টাঙ্গাইলের পাথরাইলে শাড়িতে নকশার কাজে ব্যস্ত এক নারী
টাঙ্গাইলের পাথরাইলে শাড়িতে নকশার কাজে ব্যস্ত এক নারী

অভিমত

টাঙ্গাইল শাড়ি কীভাবে ভারতের হয়

আমাদের কাছে ঐতিহ্য বিষয়টিই যেন জৌলুশ হারানো কোনো চরিত্র বা ইতিহাসের বেদনা বয়ে বেড়ানো কোনো ধ্বংসস্তূপ। সেটির মাঝে প্রাণ সঞ্চার করা বা পরম মমতায় লালন করে যাওয়া বা গৌরবের সঙ্গে আঁকড়ে ধরে রাখার বিষয়টি যেন বেমানান। ফলে কত ঐতিহ্য নিত্যক্ষয় হয়ে যায়, মানুষের চিন্তা-মনন থেকেও ধীরে ধীরে মুছে যায়, তার খবর কে রাখে!

তাঁতশিল্প হচ্ছে আমাদের এমনই এক ঐতিহ্য। সেই ঐতিহ্যের ভেতরেও আছে ক্ষয় হয়ে যাওয়া বা ক্ষয়িষ্ণু আরও ঐতিহ্য—জামদানি, মসলিন, টাঙ্গাইল শাড়ি ইত্যাদি। কত হাজার তাঁত বন্ধ হয়ে যায়, কত লাখ তাঁতশ্রমিক বেকার হয়ে যান, কত তাঁতি নিজের পূর্বপুরুষের ভিটা ফেলে ভারতে পাড়ি জমান, সেখানে নতুন করে সাজায় তাঁতঘর, তাতে কার কী আসে-যায়!

গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের বিখ্যাত টাঙ্গাইল শাড়িকে নিজস্ব জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ভারতের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়। ভারতের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় তাদের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এক পোস্টে বলে, ‘‌টাঙ্গাইল শাড়ি পশ্চিমবঙ্গ থেকে উদ্ভূত। এটি ঐতিহ্যবাহী হাতে বোনা মাস্টারপিস। এর মিহি গঠন, বৈচিত্র্যময় রং এবং সূক্ষ্ম জামদানি মোটিফের জন্য বিখ্যাত। এটি এ অঞ্চলের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক।’

স্বাভাবিকভাবেই ভারতের এ ঘোষণায় বাংলাদেশের মানুষের ক্ষুব্ধ হওয়ার কথা। বাংলাদেশের হাজারো মানুষ ভারতের মন্ত্রণালয়টির ফেসবুক পোস্টের নিচে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। সেই প্রতিবাদে বাংলাদেশের নির্বাচনে ভারতের প্রভাব, সীমান্ত হত্যাসহ আরও অনেক বিষয় মিলেমিশে একাকার। সবারই একটিই প্রশ্ন, টাঙ্গাইল শাড়ি কীভাবে ভারতের হয়? এ দাবি ভারত করতে পারে কি না?

টাঙ্গাইল শাড়ির সঙ্গেই এর নির্দিষ্ট ভূখণ্ড বা ভৌগোলিক অবস্থান যুক্ত। মানে এটি এমন একটি শাড়ি, যার উৎপত্তিই হচ্ছে টাঙ্গাইলে। আর এই টাঙ্গাইল হচ্ছে বাংলাদেশের একটি জেলা।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ জাতীয় কারুশিল্প পরিষদের সভাপতি চন্দ্র শেখর সাহার সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই স্বত্বের দাবি কোনোভাবেই ভারত করতে পারে না। কারণ, ভৌগোলিকভাবে টাঙ্গাইল কোনোকালেই পশ্চিমবঙ্গের ছিল না। তারা অন্য নামে তাদের শাড়ির জিআই স্বীকৃতি দিতে পারে, কিন্তু সেটির সঙ্গে টাঙ্গাইল নাম থাকলে কোনোভাবে যৌক্তিক হবে না।

জিআই স্বীকৃতি কী

কোনো একটি দেশের নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের মাটি, পানি, আবহাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সেখানকার জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি যদি কোনো একটি পণ্য উৎপাদনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তাহলে সেটিকে সেই দেশের জিআই (জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। দেশে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন পাস হয় ২০১৩ সালে।

২০১৫ সালে আইনের বিধিমালা তৈরির পর জিআই পণ্যের স্বীকৃতি দিয়ে আসছে ডিজাইন, পেটেন্ট ও ট্রেড মার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি)। ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউআইপিও) নিয়ম মেনে পণ্যের স্বীকৃতি ও সনদ দিয়ে থাকে সরকারের এ বিভাগটি। এখন পর্যন্ত দেশে জামদানি, ইলিশ, রাজশাহীর সিল্ক, বগুড়ার দই, বাগদা চিংড়ি, কালিজিরা চালসহ ২১টি পণ্য জিআই স্বীকৃতি পেয়েছে।

কোনো একটি পণ্য চেনার জন্য জিআই স্বীকৃতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জিআই স্বীকৃতি পাওয়া পণ্যগুলো অন্য দেশের সমজাতীয় পণ্য থেকে আলাদাভাবে চেনা যায়। এর ফলে ওই পণ্যের আলাদা গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়।

ডিপিডিটি কর্মকর্তারা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় জিআই পণ্য এগিয়ে থাকে। ২০-৩০ শতাংশ পর্যন্ত এর বাড়তি দাম পাওয়া যায়। তাদের ব্যবসায়ীরা বলেছেন, জিআই স্বীকৃতি পাওয়ার পর পণ্যগুলোর রপ্তানির পরিমাণ বেড়েছে।

টাঙ্গাইল শাড়ির ইতিহাসবৃত্তান্ত

প্রাচীন আমল থেকে এ দেশের কৃষির পর গ্রামীণ অর্থনীতির সবচেয়ে বড় ভিত ছিল তাঁতশিল্প। বিশ্ববিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্ত রিহলাতে বাংলার তাঁতবস্ত্রের কথা উল্লেখ করেন।

এ ভ্রমণবৃত্তান্ত জানাচ্ছে, সেই সময় সুতি কাপড় ছিল বাংলার অন্যতম রপ্তানি পণ্য। সোনারগাঁ থেকে দিল্লির সুলতানের দূত হিসেবে চীন যাওয়ার পথে ইবনে বতুতা কিছু মুসলিম অধিবাসীর দেখা পান, যাঁরা বাংলা অঞ্চল থেকে উন্নত সুতিবস্ত্র এনে নানা জায়গায় বিক্রি করেন।

ইবনে বতুতার এ ভ্রমণবৃত্তান্ত ছিল ১৪ শতকের। এ থেকে ধারণা করা যায়, এ অঞ্চলের তাঁতের বয়স কত প্রাচীন।

বাংলার এ নিজস্ব পোশাক তৈরির ঐতিহ্যের রক্ষাকবচে প্রথম আঘাত আসে ব্রিটিশ আমলে। সে সময় ইংল্যান্ডের ল্যাঙ্কাশায়ারের মেশিনে তৈরি কাপড়ের প্রসার ঘটে এ অঞ্চলে।

তবে ১৯০৬ সালে মহাত্মা গান্ধী স্বদেশি আন্দোলনের মাধ্যমে ব্রিটিশদের মেশিনে তৈরি কাপড়ের বর্জনের ডাক দিলে ঘুরে দাঁড়ায় বাংলার তাঁতবস্ত্র। সে সময়টাতে পুরান ঢাকাসহ সোনারগাঁ ও আশপাশের অঞ্চল থেকে তাঁতশিল্পের প্রসার ঘটে টাঙ্গাইলসহ আরও অনেক জায়গায়।

টাঙ্গাইল শাড়িকে ভারত নিজেদের দাবি করার পর এমন সমালোচনা ওঠেছে, বাংলাদেশ এতদিন কী করেছে? এখানে বাংলাদেশ সরকারের ব্যর্থতার বিষয়টিও চলে আসে। অনেকে মনে করছেন, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও কর্তৃপক্ষগুলোর অবহেলা, উদাসীনতা ও দায়িত্বহীনতার কারণে বাংলার ঐতিহ্যবাহী তাঁতবস্ত্র টাঙ্গাইল শাড়ির দাবি বাংলাদেশ থেকে হাতছাড়া হয়ে গেল।

টাঙ্গাইলের মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন গবেষকের ‘স্ট্যাটাস অব হ্যান্ডলুম ওয়ার্কার্স অ্যান্ড কজেস অব দেয়ার মাইগ্রেশন: আ স্টাডি ইন হ্যান্ডলুম ইন্ডাস্ট্রি অব টাঙ্গাইল ডিস্ট্রিক্ট, বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি গবেষণাপত্রে টাঙ্গাইলে তাঁতের প্রসার সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হয়েছে।

তবে সুব্রত ব্যানার্জি, মো. মনিরুজ্জামান মুজিব ও সুমনা শারমীনের এ যৌথ গবেষণাটি মূলত টাঙ্গাইলের তাঁতিদের ভারতে অভিবাসী হওয়া নিয়ে একটি মাঠ পর্যালোচনা।

ঐতিহাসিকভাবে টাঙ্গাইল শাড়ির তৈরির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের তাঁতিরা। পরে এ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হন মুসলিমরাও। তবে টাঙ্গাইলের পাথরাইল ইউনিয়নের হিন্দুদের বসাক সম্প্রদায়ের অবদান আলাদাভাবে উচ্চারিত হয়।

এ ব্যাপারে টাঙ্গাইল শাড়ি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি রঘুনাথ বসাকের সঙ্গে কথা হয়। বংশ পরম্পরায় পাঁচ–সাত পুরুষ ধরে তাঁর পরিবার তাঁত বুনে আসছেন। তাঁর দাবি, টাঙ্গাইল শাড়ির ঐতিহ্য অন্তত পাঁচ শ বছর।

তিনি বলেন, ‘বসাক হিন্দুদের কোনো সম্প্রদায়ের জাত-পদবি নয়। বসে বসে তাঁতের কাজ করার কারণে তাঁদের পদবি বসাক হয়ে ওঠে। মূলত তাঁত বোনা হিন্দুদের জাত-পদবি হচ্ছে তন্তুবায়।’

তাঁতের দুর্দিন ও তাঁতিদের অভিবাসন

২০১৪ সালে রিসার্চ অন হিউম্যানিটিজ অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সেস জার্নালে প্রকাশিত তিন গবেষকের গবেষণাপত্রটি বলছে, সাম্প্রদায়িক সহিংসতার শিকার হওয়ার ভীতি, কাঁচামালের খরচ কয়েক গুণ বেড়ে যাওয়া, সরকারের কাছ থেকে ঋণ না পাওয়া, পণ্য পরিবহনে সংকট, ব্যবসায়িক নিরাপত্তার অভাবের কারণে হিন্দু তাঁতিরা ধীরে ধীরে এ দেশ থেকে ভারতে অভিবাসী হন।

দেশভাগ ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পর এ অভিবাসনে বড় ধাক্কাটি আসে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর। গবষণাপত্রটিতে এর একটি নমুনা পাওয়া যায়। যেমন, পাথরাইলের নলশোধা গ্রামে স্বাধীনতার পরেও ৩ হাজার ২০০ হিন্দু তাঁতি পরিবার ছিল, কয়েক দশকের মধ্যে সেটি গিয়ে দাঁড়ায় মাত্র ২২ পরিবারে।

তবে এটিও গুরুত্বপূর্ণ যে ভারত সরকারের নানা সুযোগ-সুবিধা ও ঋণের সহজলভ্যতা সে দেশে টাঙ্গাইল শাড়ির তাঁতশিল্প প্রসারে বড় ভূমিকা রাখে। এ কারণে সে দেশে যেতে আকৃষ্ট হন হিন্দু তাঁতিরা।

পত্রিকান্তরে জানা যাচ্ছে, গত দুই-আড়াই দশকে হাজার হাজার তাঁত ইউনিট বন্ধ হয়ে যায় টাঙ্গাইলে। ২০০৬ সালের ৮ আগস্ট বিডিনিউজটুয়েন্টফোর এক প্রতিবেদন বলছে, টাঙ্গাইলের কালিহাতীর বল্লা–রামপুরে গত চার মাসে অন্তত পাঁচ হাজার তাঁত ইউনিট বন্ধ হয়ে গেছে। তবে করোনা মহামারির ধাক্কা টাঙ্গাইলের তাঁত শিল্পের মন্দা আরও বাড়িয়ে দেয়।

সংবাদমাধ্যমের আরও কিছু শিরোনাম— টাঙ্গাইলের ৬০ ভাগ তাঁতকল বন্ধ, নেই শাড়ি তৈরির ধুম (ঢাকা পোস্ট, ২৮ এপ্রিল, ২০২২),  লোডশেডিংয়ে বিপদে টাঙ্গাইলের তাঁত শিল্প, ঋণ পরিশোধই চ্যালেঞ্জ (বিডিনিউজটুয়েন্টফোর, ৪ জুলাই ২০২৩), করোনা ও বন্যায় টাঙ্গাইলের তাঁতশিল্প অস্তিত্ব সংকটে (দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ৮ আগস্ট ২০২০), টাঙ্গাইলে তাঁতিদের পথে বসার উপক্রম (প্রথম আলো, ২২ এপ্রিল, ২০২১)

কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি, পুঁজি সংকট, আশানুরূপ বিক্রি না হওয়া বা আগের মতো চাহিদা না থাকা মানে বাজারজাতকরণে সমস্যা এবং শিল্প পুনরোদ্ধারে সরকারের অবহেলার বিষয়গুলো ঘুরেফিরে এসেছে এসব প্রতিবেদনে।

রঘুনাথ বসাক বলেন, টাঙ্গাইলের তাঁতি সম্প্রদায়ের ওপর বারবার অভাবের আঘাত আসে। বিশেষ করে পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষ ছিল এখানে বড় একটি ধাক্কা। আশির দশকে প্রেসিডেন্ট সাত্তারের আমলে তাঁতিদের ঘরে শাড়ি ছিল কিন্তু ভাত ছিল না। এসব দুঃসময়ে ধাপে ধাপে তাঁতিদের বড় একটি অংশ ভারতে চলে যান। সাম্প্রদায়িক হানাহানির কারণেও অনেক তাঁতি চলে যান।

তিনি আরও বলেন, পশ্চিমবঙ্গ সরকার এসব তাঁতিকে সুতা, ঋণসুবিধা ও পৃষ্ঠপোষকতা দেয়। তারাও তাদের শাড়ির নাম দেয় টাঙ্গাইল শাড়ি এবং সরকারের বিভিন্ন সংস্থা সেসব শাড়ি কিনে নিত। আর এখানে তাঁতিদের প্রতি সরকারের সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাব ছিল সব সময়। তিনি বলেন, ‘এখন টাঙ্গাইলের তাঁতিদের মধ্যে ৬০ শতাংশেরও বেশি হচ্ছে মুসলিম সম্প্রদায়ের।’

তবে টাঙ্গাইল শাড়ি নিয়ে কয়েক দশক ধরে কাজ করা ঢাকার পোশাক প্রস্তুত ও বিপণন প্রতিষ্ঠান প্রবর্তনার পরিচালক শাহিদ হোসেন শামীম বলছেন, তাঁতিরা পশ্চিমবঙ্গে গেলেও তাদের পরবর্তী প্রজন্মের অধিকাংশই সেই পেশায় থাকেননি। শিক্ষাদীক্ষায় অগ্রগতির ফলে তাদের অনেকে আরও উন্নত পেশায় চলে গেছেন, যেমন কেউ হয়েছেন প্রকৌশলী, কেউ চিকিৎসক বা কেউ শিক্ষক। এখন পশ্চিমবঙ্গে বসাক সম্প্রদায়ের কেউ সেই অর্থে টাঙ্গাইল শাড়ি বোনেন না। সেখানে অন্য তাঁতিরা বরং স্থানীয় ঐতিহ্যের কিছু শাড়িকে এখন টাঙ্গাইল শাড়ি নামে চালান।

তিনি বলেন, এখনো প্রতি সপ্তাহে ট্রাকে করে টাঙ্গাইল শাড়ি বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে রপ্তানি হয়। ২০১৪ সালের গবেষণাপত্রটিও বলছে, প্রতি সপ্তাহে ভারতে যাওয়া সে শাড়ির সংখ্যা ৫০ হাজার পিস।

ভারতের দাবি কতটা যৌক্তিক

ভারত সরকারের জিআই জার্নাল নং-১৭৮ এ বলা হয়েছে, বাংলা (পশ্চিমবঙ্গ) টাঙ্গাইল শাড়ি পূর্ববঙ্গের (বর্তমানে বাংলাদেশ) টাঙ্গাইল থেকে আসেনি। এটি বরং শান্তিপুর নকশা ও ঢাকা-টাঙ্গাইলের একটি হাইব্রিড বা সংকর।

এখন সেই শাড়িকে টাঙ্গাইল শাড়ি নামে ভারত জিআই স্বীকৃতি দিতে পারে কী না। এ বিষয়ে রঘুনাথ বসাক বলেন, ‘এখন আমার পরিবারের কেউ আমেরিকায় গিয়ে শাড়ি তৈরি করা শুরু করল। সেটি কি কখনো টাঙ্গাইলের শাড়ি হতে পারে? সেই শাড়ির নাম অন্য কিছু হতে পারে, কিন্তু টাঙ্গাইলের শাড়ি কোনোভাবেই নয়।’

চন্দ্র শেখর সাহা বলেন, ‘এখন রোহিঙ্গারা যদি তাদের দেশে ফেরত যেতে না পারে, পরবর্তী সময়ে তাদের কোনো ঐতিহ্যকে কি আমরা নিজেদের বলে দাবি করতে পারব?’

এর আগে বাংলাদেশে জিআই স্বীকৃতি পাওয়া নকশিকাঁথা, জামদানি ও ফজলি আমকে নিজেদের পণ্য বলে দাবি করে ভারত। অতীতে বাংলাদেশ ও ভারত একই ভূখণ্ড থাকায় এ সমস্যাগুলো তৈরি হচ্ছে বলে দৈনিক বণিক বার্তাকে বলেন, যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টারবিষয়ক পিএইচডি গবেষক মো. আতাউল করিম।

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ও ভারত ভৌগোলিকভাবে দীর্ঘদিন একই সঙ্গে অবস্থান করায় দুই দেশের মধ্যে সংস্কৃতি বিনিময় হয়েছে। এতে কিছু বিষয়ের উৎপত্তি নিয়ে ঘোলাটে অবস্থা তৈরি হয়। সে ক্ষেত্রে ইতিহাস পাঠ করে সেগুলোর মীমাংসা করতে হয়। জিআই পণ্যের স্বীকৃতির বেলায়ও এর ব্যতিক্রম নয়। এসব পণ্যকে বলা হয় হোমোনেমাস জিআই। এ ধরনের পণ্যে দুই দেশই জিআই স্বত্ব নিতে পারে। তবে কোনো একটি পণ্যের দাবি করা নিয়ে যদি বাজারে মিসলিডিং বা কনজিউমার কনফিউশন তৈরি হয়, সে ক্ষেত্রে একাধিক দেশ দাবি করতে পারবে না।’

দেশের বিভিন্ন প্রান্তের পণ্য বা ঐতিহ্য কম নয়। গত ১০ বছরে মাত্র ১১টি পণ্যের জিআই স্বীকৃতি হয়েছে। তবে ২০২৩ সালে এক বছরেই ১০টি পণ্যের স্বীকৃতি মিলেছে। দেশের প্রথম জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধন পায় জামদানি। তবে জামদানি শাড়ি এবং ইলিশ প্রায় হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছিল। ভারতের ‘জামদানি’ জিআই স্বীকৃতি পেতে যাচ্ছিল। পরে অবশ্য ওই জামদানি ‘উপধা জামদানি’ হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

তাঁত বোর্ড কী করছে

টাঙ্গাইল শাড়িকে ভারত নিজেদের দাবি করার পর এমন সমালোচনা ওঠেছে, বাংলাদেশ এতদিন কী করেছে? অনেকে মনে করছেন, সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও কর্তৃপক্ষগুলোর অবহেলা, উদাসীনতা ও দায়িত্বহীনতার কারণে বাংলার ঐতিহ্যবাহী তাঁতবস্ত্র টাঙ্গাইল শাড়ির দাবি বাংলাদেশ থেকে হাতছাড়া হয়ে গেল।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের সদস্য (এসঅ্যান্ডএম) যুগ্ম সচিব দেবাশীষ নাগের সঙ্গে কথা হয়। তিনি দেশের তাঁতপণ্যের জিআই স্বীকৃতির জন্য বোর্ডের একটি কমিটির আহ্বায়ক। তিনি বলেন, মাস দুয়েক আগে তিনি বোর্ডে যোগ দিয়েছেন। এ-সংক্রান্ত একটি কমিটি ছিল, তিনি জানতেন না। তবে বোর্ডের চেয়ারম্যানের আহ্বানে সপ্তাহ দুয়েক আগে তাঁরা কমিটির একটি মিটিং করেন। সেখানে টাঙ্গাইল শাড়িসহ আরও তাঁতপণ্যের জিআই স্বীকৃতির জন্য আলোচনা হয়েছে। নানা তথ্য–উপাত্ত, নমুনা সংগ্রহের জন্য সাবকমিটি করে দেওয়া হয়েছে। তাঁরা দ্রুত কাজ করছেন।

বাংলাদেশ জাতীয় কারুশিল্প পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শেখ সাইফুর রহমান বলেন, টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই স্বীকৃতি নিয়ে ভারত যা করেছে, তা মেনে নেওয়ার সুযোগ নেই। জামদানির জিআই হাতছাড়া হওয়ার পর থেকে তারা সুযোগ খুঁজছিল।

তিনি বলেন, ‘গত মাসে ভারতের এ কার্যক্রমের বিষয়টি জানতে তাঁত বোর্ডের চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করলে বুঝতে পারি, তিনি এ-সংক্রান্ত কিছুই জানেন না। এমনকি তাঁত বোর্ডের জিআই পণ্যের আবেদনবিষয়ক কমিটির অনেকেও জানেন না এবং এ-সংক্রান্ত ফাইল দুই মাস ধরে পড়ে আছে। ফলে ভারতের কাছে আপত্তি বা আবেদন জানানোর সুযোগ থাকলেও তা করা যায়নি।’

তবে বাংলাদেশেরও টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই স্বীকৃতি পাওয়ার সুযোগ আছে বলে জানিয়েছেন ডিজাইন, পেটেন্ট ও ট্রেড মার্কস অধিদপ্তরের (ডিপিডিটি) মো. রাশিদুল মান্নাফ কবীর।

তিনি বলেন, ‘তখন এটি হবে বাংলাদেশের টাঙ্গাইল শাড়ি বা আলাদা করে দেশের নাম উল্লেখ থাকবে।’

কিন্তু টাঙ্গাইল যেহেতু বাংলাদেশের জেলা, এর নামে সুখ্যাতি পাওয়া কোনো পণ্যের জিআই স্বীকৃতি অন্য কেউ দাবি করতে পারে কি না, এর জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার জানামতে, টাঙ্গাইল নামে ভারতের কোনো জায়গার নাম নেই। অন্য দেশের কোনো এলাকার নামে পণ্য জিআই স্বীকৃতি দেওয়া আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী।

  • রাফসান গালিব প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী। ই–মেইল: rafsangalib1990@gmail.com