মতামত

ভারতে নতুন করে ধর্মীয় আবেগ যেভাবে ফিরছে

ভারতের সামগ্রিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক সাফল্য বা কূটনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার মতো বিষয়কে প্রধান হাতিয়ার করে নয়, ধর্মীয় ভাবাবেগকে মূল ইস্যু করেই এগোতে চাইছে বিজেপি।
ফাইল ছবি: এএফপি

ভারতের ‘সর্বশক্তিমান’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ৫ জানুয়ারি ত্রিপুরায় গিয়েছিলেন। সর্বশক্তিমান এ কারণে, ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে কেন্দ্র ও রাজ্যস্তরেও তাঁর দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নির্বাচনী ভবিষ্যৎ শাহর ওপরেই নির্ভর করছে বলে মনে করা হয়।

ভারতীয় রাজনীতি তিনি যে ভালো বোঝেন এবং রণকৌশল বাস্তবায়নের মাধ্যমে দলকে জেতাতে পারেন, তা একাধিকবার প্রমাণিত হয়েছে। সেই অমিত শাহ যখন বছরের গোড়াতেই প্রবল আগ্রহে হিন্দু দেবতা রামের মন্দির নির্মাণের বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে শুরু করেন, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না যে ২০২৩ সাল তো বটেই, আগামী বছরের লোকসভা নির্বাচনের আগে কোন পথে এগোবে ভারতের রাজনীতির আখ্যান।

২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে দ্বিতীয়বারের জন্য জিতে ক্ষমতায় এসেছে বিজেপি। এরপর কোনো একটি বছরে সবচেয়ে বেশি রাজ্যস্তরের বিধানসভা নির্বাচন হবে ২০২৩ সালে। ত্রিপুরা, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড, কর্ণাটক, ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ, মিজোরাম, রাজস্থান ও তেলেঙ্গানা—এই ৯ রাজ্যে নির্বাচন হবে এ বছর। কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল জম্মু-কাশ্মীরেও নির্বাচন হওয়ার কথা। অর্থাৎ ভারতের এক-তৃতীয়াংশ রাজ্যে নির্বাচন হবে ২০২৩ সালে, যা গত পাঁচ বছরে হয়নি। নিঃসন্দেহে এখন থেকে আগামী বছরের মাঝামাঝি পর্যন্ত যতক্ষণ না লোকসভা নির্বাচন হচ্ছে, ততক্ষণ ভারতের রাজনৈতিক পারদ নির্বাচনকে মাথায় রেখেই চড়বে।

অমিত শাহর ত্রিপুরা সফরের ভাষণ শুনলেই বোঝা যায়, নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর ভাষণে রাহুল গান্ধীকে আক্রমণের পাশাপাশি স্পষ্ট জানিয়েছেন, লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি উত্তর প্রদেশের অযোধ্যায় ‘আকাশচুম্বী’ রামমন্দিরের উদ্বোধন করা হবে। এ ছাড়া তিনি ত্রিপুরা গিয়েছিলেন সে রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন মাথায় রেখে রথযাত্রা উদ্বোধনের উদ্দেশ্যে।

গোটা ২০২২ সালে নানাভাবে ধর্মীয় ভাবাবেগে উসকানি দেওয়ার কাজ করে গেছে হিন্দুত্ববাদী সংগঠন। কখনো কর্ণাটকে হিজাববিরোধী সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন আন্দোলনকে রাজনৈতিক প্রচারের কেন্দ্র নিয়ে এসেছে, কখনো আসামে লাগাতার মুসলমান সমাজের ওপর নানা ধরনের সরকারি বিধিনিষেধ আরোপ করে মুসলিমবিরোধিতাকে নিয়ে এসেছে জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রে।

অমিত শাহর ত্রিপুরা সফরের কারণ এবং বক্তব্যের সূত্র ধরে ভারতের বর্তমান রাজনীতির দিকে যদি তাকানো যায়, তাহলে সহজেই বোঝা যায় যে আগামী বছরখানেক দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক সাফল্য বা কূটনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার মতো বিষয়কে প্রধান হাতিয়ার করে নয়, ধর্মীয় ভাবাবেগকে মূল ইস্যু করেই এগোতে চাইছে বিজেপি।

প্রথমত, ১৯৯১ সালের ধর্মস্থান আইনকে (যেখানে বলা হয়েছে যে ধর্মস্থানের ধর্মীয় চরিত্র পরিবর্তন করা যাবে না এবং ভারতের স্বাধীনতার দিনে, অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টে একটি ধর্মস্থানের যা চরিত্র ছিল, সেই চরিত্রই বজায় রাখতে হবে) চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে একাধিক মামলা করেছিল প্রধানত হিন্দুত্ববাদী সংগঠন বা তার প্রতিনিধিরা। এ আইন পাল্টে ফেলা গেলে নতুন ও পুরোনো অনেক মসজিদ টিকিয়ে রাখা মুশকিল হবে। স্বয়ং অমিত শাহ কিছুদিন আগে একটি টেলিভিশন চ্যানেলে বলেছেন, এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের মতামত সুপ্রিম কোর্টকে জানানো হবে। ধরে নেওয়া যেতে পারে, আইন পরিবর্তনের পক্ষেই রায় দেবে সরকার।

গোটা ২০২২ সালে নানাভাবে ধর্মীয় ভাবাবেগে উসকানি দেওয়ার কাজ করে গেছে হিন্দুত্ববাদী সংগঠন। কখনো কর্ণাটকে হিজাববিরোধী সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন আন্দোলনকে রাজনৈতিক প্রচারের কেন্দ্র নিয়ে এসেছে, কখনো আসামে লাগাতার মুসলমান সমাজের ওপর নানা ধরনের সরকারি বিধিনিষেধ আরোপ করে মুসলিমবিরোধিতাকে নিয়ে এসেছে জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রে।

আবার কখনোবা ধারাবাহিকভাবে মুসলমান-অধ্যুষিত বসতিগুলোকে বেআইনি চিহ্নিত করে ভেঙে ফেলার চেষ্টা করেছে। এর সঙ্গে সঙ্গে কখনো স্থানীয় আদালত মন্দির-মসজিদ বিতর্কে হিন্দু সম্প্রদায়ের পক্ষে রায় দিয়েছেন, আবার কখনো ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গার অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মুক্তি দিয়েছেন। প্রতিটি ক্ষেত্রেই ধর্মীয় ভাবাবেগকে প্রাধান্য দিয়ে বছরজুড়ে রাজনীতি করেছে হিন্দুত্ববাদী সংগঠন এবং অনেক ক্ষেত্রে সরাসরি বিজেপি। কোথাও তারা স্থানীয় আদালতকে পাশে পেয়েছে, কোথাও সামাজিক সংগঠনকে।

এই যে ধীরে ধীরে ২০২২ সালজুড়ে ধর্মীয় ভাবাবেগকে উসকানি দেওয়া এবং ২০২৩ সালেও গতি বৃদ্ধি করার চেষ্টা, তার কারণ ১০ বছরের ‘অ্যান্টি-ইনকামবেন্সি’ বা প্রতিষ্ঠানবিরোধী ভাবাবেগ।

বিজেপির জনপ্রিয়তা মাপার সহজ উপায় (এবং একেবারেই নিশ্ছিদ্র নয়) হলো সামাজিক মাধ্যমে মানুষের মতামত। ২০১৪ সালে যখন বিজেপি ক্ষমতায় আসে, তখন প্রায় কাউকেই দেখা যেত না বিজেপি বা নরেন্দ্র মোদি সম্পর্কে সামাজিক মাধ্যমে কটু মন্তব্য করতে। ২০২৩ সালে যখন বিজেপি প্রবল শক্তিশালী, তখন কিন্তু দেখা যাচ্ছে, সামাজিক মাধ্যমে বড়সংখ্যক মানুষ বিজেপি ও মোদিবিরোধী মন্তব্য প্রকাশ্যে করছেন। এটা প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার বড় ইঙ্গিত। যদিও এই ইঙ্গিত থেকে এমনটা বলা যায় না যে তাঁরা সবাই বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দেবেন। কিন্তু বিষয়টা বিজেপির জন্য চিন্তার।

বিশেষত, এ সময় যখন ভারতে কর্মহীনতা উত্তরোত্তর বাড়ছে; ২০১৪ সালে ভারতে সক্ষম বেকারদের মধ্যে কর্মহীনতার হার ছিল ৫ দশমিক ৪। ২০২৩ সালের গোড়ায় এই হার ৮ দশমিক ৬। এই তথ্য সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি নামে একটি বিশ্বাসযোগ্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানের। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান বলছে, ২০২৩ সালে বিশ্বে আর্থিক মন্দা আরও জোরালো হবে। এর প্রভাব পড়বে, কারণ ভারত উত্তরোত্তর অর্থনীতিকে বিশ্ববাজারের কাছে খুলে দিয়েছে। এ অবস্থায় একাধিক রাজ্য এবং জাতীয় স্তরের নির্বাচনে অর্থনৈতিক সাফল্যের হিসাব দিতে পারবে না বিজেপি। সেটা মাথায় রেখেই তারা জোর দিচ্ছে ধর্মীয় উন্মাদনার ইস্যুতে।

এর সঙ্গে যুক্ত হবে বিভিন্ন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাকে ব্যবহার করে সারা দেশে বিরোধীদের ওপরে চাপ সৃষ্টি করার প্রবণতা, যে প্রবণতা কয়েক বছর ধরে বেড়েই চলেছে। এ ছাড়া তৃতীয়ত, বিরোধীদের নিজেদের সংগঠিত করে বিজেপিবিরোধী একটি সর্বভারতীয় মঞ্চ তৈরি না করতে পারার ব্যর্থতাও রাজ্যের পাশাপাশি জাতীয় নির্বাচনেও এগিয়ে রাখবে সংগঠিত দল বিজেপিকে।

এ অবস্থায় রাজ্যের নির্বাচন বা আগামী বছরের লোকসভা ভোটে বিজেপির হারার প্রায় কোনো সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

  • শুভজিৎ বাগচী প্রথম আলোর কলকাতা সংবাদদাতা