ছাত্রলীগের নৈরাজ্য, প্রশাসন কেন ‘মিউচুয়াল’ নীতিতে চলবে?

অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতার বিচারের দাবিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবক এবং অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থী মানববন্ধন করেন
ছবি : প্রথম আলো

সাম্প্রতিক সময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে জাতীয় সংবাদপত্রগুলো যেসব সংবাদ ছাপে, তার অধিকাংশের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে জড়িয়ে থাকে ছাত্রলীগের নাম। এসব সংবাদের মধ্যে আছে কখনো ছাত্রলীগের চাঁদাবাজি, কখনো সিট-বাণিজ্য, কখনো সাধারণ শিক্ষার্থীকে মারধর করে হল থেকে বের করে দেওয়া, কখনোবা বাকি খেয়ে টাকা পরিশোধ না করা কিংবা মাদক ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ততা।

এসব ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে দৃশ্যমান কোনো কঠোর অবস্থানে যেতে দেখা যায় না। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দোষী ব্যক্তিদের বিচারের মুখোমুখি করে ঘটনার প্রতিকারের চেয়ে বরং ঘটনাগুলো ‘মিউচুয়াল’ বা মিটমাট করার নীতির প্রতি প্রশাসনকে বেশি আগ্রহী বলে মনে হয়।

কোনো অভিযোগ এলে বরাবরের মতো দেখা যায়, প্রশাসনের হস্তক্ষেপে ঘটনাগুলো ‘মিউচুয়াল’ বা মিটমাট হয়ে যায়। যার ফল দাঁড়ায় অভিযোগকারী অভিযোগ তুলে নেন কিংবা ভুল-বোঝাবুঝি হয়েছে বা সব মিটমাট হয়ে গেছে বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অভিযোগকারী নিজেই সবাইকে জানিয়ে দেন।

তবে কখনো কখনো বড়জোর তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। কিন্তু হতাশাজনকভাবে এসব তদন্তের প্রতিবেদন হিমঘরেই থেকে যায়। এভাবে অপরাধীদের সঙ্গে ‘মিউচুয়াল’ আর আপস করায় একদিকে অপরাধ যেমন সংক্রমিত হচ্ছে, তেমনি অপরাধীরা দিনে দিনে বেপরোয়া হয়ে উঠছে। অন্যদিকে প্রশাসনের এ অসহায়ত্ব কিংবা নমনীয়তা সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভয়ের সঞ্চার করছে। যারা সাহস করে প্রশাসনের কাছে বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অভিযোগ করছে, তাদের মধ্যে হতাশা বাড়ছে। অন্যরা অভিযোগ দেওয়া থেকে পিছিয়ে আসছে।

পত্রিকা মারফত জানা গেল, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোয় ছাত্রলীগের চাঁদাবাজি, মারধর, ভয়ভীতি প্রদর্শন ও সিট-বাণিজ্যের অভিযোগ ঘিরে গত ২০২১ ও ২০২২ সালে অন্তত ১৩টি তদন্ত কমিটি হয়েছে। যার মধ্যে ৬টির তদন্ত প্রতিবেদন জমা হলেও সেগুলো জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়নি কিংবা কোনো ঘটনায় ছাত্রলীগের কাউকে শাস্তির আওতায় আনা হয়নি। বিষয়টি নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং অভিভাবক মহলে হতাশা এবং উদ্বেগ বিরাজ করছে। এমনকি তদন্ত কমিটির কোনো কোনো সদস্য প্রশাসনের এই নীরবতায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

গত আগস্টে চাঁদার দাবিতে মতিহার হলের আবাসিক শিক্ষার্থী অর্থনীতি বিভাগের সামছুল ইসলামকে একই হলের ছাত্রলীগ নেতা তার কক্ষে ডেকে নিয়ে তার ওপর নির্যাতন চালায় এবং ‘কাউকে বললে আবরারের যে অবস্থা হয়েছে, সেই অবস্থা হবে’ বলে হুমকি দেয়। নির্যাতনে তার কানের পর্দা ফেটে গেলে দীর্ঘদিন চিকিৎসা নিতে হয়। সেই ঘটনায় অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতার বিচারের দাবিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবক এবং অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থী মানববন্ধন করেন।

একটি মহল দিনের পর দিন নৈরাজ্য চালিয়ে যাবে আর প্রশাসন ‘মিউচুয়াল’-এর নীতি অবলম্বন করে সবকিছু হিমঘরে পাঠিয়ে দেবে—এটি কোনোভাবেই কাম্য নয়। এই প্রশাসনিক অনৈতিক চর্চা বিশ্ববিদ্যালয় চরিত্রের সঙ্গে মানায় না। বিশ্ববিদ্যালয়কে সত্যিকার অর্থে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বরূপে ফিরিয়ে আনতে হলে শিক্ষার্থীদের নির্বিঘ্ন জ্ঞান অন্বেষণ এবং জ্ঞানচর্চার উপযুক্ত পরিবেশ বজায় রাখতে হলে প্রশাসনকে অবশ্যই ছাত্রলীগ তোষণ-পোষণনীতি কিংবা ‘ওরা তো আমাদেরই ছেলে’—এই মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।

প্রশাসন তদন্ত কমিটি করলেও তার প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি, এমনকি সেই শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও নেয়নি। শুধু অর্থনীতির সামছুল নয়, রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী মো. মুন্না ইসলাম, তথ্য ও হিসাববিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মো. আল-আমিন, পরিসংখ্যান বিভাগের আকিব জাভেদসহ এমন অনেক সাধারণ শিক্ষার্থী ছাত্রলীগের নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তাদের অনেকে সাহস করে অভিযোগ করেছে অনেকে প্রাণভয়ে মুখ বুজে সহ্য করে গেছে।

গত বছর মুন্না ইসলামের ওপর নির্যাতন এবং তাকে হল থেকে বের করে দেওয়ার কথা শুনে তার শিক্ষক এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির তদানীন্তন সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক কুদরাত-ই-জাহানসহ আরও কিছু শিক্ষক হলে উপস্থিত হয়ে এ ব্যাপারে হলের প্রাধ্যক্ষ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের সঙ্গে কথা বলেন। তাঁরা তদন্ত করে দোষীদের উপযুক্ত শাস্তির আশ্বাস দিলেও সেই তদন্ত প্রতিবেদন আজ অবধি অজানা।

সর্বশেষ ১৯ জানুয়ারি এই তালিকায় যুক্ত হয়েছে ফোকলোর বিভাগের শিক্ষার্থী মো. সামিউল ইসলাম এবং অর্থনীতি বিভাগের শাহীন আলম। ভুক্তভোগী দুজনই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার নামের একটি গ্রুপে অভিযোগ করে। তাদের মধ্যে সামিউলের কাছ থেকে জোর করে টাকা কেড়ে নেওয়া, মারধর এবং প্রাণনাশের হুমকির অভিযোগ ওঠে। আর শাহীনকে হুমকি আর ভয়ভীতি দেখিয়ে জোর করে তার কক্ষ থেকে বের করে দেওয়া হয়। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে, তারা দুজনই সংশ্লিষ্ট হলের ছাত্রলীগের নেতা। শাহীনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় হল প্রশাসনের হস্তক্ষেপে দ্রুত বিষয়টি মিটমাট হয়ে যায়।

একটি বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে শিক্ষার্থীদের প্রধান লক্ষ্য জ্ঞান অর্জন এবং জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে নিজেদের পরিশীলিত এবং বিকশিত করা। সেখানে পড়ালেখার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি, সেটি বজায় রাখা এবং শিক্ষার্থীদের সার্বিক নিরাপত্তা দেওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রধান কাজ।

একটি মহল দিনের পর দিন নৈরাজ্য চালিয়ে যাবে আর প্রশাসন ‘মিউচুয়াল’-এর নীতি অবলম্বন করে সবকিছু হিমঘরে পাঠিয়ে দেবে—এটি কোনোভাবেই কাম্য নয়। এই প্রশাসনিক অনৈতিক চর্চা বিশ্ববিদ্যালয় চরিত্রের সঙ্গে মানায় না।

বিশ্ববিদ্যালয়কে সত্যিকার অর্থে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বরূপে ফিরিয়ে আনতে হলে শিক্ষার্থীদের নির্বিঘ্ন জ্ঞান অন্বেষণ এবং জ্ঞানচর্চার উপযুক্ত পরিবেশ বজায় রাখতে হলে প্রশাসনকে অবশ্যই ছাত্রলীগ তোষণ-পোষণনীতি কিংবা ‘ওরা তো আমাদেরই ছেলে’—এই মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।

  • ফরিদ খান অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

faridecoru@yahoo.co.uk