দেশের অর্থমন্ত্রী ও গভর্নরের জন্য সামনে এখন অনেক চ্যালেঞ্জ। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার ওপরেই নির্ভর করছে ইতিহাসে কার স্থান কোথায় হবে।
একজন অর্থমন্ত্রী বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নরকে কখন খারাপ বা ভালো বলা হয়। কী করলে তাঁরা সফল, আর না পারলে ব্যর্থ। এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া খানিকটা সহজ। কারণ, তাঁদের দুজনেরই দৃশ্যমান ও নির্দিষ্ট কিছু কাজ থাকে।
উদাহরণ দিয়ে বলা যাক। অর্থনীতির ইতিহাসে নিকৃষ্ট কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নরের প্রসঙ্গে এলেই সবাই একবাক্যে বলেন আর্থার ফ্রাঙ্ক বার্নসের কথা। প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের সময়ে তিনি মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক-ব্যবস্থা ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের (ফেড) চেয়ারম্যান ছিলেন। অর্থনীতিবিদ হিসেবেও আর্থার বার্নসের সুনাম ছিল। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ মিলটন ফ্রিডম্যান এবং ফেডের আরেক চেয়ারম্যান অ্যালান গ্রিনস্প্যান তাঁরই ছাত্র ছিলেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বিশ্ব অর্থনীতি ও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে কঠিন সময় ছিল পুরো সত্তরের দশক। উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই সময়কাল ছিল ১৯৮২ সাল পর্যন্ত। এই সময়টাকে বলা হয় ‘দ্য গ্রেট ইনফ্লেশন’। ‘স্ট্যাগফ্লেশন’-এর অভিজ্ঞতাও বিশ্ব পায় সে সময়েই। অর্থাৎ উচ্চ মূল্যস্ফীতি আর নিম্ন বিনিয়োগ—সবকিছুর জন্যই দায়ী করা হয় আর্থার বার্নসকে। ১৯৭০ সালে তিনি দায়িত্ব নেওয়ার আগে থেকেই মূল্যস্ফীতি বেশি ছিল। একজন কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নর সে অবস্থায় মুদ্রানীতি ব্যবহার করে সুদহার বাড়াবেন সেটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু আর্থার বার্নস করেছিলেন উল্টোটা। এতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি আরও দীর্ঘস্থায়ী হয়।
রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে অর্থনৈতিক নীতি নিলে ফল কী, তারও বড় উদাহরণ আর্থার বার্নস। সামনেই ছিল মধ্যবর্তী নির্বাচন। নিক্সনের রিপাবলিকান পার্টির অবস্থা মোটেই ভালো ছিল না। ব্যবসায়ীদের খুশি রাখতে সে সময় নিক্সনই বার্নসকে বাধ্য করেছিলেন সুদের হার কমাতে। নিক্সন জনতুষ্ট নীতি চেয়েছিলেন, আর্থার বার্নস সেটাই করে দিয়েছিলেন।
আর্থার বার্নস নিয়মিত ডায়েরি লিখতেন। বিশেষ করে ১৯৬৯ থেকে শুরু করে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত সময়ে নিক্সনের সঙ্গে যত ধরনের কথাবার্তা হয়েছে, তা তিনি লিখে রেখেছিলেন। ইনসাইড দ্য নিক্সন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন: দ্য সিক্রেট ডায়েরি অব আর্থার বার্নস, ১৯৬৯-৭৪ বইটি প্রকাশিত হয় ২০১০ সালে। সেখানে বর্ণনা আছে কীভাবে নিক্সন তাঁকে নানা জনতুষ্টিমূলক নীতি নিতে বাধ্য করেছিলেন।
যেমন ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে শুরুর দিকে তাঁর একটি বক্তৃতা দেওয়ার কথা ছিল লস অ্যাঞ্জেলেসের একটি কলেজে। তিনি ওয়াশিংটনে অফিসে বসে সেই বক্তৃতা লিখছিলেন। বিষয় ছিল মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, সুদহার বৃদ্ধি ইত্যাদি। বক্তৃতা লেখা শেষ করে যেদিন তিনি উড়োজাহাজে উঠবেন, সেদিনই ফোন করেছিলেন নিক্সন। ফোনে পরিষ্কারভাবে বলেছিলেন, ‘আমার প্রকাশ্যে বিরোধিতা করে আমাকে অতিক্রম করার চেষ্টা কোরো না।’ নিক্সনকে অতিক্রম করার সাহস আর্থার বার্নস করতে পারেননি বলেই ইতিহাস তাঁকে ক্ষমা করেনি। ইতিহাস নিক্সনকেও ক্ষমা করেনি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা নিয়ে নিক্সনের আরেকটি কথা এখনো উদাহরণ হয়ে আছে। আর্থার বার্নসের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে নিক্সন কৌতুক করে বলেছিলেন, ‘আমি তাঁর স্বাধীনতাকে সম্মান করি। তবে আমি আশা করব তিনি স্বাধীনভাবে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হবেন যে আমার মতামতগুলোই অনুসরণ করা উচিত।’ নিক্সন যে নিছক কৌতুক করে কথাটা বলেননি, তার সাক্ষী ইতিহাস।
আর্থার বার্নসের ওপর অবশ্য কৃতজ্ঞ থাকাই উচিত। কেননা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে আধুনিক অর্থব্যবস্থায় একজন কেন্দ্রীয় গভর্নরের কী কাজ, সেটি তিনি বেশ ভালোভাবে বুঝিয়ে দিতে পেরেছেন। তিনি দায়িত্বে ছিলেন ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত। এর পরের প্রায় পাঁচ দশকে কেন্দ্রীয় গভর্নররা আর্থার বার্নস যা করতে পারেননি, মূলত সেটাই করতে চেয়েছেন। যাঁরা পেরেছেন, তাঁরাই সফল, অন্যরা ব্যর্থ। আর সেই কাজটা হলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। যেহেতু মুদ্রানীতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিষয়, সুতরাং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মূল কাজটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরই। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আরেকটি প্রধান কাজ হচ্ছে মুদ্রার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখা।
তবে নিকৃষ্ট কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নরের তালিকায় কেবল একটা নাম রেখে দিলে সেটি হবে আর্থার বার্নসের জন্য অবিচার। যেমন তিন দশক পদে থাকার পরে লেবাননের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর রিয়াদ সালামেহ গত বছরের ৩১ জুলাই দায়িত্ব ছাড়েন, সেদিনই জনপ্রিয় সাপ্তাহিক দ্য ইকোনমিস্ট লিখল, বিশ্বের সবচেয়ে নিকৃষ্ট কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নরের বিদায়।
কেননা রিয়াদের নেওয়া পদক্ষেপের কারণে আমানতকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বিপুলভাবে, পাঁচ বছরের মধ্যে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ৩১ বিলিয়ন ডলার থেকে নেমে এসেছে ১০ বিলিয়ন ডলারে, স্থানীয় মুদ্রার দরপতন হয় ৯৫ শতাংশ। তিনি ব্যাংক, আমদানিকারক ও ধনী মানুষের জন্য পৃথক একটি বিনিময়-ব্যবস্থা চালু করে সাধারণ মানুষকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করেছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে ৩৩ কোটি ডলার অর্থ আত্মসাতেরও অভিযোগ রয়েছে। রিয়াদ সালামেহর সময় মূল্যস্ফীতি ছিল ২২২ শতাংশ।
নাইজেরিয়ার গডউইন ইমেফিলেকেও একজন নিকৃষ্ট কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নর বলা হয়। তাঁর সময়ে মূল্যস্ফীতি যেমন নিয়ন্ত্রণে থাকেনি, মানও হারিয়েছে দেশটির মুদ্রা। কেবল তা-ই নয়, বাজেট ঘাটতি মেটাতে টাকা ছাপিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে তা দিয়েছেন। তাতে অর্থনীতি আরও খারাপ হয়েছে।
আবার ২০২১ সালে মূল্যস্ফীতি প্রায় ৭ শতাংশে চলে গিয়েছিল বলে পোল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নর এডাম গ্যালাপিনস্কিকে নিউইয়র্কভিত্তিক ম্যাগাজিন গ্লোবাল ফাইন্যান্স ইউরোপের সবচেয়ে নিকৃষ্ট গভর্নর আখ্যা দিয়েছিল।
বাংলাদেশে কী হয়
বিশ্বের বেশির ভাগ দেশেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নরকে জবাবদিহি করতে হয়। অনেক দেশেই এই জবাবদিহির আইনি কাঠামো আছে। বাংলাদেশে এর কিছুই নেই। ফলে প্রায় দুই বছর ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের বেশি থাকলেও বক্তৃতা-বিবৃতি বাইরে এ জন্য কাউকে জবাবদিহি করতে হয়নি।
ব্যবসায়ীদের তুষ্ট করতে বাংলাদেশেও সুদহার কমানোসহ নানা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। আর সবই করা হয়েছিল ২০১৮-এর নির্বাচনের আগে। তা-ও এক হোটেলে বসে, ব্যাংকমালিক ও ব্যবসায়ীরা মিলে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এ কারণে নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত অর্থ ও বাণিজ্যবিষয়ক ম্যাগাজিন গ্লোবাল ফাইন্যান্স ২০১৯ সালে তৎকালীন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের মান ‘বি গ্রেড’ থেকে কমিয়ে ‘ডি’ করে দিয়েছিল। কারণ হিসেবে বলেছিল, ‘বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক তার স্বাধীনতা হারিয়েছে। ২০১৮ সালে মুদ্রানীতির মূল সিদ্ধান্তগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিনির্ধারকদের মাধ্যমে নেওয়া হয়নি; বরং অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) সহায়তা ও চাপে নেওয়া হয়।’
একই ম্যাগাজিন ২০২৩ সালেও বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারকে ‘ডি’ গ্রেডই দিয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির কাঠামোগত দুর্বলতা ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণের কারণেই এই ‘ডি’ গ্রেড। বলে রাখা ভালো, কোভিড-পরবর্তী সময়ের সংকট মোকাবিলায় ২০২২ সাল থেকে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ যখন আগ্রাসীভাবে সুদহার কমিয়েছে, তখনো বাংলাদেশ সুদহার নয়-ছয় করে রেখেছিল। পরের দুই বছরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেছে ২০ বিলিয়ন ডলার, টাকা মান হারিয়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ। উচ্চ মূল্যস্ফীতি তো আছেই। ঋণমান সংস্থাগুলোও এরই মধ্যে বাংলাদেশের ঋণমান কমিয়ে দিয়েছে। টাকা ছাপিয়েও সরকারকে দেওয়া হয়েছে। নিম্ন সুদহার নীতি থেকে এখন সরে এসেছেন গভর্নর, তবে অনেক বিলম্বে। ফলে অর্থনীতিতে সংকট রয়ে গেছে।
এবার অর্থমন্ত্রীদের কথা
কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নরের তুলনায় অর্থমন্ত্রীর কাজ আরও ব্যাপক। হংকংভিত্তিক ফাইন্যান্স এশিয়া নামের একটি ম্যাগাজিন ভালো ও খারাপ অর্থমন্ত্রীদের তালিকা নিয়ে কাজ করত। তারা অর্থমন্ত্রীর কার্যক্রম বিচার করে কয়েকটি বিষয় ধরে। যেমন একজন অর্থমন্ত্রীর কাজ হচ্ছে বাজেট ও রাজস্ব নীতি ঠিকমতো তৈরি করা, পুঁজিবাজারকে স্থিতিশীল রাখা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করা, অর্থনীতির সংস্কার বাস্তবায়ন, আর বিশেষ করে কঠিন সময়ে বিনিয়োগকারীর আস্থা ধরে রাখা, যাতে কর্মসংস্থান পরিস্থিতি ভালো থাকে।
তবে অর্থমন্ত্রীর জন্য সবচেয়ে কঠিন বিষয় হচ্ছে স্বাধীনভাবে কাজ করা। নিজের কাজ ঠিকঠাক করতে প্রয়োজন হয় রাজনৈতিক দক্ষতা, নীতির ওপর কর্তৃত্ব, আমলাতন্ত্রের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারা এবং জনগণের স্বার্থ রক্ষায় লড়াই করে যাওয়া। অথচ বেশির ভাগ অর্থমন্ত্রীর কাজই হচ্ছে প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী অথবা সামরিক শাসককে তুষ্ট করা। বিপত্তি এখানেই।
একই সঙ্গে কমাতে হবে ব্যাংক খাতের অস্থিরতাও। এখানে ব্যাংক খাতের অধিকাংশ সিদ্ধান্তই রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে নেওয়া হয়। সুদহার কমানো, নতুন ব্যাংক দেওয়া থেকে শুরু করে ব্যাংক একীভূত করার সিদ্ধান্ত—সবই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এ থেকেও পরিত্রাণ দরকার। বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি। দূর করতে হবে বিনিয়োগের মন্দাভাব। বাড়াতে হবে রিজার্ভ। ডলার-সংকটেরও অবসান দরকার।
একসময়ে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন নাজিব রাজাক। একই সঙ্গে তিনি অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বেও ছিলেন। ফাইন্যান্স এশিয়া ২০১৬ সালে তাঁকে নিকৃষ্ট অর্থমন্ত্রী হিসেবে আখ্যা দিয়েছিল। এ নিয়ে নাজিব রাজাক হইচই কম করেননি। কিন্তু তাঁর সময়ের আর্থিক কেলেঙ্কারির জের এখনো বহন করতে হচ্ছে মালয়েশিয়াকে। রাষ্ট্রীয় তহবিল ওয়ান মালয়েশিয়া ডেভেলপমেন্ট বেরহাদ (১ এমডিবি) কেলেঙ্কারি বিশ্বের অন্যতম বড় কেলেঙ্কারি হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে।
উদাহরণ আরও আছে। ঘানার অর্থমন্ত্রী ওফরি-আট্টাকে বিদায় করা হয় গত ১৪ ফেব্রুয়ারি। তাঁর সময়ে দেশটি বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে খেলাপি হয়। মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। নিকৃষ্ট অর্থমন্ত্রীর তালিকায় কেন ওফরি-আট্টার নামটিও থাকল।
জিম্বাবুয়ের স্থানীয় মুদ্রার বিনিময় হারের এমনই করুণ দশা যে দেশটিকে এখন মার্কিন ডলারে লেনদেন করতে হয়। মূল্যস্ফীতিও মাত্রাছাড়া। সেই দেশটির অর্থমন্ত্রী এমথুলি এনকুবেকে যখন ২০২৩ সালে যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান রেপুটেশন পোল ইন্টারন্যাশনাল আফ্রিকার সেরা অর্থমন্ত্রীর পুরস্কার দিল, তখন এ নিয়ে হাসাহাসি আর উপহাস কম হয়নি। আর অর্থমন্ত্রী ও গভর্নর যদি দুজনেই নিকৃষ্ট হন, তাহলে কী হয়? তাহলে একটা দেশ শ্রীলঙ্কার মতো দেউলিয়া হয়।
বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রীরা কেমন
সবার আগে বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রীদের একটা সাফল্যের কথা বলতেই হয়। বাজেট ঘাটতি প্রায় সব সময়েই সীমার মধ্যেই ছিল। এ নিয়ে খুব বেশি উচ্চাভিলাষী কেউই হননি। সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতাও বজায় রাখা গেছে। ঋণ পরিশোধে কখনো সমস্যায় পড়েনি বাংলাদেশ। প্রবৃদ্ধিও বেড়েছে। সব মিলিয়ে স্বাধীনতার পর থেকে অর্থনীতিতে বাংলাদেশের অর্জন অনেক। যদিও সেই সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা নিয়ে এখন নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে গত তিন বছরে।
অর্থমন্ত্রীদের ব্যর্থতার তালিকাও কম নয়। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ২০০৮ থেকে হওয়া সব আর্থিক কেলেঙ্কারির তথ্য দিয়ে বলেছে, এ সময় ঋণের নামে ৯২ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। ২০১০ সালে একটি বড় শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির ঘটনাও ঘটেছে। ১৯৯৬ সালের পরে এটাই ছিল দেশের বৃহত্তম শেয়ার কেলেঙ্কারি।
ব্যাংক খাত আরও নাজুক হয়েছে। সুশাসনের অভাব এখানে প্রচণ্ড। খেলাপিদের প্রতি অতি নমনীয় আচরণ এবং বারবার সুবিধা দেওয়ায় খেলাপি ঋণ কাগজে-কলমে দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। তবে প্রকৃত খেলাপি আরও বেশি। অন্যদিকে কর-জিডিপি অনুপাতের দিক থেকে বাংলাদেশ সর্বনিম্ন অবস্থানে থাকা দেশগুলোর একটি।
সামষ্টিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখতে যেমন দেশের প্রায় সব অর্থমন্ত্রী নীতির ধারাবাহিকতা রেখেছেন, তেমনি ঋণখেলাপিদের সুযোগ দেওয়া, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীদের সুবিধা দেওয়া, অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়া, কালোটাকা সাদা করার সুযোগ রাখা, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে ব্যাংকের অনুমোদন—এসব নীতির ক্ষেত্রেও অর্থমন্ত্রীরা ছিলেন উদাহরণ দেওয়ার মতো ধারাবাহিক।
গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার প্রায় দুই বছর হলো গভর্নর পদে আছেন। তবে অর্থমন্ত্রী হিসেবে আবুল হাসান মাহমুদ আলী অপেক্ষাকৃত নতুন। অর্থমন্ত্রী হওয়ার আগে পাঁচ বছর তিনি অর্থ মন্ত্রণালয়–সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির সভাপতি ছিলেন। এই পাঁচ বছরে তিনি কমিটির ১৪টার মতো বৈঠক করেছেন। যদিও প্রতি মাসে অন্তত একটা করে বৈঠক করার নিয়ম রয়েছে। আবার সে সময়ের অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল শেষ তিন বছরে নিয়মিত কার্যালয়েও আসতেন না। এখন আবার তিনি অর্থ মন্ত্রণালয়–সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির সভাপতি। এ অবস্থায় অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনায় যে অর্থমন্ত্রীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে, নতুন অর্থমন্ত্রীর প্রধান কাজ হবে সেটাও প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু তা কতটা সম্ভব হবে, সেটাও এক বড় প্রশ্ন।
এদিকে আগামী অর্থবছরের নতুন বাজেটের প্রস্তুতিও শুরু হয়ে গেছে। চাপ কিছু কমলেও অর্থনীতি উত্তরণের পর্যায়ে যায়নি। জুনে যেমন নতুন বাজেট দেবেন নতুন অর্থমন্ত্রী, তেমনি নতুন মুদ্রানীতির ঘোষণা দিতে হবে গভর্নরকেও। দুই নীতির সমন্বয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করার এটাই সবচেয়ে ভালো সময়। কারণ, সাধারণ মানুষ বাজারে স্বস্তি চায়।
একই সঙ্গে কমাতে হবে ব্যাংক খাতের অস্থিরতাও। এখানে ব্যাংক খাতের অধিকাংশ সিদ্ধান্তই রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে নেওয়া হয়। সুদহার কমানো, নতুন ব্যাংক দেওয়া থেকে শুরু করে ব্যাংক একীভূত করার সিদ্ধান্ত—সবই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এ থেকেও পরিত্রাণ দরকার। বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি। দূর করতে হবে বিনিয়োগের মন্দাভাব। বাড়াতে হবে রিজার্ভ। ডলার-সংকটেরও অবসান দরকার।
সব মিলিয়ে দেশের অর্থমন্ত্রী ও গভর্নরের জন্য সামনে এখন অনেক চ্যালেঞ্জ। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার ওপরেই নির্ভর করছে ইতিহাসে কার স্থান কোথায় হবে। কে ভালো কে খারাপ, তারও ফয়সালা হবে। অন্তত বিশ্বের অন্যান্য দেশেই অর্থমন্ত্রী ও গভর্নরকে এভাবেই মূল্যায়ন করা হয়। আমরাও এভাবে মূল্যায়ন করতে চাই।
শওকত হোসেন হেড অব অনলাইন, প্রথম আলো