১৬ জানুয়ারি ২০২২ সবগুলো পত্রিকা গুরুত্ব দিয়ে খবরটি ছেপেছে। খবরটির উৎস সাবেক প্রতাপশালী মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন। বর্তমানে ফরিদপুর-৩ আসনের এই সংসদ সদস্য দীর্ঘদিন সংসদের কার্যক্রমে অনুপস্থিত। এই প্রেক্ষাপটে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির পদ থেকে তাঁকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এই সংসদীয় কমিটির সবশেষ বৈঠক হয়েছিল গত বছরের ১৩ মার্চ। নিয়ম অনুযায়ী, প্রতি মাসে একবার সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক হওয়ার কথা।
এখন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি করা হয়েছে সংসদ সদস্য ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদকে। রোববার জাতীয় সংসদে এই স্থায়ী কমিটি পুনর্গঠন করা হয়। গত ২৪ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় সম্মেলনের পর গঠিত কমিটিতে দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যের পদ থেকেও খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে বাদ দেওয়া হয়।
গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, স্থানীয় রাজনীতি থেকে নির্বাসিত হওয়ার পর দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় সংসদের কাজেও নিষ্ক্রিয় আছেন খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তিনি সংসদ অধিবেশনে সবশেষ যোগ দিয়েছিলেন গত বছরের ৬ এপ্রিল। একসময় ফরিদপুরে আওয়ামী লীগের রাজনীতির এই নিয়ন্ত্রককে গত আড়াই বছরে নির্বাচনী এলাকায় দেখা গেছে মাত্র দুবার। তাঁর এই নিষ্ক্রিয়তায় সংসদীয় কমিটি যেমন অচল হয়ে পড়েছে, তেমনি নির্বাচনী এলাকার কিছু উন্নয়নকাজেও স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। খন্দকার মোশাররফ হোসেন বর্তমানে সুইজারল্যান্ডে।
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে ফরিদপুর-৩ আসন থেকে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন খন্দকার মোশাররফ হোসেন। ২০০৯ সালে তিনি প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী হন। এরপর ফরিদপুরে দলীয় রাজনীতিতে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। তাঁর অনুগত ব্যক্তিরা বিভিন্ন সরকারি সংস্থার উন্নয়নকাজের দরপত্র নিয়ন্ত্রণ, চাঁদাবাজি ও জমি দখল করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলেন।
সংবিধান অনুযায়ী, কোনো প্রকার কারণ দর্শানো ছাড়া টানা ৯০ কার্যদিবস সংসদে অনুপস্থিত থাকলে তাঁর আসন শূন্য হয়ে যায়। খন্দকার মোশাররফ হোসেনের অনুপস্থিতি এখনো ৯০ কার্যদিবস পূর্ণ হয়নি। প্রশ্ন হলো, তিনি কি স্পিকারকে তাঁর অনুপস্থিতির কোনো কারণ ব্যাখ্যা করে কোনো চিঠি দেবেন, না ৯০ দিনের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই দেশে ফিরে এসে সংসদে যোগ দেবেন?
২০১৪ সালে দ্বিতীয়বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তিনি এরপর স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনেও তিনি সংসদ সদস্য হন। তবে এবার তাঁকে কোনো মন্ত্রিত্ব দেওয়া হয়নি। তাঁকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি করা হয়েছিল।
ফরিদপুর আওয়ামী লীগের এক নেতার বাড়িতে হামলার ঘটনায় করা একটি মামলার সূত্র ধরে ২০২০ সালের ৭ জুন রাতে পুলিশের বিশেষ অভিযানে খন্দকার মোশাররফের অনুসারী আলোচিত দুই ভাই বরকত-রুবেল গ্রেপ্তার হন। এরপরই মূলত স্থানীয় রাজনীতি থেকে নির্বাসিত হন খন্দকার মোশাররফ। গত বছরের ৮ মার্চ অর্থ পাচার মামলায় মোশাররফের ভাই খন্দকার মোহতেশাম হোসেনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এর কিছুদিন পর থেকে জাতীয় সংসদের কাজেও পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় থাকেন এই সাবেক মন্ত্রী। গত বছরের এপ্রিলের শেষের দিকে তিনি সুইজারল্যান্ডে চলে যান।
খন্দকার মোশাররফের ভাই খন্দকার মোহতেশাম হোসেন, তাঁর অনুগত বরকত ও রুবেল এবং মোশাররফের ব্যক্তিগত সহকারী (তৎকালীন) এ এইচ এম ফোয়াদ এখন অর্থ পাচার মামলায় কারাগারে।
পত্রিকায় খন্দকার মোশাররফ হোসেনের খবরটি পড়ে কাজী নজরুল ইসলামের সেই বিখ্যাত গানের কথাই মনে পড়ল—চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ থেকে বাদ পড়ার পর সুইজারল্যান্ডে অবস্থান করা খন্দকার মোশাররফ টেলিফোনে সমকালকে জানিয়েছিলেন, তিনি রাজনীতি থেকে অবসর নিয়েছেন। সংসদীয় কমিটির সভাপতির পদ হারানোর পর তাঁর কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। প্রশ্ন উঠেছে, রাজনীতি থেকে অবসর নেওয়া কোনো ব্যক্তি কি সংসদে রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন। সংসদীয় কমিটির সভাপতি পদ হারানোর পর প্রথম আলোর ফরিদপুর প্রতিনিধি প্রবীর কান্তি বালার সঙ্গে কথা বলি। তাঁকে জিজ্ঞাসা করি, ফরিদপুর আওয়ামী লীগের নেতাদের প্রতিক্রিয়া কী? তিনি জানান, মোশাররফ হোসেনের অনুগত ব্যক্তিরা অনেক আগেই এলাকা ছাড়া। বর্তমানে যাঁরা জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাঁরা আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া জানাননি। তবে দু-একজন নেতা ব্যক্তিগত আলাপে বলেছেন, মোশাররফ হোসেন ক্ষমতায় থাকতে বাড়াবাড়ি করেছেন, মানুষকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছেন। এখন তারই ফল ভোগ করছেন।
সংবিধান অনুযায়ী, কোনো প্রকার কারণ দর্শানো ছাড়া টানা ৯০ কার্যদিবস সংসদে অনুপস্থিত থাকলে তাঁর আসন শূন্য হয়ে যায়। খন্দকার মোশাররফ হোসেনের অনুপস্থিতি এখনো ৯০ কার্যদিবস পূর্ণ হয়নি। প্রশ্ন হলো, তিনি কি স্পিকারকে তাঁর অনুপস্থিতির কোনো কারণ ব্যাখ্যা করে কোনো চিঠি দেবেন, না ৯০ দিনের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই দেশে ফিরে এসে সংসদে যোগ দেবেন?
রাজনীতি থেকে অবসর নেওয়া না নেওয়া মোশাররফ হোসেনের নিজের সিদ্ধান্তের বিষয়। কিন্তু তিনি যৌক্তিক কারণ ছাড়া তিনি যাঁদের ভোটে ‘নির্বাচিত’ হয়েছেন, তাঁদের সংসদে প্রতিনিধিত্ব থেকে বঞ্চিত করতে পারেন না।
আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে রুবেল-বরকত স্বীকার করেছেন, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, অন্যের বাড়ি, জমি দখলসহ নানা অপকর্মের মাধ্যমে দুই হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। এসব কাজে তাঁরা সাবেক মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছেন বলে প্রথম আলোর অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। মোশাররফ হোসেন জেলা আওয়ামী লীগের ১ নম্বর সদস্য এবং কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য। মন্ত্রী থাকাকালে তাঁর দাপটে ফরিদপুরে কেউ টুঁ-শব্দ করতে পারতেন না। তাঁর বিশ্বস্ত শাগরেদ হলেন রুবেল-বরকত। জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতির বাড়িতে হামলার কারণ হলো সাবেক মন্ত্রীর বাড়িতে আয়োজিত মিলাদ মাহফিলে গরহাজির থাকা। এত বড় বেয়াদবি তাঁরা কীভাবে মেনে নেন? হামলার সময় সুবল ও তাঁর স্ত্রী মন্ত্রীর বাড়িতে প্রতিকার চাইতে গিয়েও তাঁর দেখা পাননি।
ফরিদপুরের এই কাণ্ড আরও একটি ঘটনার কথা মনে করিয়ে দেয়। ২০১৫ সালের ৬ আগস্ট হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করছিলেন, ভাজনডাঙ্গার জমিদার সতীশ চন্দ্র গুহ মজুমদারের বাড়ি দখলে নিয়ে পুরোনো ভবন গুঁড়িয়ে দিয়েছেন মন্ত্রিসভার প্রভাবশালী এক মন্ত্রী। সাংবাদিকেরা প্রভাবশালী ওই মন্ত্রীর নাম জানতে চাইলে রানা দাশগুপ্ত বলেন, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের নাম গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। ফরিদপুর জেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অলক সেন। ওই সংবাদ সম্মেলনের পর দুর্বৃত্তরা তাঁকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করেন। তিনি দীর্ঘদিন হাসপাতালে ছিলেন।
হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের একজন নেতা আলাপ প্রসঙ্গে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে যে ৩১ জন সংসদ সদস্যকে মনোনয়ন না দেওয়ার জন্য তাঁরা আওয়ামী লীগকে অনুরোধ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে খন্দকার মোশাররফ হোসেনের নামও ছিল।
গত বছর ১১ মার্চ ‘মন্ত্রীর ভাই যখন মি. ফিফটিন পার্সেন্ট’ নামে আরেক কলামে লিখেছিলাম: আওয়ামী লীগের কোনো নেতার দুর্নীতি নিয়ে বাইরের কেউ সমালোচনা করলে দলের নেতারা রইরই করে ওঠেন। সরকারের বদনাম করতে ও উন্নয়নের গতি থামিয়ে দিতে এসব অপপ্রচার চালানো হচ্ছে বলে তাঁরা মাঠ গরম করেন। কিন্তু এবার সরকারের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বললেন, ফরিদপুর আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ভাই খন্দকার মোহতেশাম সব কাজে ১৫ শতাংশ কমিশন নিতেন। তিনি পরিচিত ছিলেন ‘মি. ১৫ শতাংশ’ হিসেবে।
প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য কাজী নজরুল ইসলামের গানটি পুরো তুলে দিলাম। তাঁরা এই গানের কথার সঙ্গে ফরিদপুরের সাবেক মন্ত্রীর অতীত ও বর্তমান মিলিয়ে নিতে পারেন।
চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়।
আজিকে যে রাজাধিরাজ কাল সে ভিক্ষা চায়॥
অবতার শ্রীরামচন্দ্র যে জানকীর পতি
তার ও হ’ল বনবাস রাবণ করে দুর্গতি।
আগুনেও পুড়িল না ললাটের লেখা হায়॥
স্বামী পঞ্চ–পাণ্ডব, সখা কৃষ্ণ–ভগবান,
দুঃশাসন করে তবু দ্রৌপদীর অপমান।
পুত্র তার হ’ল হত যদুপতি যা’র সহায়॥
মহারাজা হরিশ্চন্দ্র রাজ্যদান ক’রে শেষ
শ্মশান-রক্ষী হ’য়ে লভিল চণ্ডাল বেশ।
বিষ্ণু-বুকে চরণ-চিহ্ন, ললাট-লেখা কে খণ্ডায়॥
● সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan55@gmail.com