একসময় উঁচু পদে বড় মাপের মানুষেরা আসীন হতেন। তাঁদের দৈহিক গঠন যা-ই হোক না কেন, বিবেক-বিবেচনায়, চিন্তায়-মননে, দেশপ্রেমে ও দক্ষতায় তাঁরা ছিলেন বড় মাপের মানুষ। ধীরে ধীরে এ অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। ‘খাটো’ মানুষেরাই এখন উঁচু পদে আসীন হচ্ছেন। এখন উঁচু পদে বড় মাপের মানুষ পাওয়াই দায়।
কেমন ছিলেন উঁচু পদের বড় মাপের মানুষেরা? আর কেনই-বা খাটো মানুষেরা এখন উঁচু পদে আসীন হচ্ছেন? এই আপাত–সরল দুটি প্রশ্ন নিয়েই আজকের নিবন্ধের অবতারণা।
বিচার বিভাগ নিয়েই শুরু করি। কারণ, তাঁরাই তো শিরোমণি। তাঁরাই তো ন্যায় ও অন্যায়ের বিচার করবেন।
অনিয়মিত হলেও দীর্ঘদিন ধরে গুলশান লেক পার্কে হাঁটাহাঁটি করি। প্রায় এক যুগ আগে একদিন হাঁটতে গিয়ে দেখি, পক্বকেশ একজন প্রবীণ আমার আগে আগে একাকী হাঁটছেন। আমি তখন সবেগে হাঁটতাম। তাঁকে পার হতে গিয়ে সালাম দিই এবং একটু থেমে দেখি, তিনি সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামাল।
ব্যক্তিগত পরিচয় দিয়ে গতি থামিয়ে তাঁর সঙ্গে হাঁটতে থাকি। অপরিচিত বা স্বল্প পরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে কথা শুরু করার জন্য সবচেয়ে নিরাপদ বিষয় হলো আবহাওয়া। তখন শীতকাল, খানিক আগে একপশলা বৃষ্টি হয়েছে।
আমি তাই অকালবৃষ্টি নিয়ে কথা শুরু করি। জবাবে তিনি অকালবৃষ্টির সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে একের পর এক খনার বচন উল্লেখ করতে থাকেন। দুটি এখনো মনে আছে। ‘যদি বর্ষে পৌষে, কড়ি হয় তুষে।’ অর্থাৎ পৌষে বৃষ্টি হলে অঘ্রানে ওঠা ধান থেকে চাল উৎপাদন বিলম্বিত হয়। চাহিদা বাড়ে, পাল্লা দিয়ে চালের দামও বাড়ে। এ পরিস্থিতিতে তুষ বেচেও নাকি টাকা পাওয়া যায়। আবার ‘যদি না হয় আগনে পানি, কাঁঠাল হয় টানাটানি।’
অর্থাৎ অঘ্রানের বৃষ্টি নাকি কাঁঠালের জন্য উপকারী। তিনি প্রতিটি খনার বচনের সামাজিক, অর্থনৈতিক, এমনকি আবহাওয়াবিজ্ঞানের ব্যাখ্যা দিতেন। সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামালকে আমি স্যার না বলে বুজুর্গ বলে সম্বোধন করতাম। প্রায় দিন হাঁটতে হাঁটতে বিভিন্ন বিষয়ে বুজুর্গদের নিয়ে কথা হয়।
একদিন তিনি কথা বলেন গ্রিক জ্যোতির্বিজ্ঞানী ক্লডিয়াস টলেমি ও মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানী ইবনুল হিশামকে নিয়ে। এভাবে আলোচনা চলতে থাকে গ্রিক ও আরব দার্শনিক, রাষ্ট্র ও সমাজবিজ্ঞানীদের সম্পর্কে।
সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামালের কাছ থেকেই আমি প্রথম জানতে পারি, আধুনিক হাসপাতালের শুরু হয় মুসলমানদের হাতে। এভাবে আমি নিজের হাঁটার দিক ও গতি পরিবর্তন করে তাঁর সঙ্গে হাঁটার সুযোগে অনেক কিছুই জানতে পারি। আমার দুর্ভাগ্য, কিছুদিন পর তিনি অসুস্থ হওয়ায় পার্কে আসা বন্ধ করেন এবং আমি এই চলমান এনসাইক্লোপিডিয়া থেকে জ্ঞান আহরণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হই।
আমাদের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা এখন গোত্রের শাসনে পর্যবসিত হয়েছে। এ গোত্র শাসনের অধিপতিরা হচ্ছেন দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিবিদ ও এক দল অসাধু ব্যবসায়ী। তাঁদের সঙ্গে যোগ হয়েছেন একশ্রেণির শিক্ষক, সামরিক, বেসামরিক, পুলিশ, রাজস্ব বিচার ও ব্যাংক কর্মকর্তারা। তাঁরাই তাঁদের পছন্দের কুশীলবদের টেনে তুলে উচ্চ পদে আসীন করেন, যাতে গোত্রস্বার্থ রক্ষিত হয়।
একবার এক ছুটির দিন সকালে আমরা গিয়েছিলাম বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের (পরে প্রধান বিচারপতি) হেয়ার রোডের বাসায় চাকরিসংক্রান্ত একটা মামলা করব কি না, সে বিষয়ে পরামর্শের জন্য। ডুপ্লেক্স সরকারি বাড়ির দোতলা থেকে সাদামাটা লুঙ্গি ও সাদা পাঞ্জাবি পরে তিনি নেমে এলেন। ভবিষ্যতে এ মামলা বিষয়ে প্রভাবিত হতে পারেন, তাই বিষয়টি সম্পর্কে কোনো আলোচনাই করতে তিনি রাজি হলেন না।
তবে আমরা বেইলি রোডে নাটক দেখে ফিরছি জেনে চা-ডালপুরি খেতে খেতে বাংলার নাট্য-ঐতিহ্য নিয়ে প্রায় এক ঘণ্টা কথা হয়। তাঁর কাছ থেকে জানতে পারি, আবহমান বাংলার ঐতিহ্যিক নাট্যরীতি মূলত নৃত্য-গীত-কাহিনি-অভিনয় ও দৃশ্যকল্পের সুষম বিন্যাস। চারদিক দর্শকবেষ্টিত মধ্যমঞ্চ তার প্রধানতম উপস্থাপন-কৌশল। আরও জানতে পারি যাত্রাপালা, রামলীলা, নটপালা, কালীকাচ, বিষহরির পালা, জারিগান, কিচ্ছাগান, বিচ্ছেদি গান, গম্ভীরা, সংযাত্রা, কবিগান, বিচারগান ও পুতুলনাচ সম্পর্কে।
আগে উচ্চ আদালতের বিচারকদের সামনে দাঁড়াতেই ভক্তি ও শ্রদ্ধায় মানুষ নুয়ে পড়ত। আর এখন বিচার বিভাগে দলাদলির কথা শুনি। কেউ কি জানে, বিচারপতি মোস্তফা কামাল বা মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান কোনো দল করতেন!
চাকরিজীবনের শুরুতেই সিভিল অফিসার্স ট্রেনিং একাডেমিতে (কোটা) দেখা মিলল খালিদ শামসের, যিনি ছিলেন একাধারে দীর্ঘদেহী ও বড় মাপের মানুষ। তারপর একে একে দেখা মিলেছে মোশাররফ হোসেন সিএসপি, শেগুফতা বখশ চৌধুরী, চৌধুরী এ কে এম আমিনুল হক, নুরুল হোসাইন খান প্রমুখের সঙ্গে।
তাঁদের কেউ কেউ গুরুগম্ভীর হলেও তাঁরা অসামাজিক ছিলেন না। মনে পড়ে, ছুটির পরে সরকারি কাজে ঢাকা ক্লাবে কয়েকবার দেখা করেছি সিএসপি সচিব নাসিম উদ্দিন ও আজিম উদ্দিন ভ্রাতৃদ্বয়ের সঙ্গে। তবে কখনোই তাঁদের সঙ্গী হতে দেখিনি কোনো বিতর্কিত ব্যবসায়ীকে। তাঁদের সঙ্গী হতে দেখেছি পররাষ্ট্রসচিব আবুল আহসান ও চারুকলার এক অধ্যাপককে। তবে শারীরিক গঠন নির্বিশেষে তাঁরা সবাই ছিলেন উঁচু পদে বড় মাপের মানুষ।
আমরা যখন সরকারি চাকরিতে যোগ দিই, তখন আইজিপি ছিলেন এ বি এম জি কিবরিয়া। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে তিনি পুলিশের চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন। আমাদের ব্যাচের পুলিশ সার্ভিসে যোগদানকারী কর্মকর্তাদের মধ্যে ছিলেন মাহমুদুল হক। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে যোগ দেন এবং আবার সেখানেই ফিরে যান।
আমাদের ব্যাচের আরেক আইজিপি খোদা বক্সের মুখে শুনেছি, সারদা একাডেমিতে আইজিপি কিবরিয়াকে নতুন প্রশিক্ষণার্থীদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে তদানীন্তন প্রিন্সিপাল বলেন, ‘দে আর ভেরি ব্রিলিয়ান্ট স্যার, ওয়ান অব দেম ওয়াজ আ ইউনিভার্সিটি টিচার।’
দ্বিতীয়বার প্রিন্সিপাল একই বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করলে আইজিপি কিবরিয়া বলেন, ‘অ্যাজ প্রিন্সিপাল অব দ্য একাডেমি ইউ শুড নো বেটার, দ্যাট হ্যাজ অলওয়েজ দ্য স্ট্যান্ডার্ড অব রিক্রুটমেন্ট ইন দ্য সার্ভিস।’
বলা বাহুল্য, আগের আইজিপি এ বি এম জি কিবরিয়া বা এ এস এম শাহজাহান ছিলেন উঁচু পদে বড় মাপের মানুষ।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য হিসেবে পেয়েছিলাম সততার প্রতিমূর্তি শাহ আবদুল হান্নান ও মনজুর মান্নানকে, যাঁরা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে দুর্বৃত্তদের দ্বারা আক্রান্ত হলেও সরকারের রাজস্ব স্বার্থ বিষয়ে ছাড় দেননি।
দেখা মিলেছে সদস্য (আয়কর) ইফতেখার আহমদের, যিনি নীলক্ষেত থেকে পুরোনো নিউইয়র্কার ম্যাগাজিন কিনে তাঁর পাঠ শেষে আমাকে পড়তে দিতেন। দুর্নীতি ছিল তাঁদের কল্পনারও বাইরে। তাঁরা সবাই ছিলেন উঁচু পদে বড় মাপের মানুষ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে দেখেছি রাশভারী শেগুফতা বখশ চৌধুরীকে। এমনকি বেসরকারি ব্যাংক থেকে আসা লুৎফর রহমান সরকারকেও। তিনি দুর্বৃত্তদের দ্বারা নিজ দপ্তরে আক্রান্ত হলেও নীতির প্রশ্নে আপস করেননি।
এরপর দেখেছি যথাক্রমে তিন পিএইচডি গভর্নর ফরাসউদ্দিন, ফখরুদ্দীন আহমদ ও সালেহউদ্দিন আহমেদকে। তাঁদের মধ্যে কারও কারও রাজনৈতিক অবস্থান থাকলেও তিনজনই ছিলেন পেশাদার এবং তাঁদের পিএইচডি ডিগ্রিগুলোও ছিল পড়াশোনা ও গবেষণার মাধ্যমে অর্জিত।
এবার কেনই-বা খাটো মানুষেরা এখন উঁচু পদে আসীন হচ্ছেন, সে প্রশ্নে আসি।
আমাদের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা এখন গোত্রের শাসনে পর্যবসিত হয়েছে। এ গোত্র শাসনের অধিপতিরা হচ্ছেন দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিবিদ ও এক দল অসাধু ব্যবসায়ী। তাঁদের সঙ্গে যোগ হয়েছেন একশ্রেণির শিক্ষক, সামরিক, বেসামরিক, পুলিশ, রাজস্ব বিচার ও ব্যাংক কর্মকর্তারা। তাঁরাই তাঁদের পছন্দের কুশীলবদের টেনে তুলে উচ্চ পদে আসীন করেন, যাতে গোত্রস্বার্থ রক্ষিত হয়।
ফলে দুর্নীতি একটি সংক্রামক ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে, আর্থিক ও সামাজিক ব্যবস্থাপনায় ধস নেমেছে, সর্বোপরি জনস্বার্থ হয়েছে ভূলুণ্ঠিত। জাতীয় অস্তিত্বের স্বার্থে আমাদের আগের মতো উঁচু পদে বড় মাপের মানুষদের ফিরিয়ে আনতে হবে। আজিজ-বেনজীর-মতিউর মহামারির এটাই একমাত্র প্রতিষেধক।
● মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সাবেক সচিব ও অর্থনীতিবিদ