বনখেকোদের হাতে খুন হওয়া বন বিভাগের কর্মকর্তা সাজ্জাদুজ্জামান। এ ঘটনার বিচার চেয়ে তাঁর সহকর্মীদের কর্মসূচিতে উপস্থিত থাকা নয় মাসের কন্যা সাদিকা
বনখেকোদের হাতে খুন হওয়া বন বিভাগের কর্মকর্তা সাজ্জাদুজ্জামান। এ ঘটনার বিচার চেয়ে তাঁর সহকর্মীদের কর্মসূচিতে উপস্থিত থাকা নয় মাসের কন্যা সাদিকা

মতামত

সাদিকা কি বাবা হত্যার বিচার চেয়ে রাস্তায় নামা সর্বকনিষ্ঠ মানুষ?

সরকার কে ভাই? কাকে বলে সরকার? যেদিকে চোখ যায়, আমি তো কেবল সরকারই দেখি। সরকারি দালানকোঠা, সরকারি গাড়ি, সরকারি কর্মকর্তাদের আবাসন। সরকার আর সরকার। ৪৫টি মন্ত্রণালয়, কাঁড়িখানেক বিভাগ, অধিদপ্তর, পরিদপ্তর কত শাখা-প্রশাখা। সেখানে কর্মরত সবাই সরকার।

সরকারের কাজ হলো জনস্বার্থে কাজ করা, আইন প্রয়োগ করা। যদি তা-ই হয়, তাহলে বন বিভাগের কর্মীদের রাস্তায় নামতে হচ্ছে কেন? তাঁদের কেন এখন চিৎকার করে সহকর্মী হত্যার বিচার চাইতে হচ্ছে? কারণ কি এটাই যে সরকারের বাইরে আরেকটা শক্তিশালী সরকার আছে? যাদের আমি-আপনি সবাই চিনি-জানি? কিন্তু সরকার চিনেও না চেনার ভান করে তাদের সুরক্ষা দেয়!

বন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা গতকাল মঙ্গলবার (৩ এপ্রিল) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে মানববন্ধন করেছেন। কারণ, তাঁদের সহকর্মী কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের উখিয়া রেঞ্জের দোছড়ি বন বিটের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সাজ্জাদুজ্জামান খুন হয়েছেন।

প্রথম আলোর খবর বলছে, বনের ভেতর সরকারি পাহাড় কেটে দুর্বৃত্তরা মাটি নিয়ে যাচ্ছে, এই খবর পেয়ে গত রোববার রাত সোয়া তিনটার দিকে টহল দলের সদস্য আলী আহমদকে নিয়ে মোটরসাইকেলে রাজাপালং ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যম হরিণমারার লালুর বাপেরটেক এলাকায় যান সাজ্জাদুজ্জামান। দুর্বৃত্তদের ডাম্পারের ধাক্কায় প্রথমে তিনি রাস্তায় ছিটকে পড়েন। পরে তাঁর মাথার ওপর দিয়ে ডাম্পার চালিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা।

সাজ্জাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা উখিয়া বন রেঞ্জ কর্মকর্তা গাজী শফিউল আলম বলেন, এটা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। কারণ, গত মার্চে সাজ্জাদুজ্জামান পাহাড়খেকো ও বালু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে তিনি পৃথক তিনটি মামলা করেছিলেন। তাঁকে নিশানা করে হত্যা করা হয়েছে।

কারা হত্যা করেছে সাজ্জাদকে? দশজনের নাম উল্লেখ করে গাজী শফিউল আলম মামলা করেছেন। তবে এখনো জানা যায়নি, এই নামগুলো যাঁদের, সেই নামের ওজন আসলে কত বেশি? তাঁরা কি সেই গোত্রের, যাদের সরকার চিনেও না চেনার ভান করে?

সাজ্জাদুজ্জামান হত্যার বিচার চেয়ে সহকর্মীদের কর্মসূচি। আগারগাঁও, মঙ্গলবার

সরকার তো বনখেকো, পাহাড়খেকোদের চেনে। বন অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটের তথ্য হলো, বনের জমি জবরদখল করে স্থায়ী স্থাপনাসহ প্রতিষ্ঠিত শিল্পপ্রতিষ্ঠান, কলকারখানা তৈরি করেছেন ১৭২ জন। তাঁরা দখল করেছেন ৮২০ দশমিক ৩৪ একর জমি। মানে তাঁরা হলেন শিল্পপতি, কারখানা মালিক।

ছোট বাজার, দোকানপাট, রিসোর্ট, কটেজ, কৃষি খামার তৈরি করে বনের জমি জবরদখল করেছেন ৩ হাজার ৩২৯ জন। রিসোর্ট-কটেজ কারা বানাচ্ছেন? ব্যক্তিমালিকানাধীন ঘর-বাড়ি, বসতভিটা করে বনের জমি জবরদখল করেছেন ৫৮ হাজার ৪০৭ জন। কৃষিজমি, চারণভূমি, বাগান, লবণ চাষ করে জমি জবরদখল করেছেন ২৬ হাজার ৩০৭ জন।

সে হিসাবে ৮৮ হাজার ২১৫ জন জবরদখলকারী বনের ১৩ লাখ ৮৬ হাজার ১১৩ দশমিক ৬ একর জমি দখল করেছেন। অর্থাৎ, ১৭ কোটি মানুষের দেশে বনখেকোর সংখ্যা ৮৮ হাজার ২১৫। শতাংশের হিসাবে প্রায় দশমিক ০৫ জন এই অন্যায়ের সঙ্গে জড়িত। তাঁদের শক্তি কেন ১৭ কোটি মানুষের চেয়ে বেশি? তাঁদের পেছনে কারা?

সাজ্জাদের স্ত্রী মুমতাহিনা সুমি সংসার করেছেন দুই বছর। তিনি কোনো কথা বলেননি, নীরবে কেঁদে গেছেন শুধু। কোনো এক স্বজনের কোলে সাজ্জাদের নয় মাস বয়সী শিশু কন্যা সাদিকাও তখন চিৎকার করে কাঁদছে। সাদিকা কি বাবা হত্যার বিচার চেয়ে রাস্তায় নামা সর্বকনিষ্ঠ মানুষ? এই পরিবারের কান্নায় কারও কি কিছু যায় আসে? সরকারেরই যখন নিরাপত্তা নেই, তখন এসব বেসরকারি মানুষের গুরুত্ব কী?

যে ডাম্পার দিয়ে সাজ্জাদকে খুন করা হয়েছে, সেসব ডাম্পারের মালিক কারা, সে খবর কি সরকার জানে না? জানে। কক্সবাজারে প্রথম আলোর সাংবাদিক আবদুল কুদ্দুস লিখেছেন সাজ্জাদ যেখানে খুন হয়েছেন সেখানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা মিলেমিশে পাহাড় কাটছেন। গত তিন বছরে তাঁরা ২০টি পাহাড় কেটেছেন।

বিআরটিএ কার্যালয় জানে, তাঁদের জেলায় ২ হাজার ৪০০টি ডাম্পার (মিনিট্রাক) রয়েছে, যার ১ হাজার ৪৫০ টির নিবন্ধন নেই। এ ছাড়া দেড় হাজার পিকআপের মধ্যে নিবন্ধন নেই অন্তত ৫৫০ টির। এই এলাকায় মাটি, বালু ব্যবসা ও ডাম্পার ট্রাক সমিতির নিয়ন্ত্রণ করে তিনটি সিন্ডিকেট। এর দুটি আওয়ামী লীগের, একটি বিএনপির। এর দায় কার?

সাজ্জাদের হত্যার বিচার চেয়ে তাঁর সহকর্মীরা যে মানববন্ধন করেছেন, সেখানে তাঁরা বলছেন যে বনকর্মীদের এই অবস্থার জন্য দায়ী ‘প্রশাসন’। এখানেই আসলে প্রশ্নটা ওঠে। তাহলে তাঁরা কি সরকার নন? তাঁরা নিজেদের পরিচয় দিচ্ছেন ঝুঁকিতে থাকা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী হিসেবে। সাজ্জাদের বন্ধু ও বনকর্মী রাকিব হোসেন বলেন, ‘আমরা আইন প্রয়োগ করি বনখেকো, পাহাড়খেকোদের বিরুদ্ধে। দুঃখের কথা, আমাদেরই এখন আইনের প্রয়োগ চেয়ে রাস্তায় দাঁড়াতে হচ্ছে। রাষ্ট্র কি আমাদের নিরাপত্তা দিতে পেরেছে?’

বাবা হত্যার বিচার চেয়ে মায়ের কোলে মানবন্ধনে উপস্থিত ছিল নয় মাসের শিশু সাদিকাও। আগারগাঁও, মঙ্গলবার

তিনি কথা বলতে বলতে উত্তেজনায় তাঁর ব্যান্ডেজ বাঁধা হাত ওপরে তুলছিলেন। জানা যায়, তিনিও হামলার শিকার হয়েছেন সম্প্রতি। অপর এক কর্মকর্তা বন বিভাগকে আল্টিমেটাম বেঁধে দেন। তিনি বলেন, দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। সরকার দায় এড়াতে পারে না। তিন দিন আগে সাজ্জাদ মারা গেছেন।

অথচ আসামি গ্রেপ্তার হয়নি।

প্রধান বন সংরক্ষক সৈয়দ আমীর হোসেনের কাছে প্রশ্ন ছিল, তিনি কি মনে করেন, তাঁর কর্মীরা ঝুঁকিতে আছেন? জবাবে তিনি বলেন, ‘আপনার কি সন্দেহ হয়? বন, বন্য প্রাণী ও বনভূমি রক্ষা করা অত্যন্ত দুরূহ কাজ। দিনের বেলায় দুষ্কৃতকারীরা বনে ঢোকে না। রাতের আঁধারে ঢুকে বন কাটে, বনভূমি দখল করে, পাহাড় কাটে। এসব কাজ খুব ঝুঁকির। আমার কর্মীরা ঝুঁকির মধ্য রয়েছেন।’

ওই একই মানববন্ধনে সরকার যাঁদের চিনেও না চেনার ভান করে, এমন একজনের কথা উল্লেখ করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, চট্টগ্রামের আকবর শাহ এলাকায় পাহাড় কাটায় নাম এসেছে কাউন্সিলর জহুরুল আলম জসিমের। ওই এলাকায় তিনি একটা সিসি ক্যামেরা বসিয়ে নিয়েছেন যেন কেউ এসে ছবি তুলে প্রকাশ করতে না পারেন।

বাবা হত্যার বিচার কি পাবে শিশু সাদিকা—এ প্রশ্নের উত্তর কার কাছে আছে?

পত্র-পত্রিকার খবর হলো, আকবর শাহ এলাকার বিশ্ব কলোনি, ফিরোজ শাহ, লেকসিটি এলাকা, ফয়েজ লেক এলাকার ১,২, ৩ নম্বর ঝিলসহ বিভিন্ন এলাকায় রেলওয়ে ও খাসজমির পাহাড় কেটে প্লট গড়েছেন জসিম। আবার অন্যদেরও পাহাড় কাটতে সহায়তা দেন তিনি।

বনখেকো আর পাহাড়খেকোদের পোয়াবারো। তাদের মধ্যে তথাকথিত জনপ্রতিনিধি আছেন। তাদের সঙ্গে ডাম্পার, পিকআপ আছে, টাকা আছে, তাদের সিসি ক্যামেরা লাগিয়ে অন্যকে ভয় দেখিয়ে পাহাড় কেটে নেওয়ার হিম্মত আছে।

এই হিম্মত জোগায় কারা? ওদের পেছনে কারা? তারা কোন সরকার? বনখেকোদের ঠেকাতে বন বিভাগ মামলার পর মামলা করে চলেছে। কত মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে, কতজনের সাজা হয়েছে, তাৎক্ষণিকভাবে সে প্রশ্নের জবাব দিতে পারলেন না বন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। খুব যে অগ্রগতি হচ্ছে না, তারও প্রমাণ পাওয়া গেল। মহেশখালীতে সহকারী রেঞ্জ কর্মকর্তা ইউসুফ উদ্দীন হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি। আসামিরা জামিনে বেরিয়ে গেছেন।

নাম না প্রকাশ করার শর্তে বন বিভাগের তরুণ একাধিক কর্মী প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা অনেক আশা আর স্বপ্ন নিয়ে বন রক্ষার প্রতিশ্রুতি নিয়ে কাজে নেমেছিলেন। সাজ্জাদের মৃত্যু তাঁদের অনেককেই হতোদ্যম করবে। যদি সাজ্জাদের হত্যাকারীদের বিচার না হয়, তাহলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বন বাঁচাতে অনেকেই হয়তো আর এগিয়ে যাবেন না।

সাজ্জাদের ভাই কামরুজ্জানান তাঁর ভাইয়ের স্ত্রী মুমতাহিনা সুমি ও নয় মাসের কন্যা সাদিকাকে সঙ্গে করে মানববন্ধনে অংশ নিয়েছিলেন। কামরুজ্জামান বলেন, ‘সাংবাদিক ভাইয়েরা, আপনারা আমার ভাইয়ের হত্যাকাণ্ডের বিষয়টা ধামাচাপা পড়তে দেবেন না। কিছুদিন পর সবাই ভুলে যাবে। আমি নিজেও একজন বাইকার। ওকে যেভাবে মারা হয়েছে, সেটা দুর্ঘটনা নয়, হত্যাকাণ্ড। আপনারা একটু দেখবেন।’

সাজ্জাদের স্ত্রী মুমতাহিনা সুমি সংসার করেছেন দুই বছর। তিনি কোনো কথা বলেননি, নীরবে কেঁদে গেছেন শুধু। কোনো এক স্বজনের কোলে সাজ্জাদের নয় মাস বয়সী শিশু কন্যা সাদিকাও তখন চিৎকার করে কাঁদছে। সাদিকা কি বাবা হত্যার বিচার চেয়ে রাস্তায় নামা সর্বকনিষ্ঠ মানুষ? এই পরিবারের কান্নায় কারও কি কিছু যায় আসে? সরকারেরই যখন নিরাপত্তা নেই, তখন এসব বেসরকারি মানুষের গুরুত্ব কী?

  • শেখ সাবিহা আলম প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক। ই-মেইল: sabiha.alam@prothomalo. com