নির্বাচিত হলে কি যোগ্য এমপি হতেন হিরো আলম?

নির্বাচনের মাঠে হিরো আলম
ছবি: প্রথম আলো

‘হিরো আলম পর্যন্ত হাইকোর্ট দেখায়, বোঝেন অবস্থা!’ ২০১৮ সালের ১৯ ডিসেম্বর প্রথম আলোয় প্রকাশিত একটি খবরের শিরোনাম এটি। নির্বাচন কমিশন সেই নির্বাচনে হিরো আলমের মনোনয়নপত্র বাতিল করেছিল, যা তিনি হাইকোর্টে গিয়ে ফেরত পান। এর প্রতিক্রিয়ায় শুরুতে বলা কথাগুলো বলেছিলেন নির্বাচন কমিশনের তৎকালীন সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ। দেশের একজন নাগরিকের প্রতি কী নির্মম বিদ্রূপ করছেন একজন ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী’! তবে দমে যাননি জনাব আলম, তাঁর সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন, প্রায় জিতে গিয়েছিলেন এবারের উপনির্বাচনে। এখন পর্যন্ত করা পথপরিক্রমায় হিরো আলম আমাদের শুধু হাইকোর্টই নন, দেখাচ্ছেন অনেক কিছুই, যা আগে এই রাষ্ট্র প্রত্যক্ষ করেনি।

জনাব হিরো আলমের মতে, বগুড়ার দুটি আসনের একটিতে ভোট গ্রহণের চরম অনিয়ম হলেও বগুড়া-৪ আসনের নির্বাচনে ভোট গ্রহণ সুষ্ঠু হয়েছে। তবে ভোটের হিসাবের সময় গরমিল করে তাঁকে হারিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর কারণ হিসেবে প্রথম আলোর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘শিক্ষিত সমাজের কিছু লোক আছেন, যাঁরা কিনা আমাকে মেনে নিতে চান না। তাঁরা মনে করেন, আমি এমপি (সংসদ সদস্য) হলে বাংলাদেশের সম্মান থাকবে না, তাঁদের সম্মান যাবে।

তথাকথিত এই শিক্ষিতরা মনে করেন, আমরা অশিক্ষিত, মূর্খকে “স্যার” বলে ডাকতে হবে। এতেই তাদের আপত্তি। তারা আমাকে মেনে নিতে চায় না, শুধু এ কারণেই নির্বাচনী ফল পাল্টে দেওয়া হয়েছে।’ ঠিক এ কারণে জনাব আলমকে ‘পরাজিত করা হয়েছে’ কি না সেটা আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারব না। তবে তাঁর অভিযোগটা এই সমাজের একটা মর্মান্তিক ক্ষতকে উন্মোচন করে। আমাদের সমাজের তথাকথিত ‘শিক্ষিত এবং রুচিশীল’ মানুষেরা প্রথম থেকেই হিরো আলমের প্রতি নানা রকম অন্যায় আচরণ করেছেন।

উচ্চ আদালতে গিয়ে কোন রায়ের ফলে সংসদ সদস্য হবেন কি না, সেটা জানি না, কিন্তু এখন পর্যন্ত এ-যাত্রা হিরো আলম সংসদ সদস্য হতে পারলেন না। তবু একটু ভেবে দেখা যাক তো, কেমন সংসদ সদস্য হতেন তিনি? তিনি কেমন সংসদ সদস্য হতেন, সেটা বুঝতে হলে জানা জরুরি একজন সংসদ সদস্যের কাজ এবং দায়িত্ব আসলে কী। সত্যি বলতে কি এই দেশের শিক্ষিত মানুষদের মধ্যেও এই ব্যাপারে বিভ্রান্তি আছে।

দেশের আইন বিভাগ হিসেবে আইন প্রণয়ন সংসদ সদস্যদের প্রধান কাজ হলেও রাষ্ট্রের যেকোনো অভ্যন্তরীণ কিংবা আন্তরাষ্ট্রীয় বিষয়ে সরকারি নীতি নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা-সমালোচনা হওয়ার জায়গা সংসদ। সংসদের আলোচনার মাধ্যমে একটা রাষ্ট্রের আইন তৈরি এবং রাষ্ট্রীয় নীতি ঠিক হওয়ার কথা। অন্তত তাত্ত্বিকভাবে সংসদীয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সংসদই সব রকম কর্মকাণ্ড পরিচালনার মূল কেন্দ্রবিন্দু হওয়ার কথা। আমরা খুব সহজেই নিশ্চয়ই বুঝতে পারছি কোনো একজন সংসদ সদস্য যখন সংসদে যান, তাঁর জানা থাকার কথা যে তিনি আইন প্রণয়ন এবং রাষ্ট্রীয় নীতি পর্যালোচনা এবং সংশোধনে সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখবেন।

আইন প্রণয়নের কথাই ধরা যাক আগে। আমরা জানি, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ থাকা অবস্থায় আসলে এই সংসদকে কোনোভাবেই রাষ্ট্রের আইন বিভাগ হিসেবে মেনে নেওয়া যায় না। এই সংসদ স্বাধীনতার পর থেকেই কার্যত এক ব্যক্তির ইচ্ছাকে আইন হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার ‘রাবার স্ট্যাম্প’-এর বেশি কিছু নয়। আলোচনার খাতিরে ধরে নেওয়া যাক এই সংসদে একটা ভিন্ন ধরনের ৭০ অনুচ্ছেদ আছে এখানে অনাস্থা ভোট এবং অর্থবিল ছাড়া আর সব বিলের ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যদের যেকোনো মতামত এবং ভোট দেওয়ার সুযোগ আছে।

এ রকম একটি সংসদে কেউ যদি সত্যিকারের সংসদ সদস্য হয়ে উঠতে চান, তাহলে তার সামনে এক অকল্পনীয় বড় কাজ তৈরি হয়। সংসদের রাষ্ট্রের নানা বিষয়ে আইন তৈরি হবে। বিল হিসেবে যখন সেগুলো আসে, তা সেই মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটিকে যাবে এবং সেখানে পরীক্ষিত হয়ে আবার সংসদে আসবে। সবকিছুর পরও কোনো সংসদ সদস্য কোনো বিলের পুরোটার সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করতে পারেন কিংবা পারেন সংশ্লিষ্ট বিলের কোনো অংশের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করতে।

সর্বশেষ সেই বিলে তিনি পক্ষে না বিপক্ষে, ভোট দেবেন, সেই সিদ্ধান্ত স্বাধীনভাবে দেওয়ার জন্য বিলটি সম্পর্কে তাঁর যথেষ্ট ধারণা প্রয়োজন হবে। সংসদে নির্বাচিত সদস্যরা যে একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড থেকেই আসুক না কেন, প্রতিটি বিষয়ে তাঁদের মৌলিক ধারণা নিতেই হবে। না হলে তাঁর পক্ষে স্বাধীনভাবে কোনো বিলের পক্ষে কিংবা বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া সম্ভব হবে না।

বিদ্যমান ব্যবস্থায় একজন আদর্শ সংসদ সদস্যের কাজ যা যা বলে আমরা জানি, সেটাকেই যদি মাপকাঠি ধরে নিই তবে সেই মাপকাঠিতে জনাব হিরো আলম আমাদের অসংখ্য সংসদ সদস্যের চেয়ে ভালো করতেন বলে আমি বিশ্বাস করি। শুধু নির্বাচনী এলাকার মানুষের পাশে থাকাই নয়, তিনি সংসদে চুপচাপ বসে থাকতেন না বলেই আমার বিশ্বাস।

সংসদে যখন বাজেট উত্থাপিত হবে, তখন সেটা নিয়ে আলোচনা করতে চাইলে একজন সংসদ সদস্য এটা বলে পার পাবেন না যে তিনি অর্থনীতির ছাত্র নন। আবার পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে যদি কোনো বিল যদি সংসদে আসে, সেটার ক্ষেত্রেও সংসদ সদস্যদের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ করার প্রক্রিয়া, ঝুঁকি ইত্যাদি সম্পর্কে মৌলিক ধারণা রাখতেই হবে। এ রকম উদাহরণ দেওয়া যাবে আরও অনেক।

অপর দিকে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং আন্তর্জাতিক ইস্যুতে দেশের অবস্থান কেমন হবে, সেটার জন্য একজন সংসদ সদস্যকে এসব বিষয়েও যথেষ্ট ধারণা রাখতে হবে। সেটার ভিত্তিতেই এসব ক্ষেত্রে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপের পক্ষে কিংবা বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে হবে। বিশেষ করে বর্তমান সময়ের বাংলাদেশ এমন একটা ভূরাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের মধ্যে পড়েছে, যেটা বিস্তারিতভাবে না বুঝলে কোনো

একজন সংসদ সদস্য রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর সঠিক সিদ্ধান্ত দিতে পারার কথা নয়। চীনকে কেন্দ্র করে এই অঞ্চলে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি (আইপিএস), কোয়াড, ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্কের (আইপিএফ) মতো যেসব উদ্যোগ পশ্চিমাদের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে, সেগুলোর বিস্তারিত জানা এবং সেখানে বাংলাদেশের কী ভূমিকা নেওয়া উচিত, এসব ব্যাপারেও সংসদ সদস্যদের যথেষ্ট ধারণা রাখা উচিত।

সর্বোপরি একজন সংসদ সদস্য যেহেতু আইনপ্রণেতা, তাই তাঁর পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান থাকতে হবে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন, সংবিধান সম্পর্কে। এ ক্ষেত্রে আমি আইনজ্ঞ কিংবা সংবিধানবিশেষজ্ঞ নই, এ কথা বলার কোনো সুযোগ নেই।

আমরা ধরে নিই একজন সত্যিকারের সংসদ সদস্য হওয়ার পথে প্রধান বাধা ৭০ অনুচ্ছেদ আগের মতো নেই। প্রশ্ন হলো, তখনো কি আমরা সংসদ সদস্যদের আইন প্রণয়ন এবং রাষ্ট্রীয় নীতি পর্যালোচনা এবং পরিবর্তনের কাজে মনোনিবেশ করতে দেখতাম?

আবহমান কাল থেকে সংসদ সদস্যরা তাঁদের এলাকার মানুষের সুখে-দুঃখে পাশে থাকবেন, তাঁদের সংকট সমাধান করবেন, তাঁদের এলাকায় রাস্তাঘাট, সেতু নির্মাণসহ অন্যান্য উন্নয়ন করবেন, এসব প্রতিশ্রুতি দিয়েই সংসদ সদস্য হিসেবে ভোট চেয়েছেন। জনাব হিরো আলমও তাঁর নির্বাচনী প্রচারে এসব কথাই বলেছেন, এসব প্রতিশ্রুতিই দিয়েছেন আর সব সংসদ সদস্য প্রার্থীদের মতোই। এই প্রশ্ন ওঠা খুবই জরুরি, স্থানীয় পর্যায়ের এসব কাজ করার দায়িত্ব আদৌ সংসদ সদস্যদের কি না।

এটা তাঁদের দায়িত্ব হোক বা না হোক এই দায়িত্ব তাদের নানাভাবে দিয়ে রাখা হয়েছে দীর্ঘকাল থেকে। অথচ এসব দায়িত্ব হওয়ার কথা ছিল একেবারেই স্থানীয় সরকারের। কারও যদি এসব কাজ করা পছন্দের বিষয় হয় (হতেই পারে) সে ক্ষেত্রে তাঁদের উচিত হবে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন করা এবং তার এসব সেবা জনগণকে দেওয়া।

বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫৯ এবং ৬০ দেশের স্থানীয় শাসনের (যেখানে ‘স্থানীয় শাসন’-এর পরিবর্তে ‘স্থানীয় সরকার’ কথাটি থাকাই উচিত হবে) অধীনে স্থানীয় উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড তো বটেই, জনপ্রশাসন এবং পুলিশ তার অধীন হওয়ার সুযোগ আছে, যদি সংসদ সে রকম আইন প্রণয়ন করে। আর সংবিধান সংশোধন করে এটাকে একটা ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে না রেখে বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করা গেলেই পূর্ণ দায়িত্ব তাদের হাতে দিতে যেকোনো সরকার বাধ্য থাকবে। তবে এটুকু বলে রাখা জরুরি বিদ্যমান সংবিধানের আলোকেই এসব ক্ষমতা চাইলে তাঁদের হাতে দেওয়া যায়।

কিন্তু বাংলাদেশে সংসদ সদস্যরা স্থানীয় সরকারের ওপরে তাঁদের কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্য রীতিমতো আইন বানিয়েছেন। উপজেলা পরিষদ আইনের ২৫ ধারা অনুযায়ী তাঁরা উপদেষ্টা হিসেবে বেশ বড় রকমের কর্তৃত্ব প্রয়োগ করতে পারেন। এ ছাড়া পদাধিকারবলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা বোর্ডে থাকেন তাঁরা। সংসদ সদস্যরা এসব পদে থাকার জন্য এতটা মরিয়া যে কয়েক বছর আগে হাইকোর্ট যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডিতে সংসদ সদস্যদের থাকা অবৈধ ঘোষণা করেন, তখন তার তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন সংসদ সদস্যরা।

হাইকোর্টে এ-সংক্রান্ত রায়ের প্রতিবাদে আপিল বিভাগে গিয়েছিলেন জনাব রাশেদ খান মেনন। সংসদ সদস্যরা যত বেশি স্থানীয় উন্নয়ন প্রকল্প এবং ম্যানেজিং কমিটিতে থাকতে পারেন, তাতে চাইলে বিরাট আর্থিক সুবিধা পাওয়া যায়। নিশ্চয়ই সব সংসদ সদস্য আর্থিক সুবিধা জন্য এসব জায়গায় থাকতে চান না। তাঁরা এর মাধ্যমে তাঁদের কর্তৃত্ব উপভোগ করেন এবং একই সঙ্গে পরবর্তী নির্বাচনে যাতে নির্বাচিত হতে পারেন সেই চেষ্টা বহাল রাখেন।

নির্বাচিত হলে হিরো আলম একজন যোগ্য এমপি হতেন কি না, সেই প্রশ্নে আমার জবাব আশা করি অনেকেই পেয়ে গেছেন। বাংলাদেশে যদি একটা সত্যিকার কার্যকর আইন বিভাগ থাকত, তাহলে দূর থেকে যতটা বুঝি তাতে জনাব হিরো আলম সেই যোগ্যতা সম্ভবত অর্জন করেননি। তাহলে এই সম্পূরক প্রশ্নও আসে, বাংলাদেশের ইতিহাসে তেমন যোগ্যতাসম্পন্ন সংসদ সদস্য কয়জন ছিলেন?

বিদ্যমান ৭০ অনুচ্ছেদ থাকা অবস্থায় তেমন কেউ আসলেও আমরা তাকে ‘তুখোড় পার্লামেন্টারিয়ান’ খেতাব দিতেই পারি, কিন্তু সেই সংসদ সদস্যদের বুদ্ধি, জ্ঞান, প্রজ্ঞা জাতির কোনো কাজে আদতে আসবে না। হাতে গোনা কয়েকজন ‘তুখোড় পার্লামেন্টারিয়ান’দের বাদ দিলে এ দেশের প্রায় সংসদ সদস্য সংসদে আসলে কী করেন, সেটা বোঝার জন্য ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের ‘পার্লামেন্ট ওয়াচ’ রিপোর্ট দেখে নিলেই হবে।

বিদ্যমান ব্যবস্থায় একজন আদর্শ সংসদ সদস্যের কাজ যা যা বলে আমরা জানি, সেটাকেই যদি মাপকাঠি ধরে নিই তবে সেই মাপকাঠিতে জনাব হিরো আলম আমাদের অসংখ্য সংসদ সদস্যের চেয়ে ভালো করতেন বলে আমি বিশ্বাস করি। শুধু নির্বাচনী এলাকার মানুষের পাশে থাকাই নয়, তিনি সংসদে চুপচাপ বসে থাকতেন না বলেই আমার বিশ্বাস।

আর সমাজের একেবারে প্রান্তিক ‘অশিক্ষিত’ একজন মানুষ সমাজের ‘শিক্ষিত ভদ্রলোকদের’ তীব্র বিরোধী স্রোত উপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত যদি সংসদ সদস্য হতে পারতেন, তাহলে সেটা হয়ে থাকতো অবিশ্বাস্য নজির। এই বাক্যটি লিখেই মনে হলো, হিরো আলম এখন পর্যন্ত যা করেছেন, সেই নজিরও তো অবিশ্বাস্যই।

  • জাহেদ উর রহমান ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের শিক্ষক