দুর্নীতির দুষ্টচক্র ভাঙতে ব্যর্থ কেন দুদক

সম্প্রতি মাননীয় প্রধান বিচারপতি আইনজীবীদের এক অনুষ্ঠানে বলেন, রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গের প্রতি জনগণের আস্থা দৃঢ় করতে হলে দুর্নীতির সামান্যতম সংস্রব থেকে সবাইকে দূরে থাকতে হবে। তিনি বলেছেন, ‘দুর্নীতি এমন একটি ক্যানসার, যা গণতন্ত্রকে নষ্ট করে, দেশকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়, রাষ্ট্রের ভিত্তি দুর্বল করে দেয়, জনগণকে বিক্ষুব্ধ করে, জন্ম দেয় ক্রোধের।’ (প্রথম আলো, ২৮ নভেম্বর ২০২২)। এ বক্তব্য দেশ, জাতি ও সমাজের সবার প্রতি অতি জরুরি একটি সতর্কবার্তা, একটি উদাত্ত আহ্বান ও গভীর সমাজ পর্যবেক্ষণ। এ আহ্বান সর্বজনীনভাবে সরকারের সব অঙ্গ আইন, নির্বাহী ও বিচার বিভাগ—সবাইকে স্পর্শ করেছে।

দুর্নীতি ও দুদক: বৈশ্বিক ও জাতীয় চিত্র

অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ ধীরে ধীরে প্রতিকারবিহীন অপ্রতিরোধ্য একটি দুর্নীতিপ্রবণ দেশ ও সমাজের দিকে ধাবিত হচ্ছে। অনেক তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪ পাস হয় এবং বিচারপতি সুলতান হোসেন খানকে চেয়ারম্যান করে প্রথম কমিশন গঠিত হয়। তাঁরা প্রায় নিষ্ক্রিয় থেকেই কর্মকাল শেষ করেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে জেনারেল হাসান মশহুদ চৌধূরীর নেতৃত্বে জেগে ওঠে দুদক এবং তাদের অতি সক্রিয়তায় চারদিকে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। গলি-ঘুপচিতে মালিকানাবিহীন অনেক গাড়ি পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। বড় দুই রাজনৈতিক দলের প্রধান দুই নেতৃত্বসহ অনেক নেতা ও সাবেক মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে মামলা এবং তাঁদের গ্রেপ্তার হতে দেখা যায়। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের অনেকে অনেক রকমের বয়ান দেন। অনেকে গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে যান এবং অনেকে প্রায় খাটিয়ায় শুয়ে চিকিৎসার্থে বিদেশে গমন করেন। ২০০৯-এর নির্বাচনের পর সে ‘আতঙ্ককালের’ অবসান ঘটে। নবগঠিত সরকার প্রায় সাত হাজার মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করে। আবার অনেকের মামলা চালু থাকে এবং নির্দিষ্ট ও নির্বাচিত কিছু মামলায় সাজাও হয়। এখানে রাজনীতির পটপরিবর্তনের সঙ্গে দুর্নীতি দমন ও দুদকের কার্যকারিতার একটি গভীর যোগসূত্র পাওয়া যায়।

বিভিন্ন চেয়ারম্যানের সময় দুদক নানা অভিধায় বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হয়। গোলাম রহমানের সময় ‘নখ-দাঁত’ ও ‘মেরুদণ্ড’, ইকবাল মাহমুদের সময় ‘দায়মুক্তি’, তা ছাড়া সর্বসময়ে ‘রাঘব বোয়াল ও চুনোপুঁটি’ প্রসঙ্গ জোরেশোরে উঠতে থাকে। এখন চেয়ারম্যান বা কমিশনারদের আর জনসম্মুখে কথা বলতে দেখা যায় না। কথা যা বলার, দুদকের আইন উপদেষ্টারাই বলেন। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের যে নম্বর প্রাপ্তি, তাতে বড় ধরনের অগ্রগতি নেই। ২০০০/২০০১ সালে ছিল দশের (১০) মধ্যে ১.১। তা একটু একটু করে বাড়তে থাকে এবং ২০০৫ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত ২-এ এসে স্থির হয়। ২০১০ থেকে ২০২১ পর্যন্ত ২.৬-এ উপনীত হয়েছে, কিন্তু ১৮০ দেশের মধ্যে আমাদের অবস্থান এখনো ১৪৭। প্রথম স্থানে থাকা নিউজিল্যান্ড ও ডেনমার্কের স্কোর ৮.৮-৯.৬-এর মধ্যে ওঠানামা করছে।

জাতীয়ভাবে দুর্নীতির উন্নতি-অবনতির কোনো নির্ভরযোগ্য মূল্যায়ন নেই। টিআইবি (বাংলাদেশ) কিছু বাছাইকৃত গবেষণা করে থাকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর তা প্রত্যাখ্যান করে। একবার শুধু স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরকে (এলজিইডি) দেখেছিলাম, তারা টিআইবির সঙ্গে বৈঠক করে সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেছিল।

আন্তর্জাতিকভাবে আমরা আমাদের অবস্থানের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করতে পারিনি। এশিয়ার এ অঞ্চলে আমরা শুধু ধারাবাহিকভাবে আফগানিস্তানের ওপরে অবস্থান করি।

দুর্নীতির টালমাটাল সাগরে ছোট্ট একটি তরি দুদক। সরকারের প্রতিটি দপ্তরপ্রধানের তাঁর নিজ দপ্তরের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব রয়েছে। মন্ত্রণালয়, দপ্তর, অধিদপ্তর, পরিদপ্তর, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলো নিজ উদ্যোগে নিজ নিজ দপ্তরের দুর্নীতি কতটুকু হ্রাস করতে উদ্যোগী হয়েছে, তার বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন প্রয়োজন।

শুধু দুদকই দুর্নীতির সর্বব্যাধি নিবারক নয়

দুর্নীতির টালমাটাল সাগরে ছোট্ট একটি তরি দুদক। সরকারের প্রতিটি দপ্তরপ্রধানের তাঁর নিজ দপ্তরের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব রয়েছে। মন্ত্রণালয়, দপ্তর, অধিদপ্তর, পরিদপ্তর, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলো নিজ উদ্যোগে নিজ নিজ দপ্তরের দুর্নীতি কতটুকু হ্রাস করতে উদ্যোগী হয়েছে, তার বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন প্রয়োজন। প্রতিবছর প্রতিটি দপ্তরে ‘জাতীয় শুদ্ধাচার’ পুরস্কার দেওয়া হয়, কিন্তু দুরাচারের তিরস্কার করা হয় না। দুদকের মতো জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বাংলাদেশ ব্যাংক, বিচার বিভাগ ও পুলিশেরও বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। বিচার বিভাগ মাঝেমধ্যে সোচ্চার হলেও বাকিদের ভূমিকায় জাতি হতাশ।

দুর্নীতি মূলত জড়িত সব পক্ষের সুযোগ-সুবিধার (উইন-উইন অবস্থান) সম্মিলন। এখানে বহুজনের বহুবিদ প্রাপ্তি। ক্ষতি শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষের। তাই সাধারণ মানুষকেও দুর্নীতি প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে হবে। জনবান্ধব সরকারি কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের একইভাবে এগিয়ে আসতে হবে।

তোফায়েল আহমেদ শিক্ষাবিদ, গবেষক ও স্থানীয় শাসনবিশেষজ্ঞ