্যারেলপ্রতি তেলের দাম ৩০০-৪০০ ডলারে গিয়ে ঠেকবে।
হার্ভার্ডের অর্থনীতিবিদ ও ভেনেজুয়েলা সরকারের সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী রিকার্ডো হাউসম্যান, হার্ভার্ডে রাশিয়ান পণ্ডিত ক্রেইগ কেনেডি, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী জ্যানেট ইয়েলেনসহ বেশ কয়েকজন মিলে একটি বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছেন। সেটা হলো রাশিয়ার তেলের ওপর উঁচু শুল্ক আরোপ করা। সেটা প্রতারিত হওয়ার হাত থেকে ক্রেতাদের রক্ষা করবে। যে পথ অনুসরণ করা হোক না কেন, তাতে তেল উৎপাদক দেশগুলোর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়বেই। বর্তমানে মস্কো পেট্রোলিয়াম উৎপাদক ও রপ্তানিকারক দেশগুলোর সঙ্গে সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছে। রাশিয়ার তেলের ওপর পশ্চিমাদের সরাসরি নিষেধাজ্ঞায় মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোকে লাভবান করবে।
প্রাইস ক্যাপ বসানো কিংবা শুল্ক আরোপ তখনই কার্যকর হবে, যখন রাশিয়া প্রতিশোধ না নিয়ে চুপ করে সেটা মেনে নেবে। কিন্তু জ্বালানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এখনই মস্কো বাজে খেলা খেলতে শুরু করেছে। তবে দীর্ঘ মেয়াদে বিবেচনা রাশিয়ার তেল উৎপাদন একসময় কমে যাবে। তখন উপসাগরীয় তেল উৎপাদকদের তুলনায় রাশিয়ার অবস্থান দুর্বল হবে। দেশগুলো তেল উৎপাদন বাড়ানোর সুযোগ পাবে।
জ্বালানি তেলের দামের তেজি ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরার চেষ্টায় মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে পশ্চিমের। মধ্যপ্রাচ্যের রপ্তানিকারকেরা নিরাপদ দূরত্বে বসে পরিস্থিতির দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখছে।
রবিন মিলস দ্য মিথ অব দ্য ওয়েল ক্রাইসিস বইয়ের লেখক
এশিয়া টাইমস থেকে, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে