মতামত

রাষ্ট্রের উন্নয়নদর্শন ঠিক করতে হবে সবার আগে

দর্শনবিহীন উন্নয়ন প্রচেষ্টায় ভ্রান্তি থাকতে বাধ্য। এতে নিজস্ব সম্পদের ও ঋণ করে আনা অর্থের অপচয় অবধারিত। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনমানের উল্লম্ফনও ঘটে না এতে। পুঁজিবাদী দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নয়া উদারতাবাদের আলোকে বাজার অর্থনীতির শিক্ষায় শিক্ষিতরা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ‘সফট পাওয়ার’ সংস্থাগুলোর অংশ।

অন্য যেসব ‘সফট পাওয়ার’ মার্কিনিরা গড়ে তুলেছে তা হলো, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা, ইউএসএ আইডি, ন্যাশনাল এনডাউমেন্ট ফর ডেমোক্রেসি এবং আমেরিকান রাষ্ট্রগুলোর সংস্থা ওএএস। এমনকি জাতিসংঘও মার্কিন দর্শন নয়া উদারতাবাদে ও বাজার অর্থনীতিতে আক্রান্ত। এই নামমাত্র আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো প্রকৃতপক্ষে মার্কিন রাষ্ট্র এবং মার্কিন করপোরেশনগুলোর স্বার্থের প্রতি একতরফাভাবে অনুগত।

‘টাকাই ঈশ্বর’—এই পুঁজিবাদী তত্ত্বের বিপরীতে উৎকৃষ্ট আরও যেকোনো তত্ত্ব থাকতে পারে, তা ওই সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের জানারই সুযোগ নেই। উদাহরণস্বরূপ, বিখ্যাত আমেরিকান অর্থনীতিবিদ, ম্যাসাচুসেটস আমহার্স্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক, রিচার্ড উলফ অক্সফোর্ড কলেজে, স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে ও ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে স্নাতক থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন।

তিনি জানাচ্ছেন, মার্কিন এসব কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে মার্ক্সীয় অর্থনীতি বা দর্শন শিক্ষাক্রমে তো ছিলই না, এর ওপর কোনো বই লাইব্রেরিতেও ছিল না।

যুক্তরাষ্ট্র ১৯২৯ থেকে ১৯৩৯–ব্যাপী সংঘটিত মহামন্দা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয় কেইন্সীয় ব্যবস্থাপত্রের সাহায্যে, যেখানে বাজার নয়, সরকারের ভূমিকা ছিল মুখ্য। বাজার স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজেকে নিজে সংশোধন করবে—প্রচলিত এই ধ্রুপদি অর্থনৈতিক তত্ত্বের বিপরীতে, অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে সরকারের সক্রিয় ভূমিকার প্রস্তাব করেন প্রফেসর কেইন্স।

কিন্তু এরপর তাঁরা কেইন্সের নীতি পরিহার করে নয়া উদারতাবাদের নীতি গ্রহণ করেন, যার প্রবক্তা হায়েক, ফ্রিডম্যান, বুকানন, লুডউয়িগ, নজিক প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বা অর্থনীতিবিদ। নয়া উদারতাবাদে দেশ আরও বেশি ধনতান্ত্রিক ও বাজারনির্ভর হলো, আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়ন্ত্রণ উঠে গেল, রাষ্ট্রের চেয়ে ব্যক্তি বেশি শক্তিশালী হলো। শ্রমিক ইউনিয়নের প্রভাব হ্রাস পেল, জনসাধারণের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা উধাও হলো, ধনীদের জন্য কর কমল, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ দূর হলো। এভাবে ভয়াবহ বৈষম্য দেখা দিল সমাজে।

বস্তুত, ধনী আরও ধনী, গরিব আরও গরিব হবে—এটা পুঁজিবাদী অর্থনীতির অমোঘ নিয়তি। প্রতিযোগিতা হলে, সেখানে কেউ এগিয়ে যাবে, আর কেউ পিছিয়ে পড়বে। যে পিছিয়ে পড়বে, তাঁর দায়িত্ব নিতে পারে একমাত্র রাষ্ট্র; কিন্তু নয়া উদারতাবাদীরা রাষ্ট্রের কোনো ভূমিকায় বিশ্বাস করেন না। একজন মানবতাবাদী কখনোই বৈষম্য মেনে নিতে পারেন না। কারণ বৈষম্য মানুষের সুখ বিনষ্ট করে।

পাকিস্তান রাষ্ট্র ভাঙার প্রধান কারণ ছিল অর্থনৈতিক বৈষম্য। অতএব, স্বাধীন বাংলাদেশেও যদি সেই বৈষম্য বিরাজ করে, তাহলে বলতে হবে, মুক্তিযুদ্ধের অর্জন বিফলে গেছে। আপাতদৃষ্টে ২০২৪-এর অভ্যুত্থানের মূল চেতনাও হলো বৈষম্যবিরোধী।

আমরা জানি, একটা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণ এই মুহূর্তে সম্ভব নয়, কিন্তু এমন একটা সমতাভিত্তিক রাষ্ট্র আমাদের নির্মাণ করতে হবে, যেখানে অন্তত মানুষের মৌলিক চাহিদা—খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্র গ্রহণ করে। সবচেয়ে বড় প্রয়োজন কর্মসংস্থান সৃষ্টি। কারণ, মানুষ অন্যের কাছ থেকে ভিক্ষা গ্রহণ করা উপভোগ করে না, তা ব্যক্তির কাছ থেকেই হোক বা রাষ্ট্রের কাছ থেকেই হোক। তাঁরা তাঁদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে চান, তাঁদের নিজস্ব প্রচেষ্টায়, নিজস্ব উদ্যোগে কিছু একটা করতে চান। তাদের জীবিকা নিজেরাই নির্বাহ করতে চান।

ক্ল্যাসিক্যাল মার্ক্সীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা বা অর্থনীতি পুরোপুরি সমর্থন না করলেও বাজার অর্থনীতির ঘোর বিরোধী প্রফেসর অমর্ত্য সেন। পাশ্চাত্যের যে সব পণ্ডিত প্রথম জীবনের মার্ক্সবাদের প্রতি প্রবলভাবে আকৃষ্ট হয়ে পরিশেষে নিজেদের উদারতাবাদী হিসেবে গণ্য করেছেন, তাঁদের মধ্যে প্রফেসর জন রওলস ব্যতিক্রম। ন্যায়বিচার, ন্যায্যতা, সমতা ইত্যাদি নিশ্চিত করা উদারতাবাদে সম্ভব নয় বলে তিনি মনে করতেন। এ ক্ষেত্রে জন রওলসের প্রভাব পড়েছে তাঁর ছাত্র অমর্ত্য সেনের ওপর।

স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক মার্কিন ম্যাগাজিন ‘মানথলি রিভিউ’-এর প্রথম সংস্করণটি বের হয় ১৯৪৯ সালের মে মাসে। এ উপলক্ষে সেই সময়ের সব প্রথিতযশা ব্যক্তির লেখা ছাপা হয়। এর মধ্যে ছিল ‘কেন সমাজতন্ত্র?’ শিরোনামে আইনস্টাইনের একটি নিবন্ধ। সেখানে তিনি লিখেছিলেন: ‘আমি একটি পরিকল্পিত অর্থনীতির পক্ষে…এই অর্থে আমি একজন সমাজতন্ত্রী’।

২০২৪-এর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সংখ্যায় জন বেলামি ফস্টার আইনস্টাইনের এই নিবন্ধের ওপর একটি বিশাল প্রবন্ধ লেখেন, যা সংক্ষেপে এ রকম: ‘কিন্তু একজন বিজ্ঞানী হিসেবে আইনস্টাইনের সৃজনশীলতা এবং তাঁর সার্বজনীনতাবোধ কখনোই সমতাভিত্তিক সমাজের প্রতি তার প্রতিশ্রুতি থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল না। তিনি ছিলেন একজন দৃঢ় বিশ্বাসী সমাজতন্ত্রী। ১৯১১ সালের পর থেকে তিনি নিয়মিতভাবে জুরিখের গ্র্যান্ড ক্যাফে ওডিয়নে সময় কাটাতেন, যা ছিল আলেকজান্দ্রা কোলন্তাই, ভি আই লেনিন, লিওন ট্রটস্কি প্রমুখ রুশ বিপ্লবীর মিলনস্থল। তিনি সেখানে তীব্র রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আলোচনায় জড়িয়ে পড়তেন। তিনি বুঝতেন, কিছু ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বিপ্লবের প্রয়োজন হয়।’

১৯২৯ সালে আইনস্টাইন লেনিন সম্পর্কে প্রশংসাসূচক মন্তব্য লেখেন: ‘আমি লেনিনকে একজন মানুষ হিসেবে সম্মান করি, যিনি সম্পূর্ণভাবে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন এবং তার সমস্ত শক্তি সামাজিক ন্যায়বিচার বাস্তবায়নের জন্য নিয়োজিত করেছিলেন। যদিও আমি তার পদ্ধতিগুলোকে বাস্তবসম্মত মনে করি না, তবে একটি বিষয় স্পষ্ট: তার মতো মানুষেরা মানবতার বিবেকের রক্ষক ও পুনঃস্থাপক।’ ১৯৩১ সালে প্রকাশিত ‘দ্য ওয়ার্ল্ড অ্যাজ আই সি ইট’ প্রবন্ধে, আইনস্টাইন সমতার প্রতি তার বিশ্বাস পুনর্ব্যক্ত করেন, বলেন, ‘আমি শ্রেণি বৈষম্যকে অন্যায় মনে করি।’

হেরাল্ড লাস্কি প্রথম জীবনে পুঁজিবাদে বিশ্বাস করতেন, কিন্তু শাসক শ্রেণির দ্বারা সংস্কারের বাস্তবায়ন নিয়ে তাঁর সন্দেহ তাঁকে মহামন্দার সময় মার্ক্সবাদ গ্রহণে প্ররোচিত করে। লাস্কি যুক্তি দেন, পুঁজিবাদের অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো রাজনৈতিক গণতন্ত্রের ধ্বংস ডেকে আনতে পারে। তিনি বুঝতে শুরু করেন যে সমাজতন্ত্রই ছিল জার্মানি ও ইতালিতে ক্রমবর্ধমান ফ্যাসিবাদের হুমকির বিরুদ্ধে একমাত্র সম্ভাব্য বিকল্প।

বার্ট্রান্ড রাসেল নিজেকে সমাজতন্ত্রী ভাবতে পছন্দ করতেন। ১৯২০ সালে মে মাসে তিনি ব্রিটিশ বামপন্থী লেবার পার্টির প্রতিনিধিদলের প্রধান হয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর সাড়াজাগানো দার্শনিক ও লেখক জ্যঁ পল সার্ত্র একদিকে ব্যক্তি স্বাধীনতা আর অন্যদিকে, মার্ক্সীয় দর্শনের আলোকে একটি সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আমৃত্যু কাজ করেছেন। নোবেল বিজয়ী চিলিয়ান কবি পাবলো নেরুদা জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য কমিউনিস্ট পার্টিতে যুক্ত হয়েছেন। ব্রিটিশ লেখক গ্রাহাম গ্রীন প্রথম জীবনে কমিউনিস্ট হতে চেয়েছিলেন, সারা জীবন আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লিখেছেন।

হেরাল্ড লাস্কি প্রথম জীবনে পুঁজিবাদে বিশ্বাস করতেন, কিন্তু শাসক শ্রেণির দ্বারা সংস্কারের বাস্তবায়ন নিয়ে তাঁর সন্দেহ তাঁকে মহামন্দার সময় মার্ক্সবাদ গ্রহণে প্ররোচিত করে। লাস্কি যুক্তি দেন, পুঁজিবাদের অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো রাজনৈতিক গণতন্ত্রের ধ্বংস ডেকে আনতে পারে। তিনি বুঝতে শুরু করেন যে সমাজতন্ত্রই ছিল জার্মানি ও ইতালিতে ক্রমবর্ধমান ফ্যাসিবাদের হুমকির বিরুদ্ধে একমাত্র সম্ভাব্য বিকল্প।

অমর্ত্য সেনের উন্নয়নতত্ত্বকে দুটি ধারণার মাধ্যমে সংক্ষেপে তুলে ধরা যায়: ‘ক্যাপাবিলিটি অ্যাপ্রোচ’ এবং ‘ফাংশনিংস’। প্রথমটি হলো, সামগ্রিক মানব উন্নয়নের জন্য ব্যক্তির ভেতরকার অনন্ত শক্তির স্ফুরণ ঘটানো। দ্বিতীয়টি হলো, একজন ব্যক্তি যে কাজ মূল্যবান গণ্য করে, সেই কাজ করে নিজস্ব সুখানুভূতির উন্নততর স্তরে পৌঁছানোর সুযোগ সৃষ্টি করা। সেনের উন্নয়নতত্ত্বের আরেকটি দিক হলো, সুযোগের সুষম বণ্টন। আজকাল যে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে, তার গভীরে আছে সেনের উন্নয়নতত্ত্ব।

২০২০-এর পেন্ডেমিক আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দিয়ে গেছে আর তা হলো, ধনী-গরিবনির্বিশেষে সমাজের একজন মানুষও যদি করোনা থেকে অরক্ষিত থাকে, তাহলে সমাজের অন্য সবাই-ই করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে থাকবে। অর্থাৎ সমাজের সব মানুষকে টিকা দিয়ে সুরক্ষিত করা আমার নিজেরই কর্তব্য। না হলে আমি নিজেও করোনায় আক্রান্ত হতে পারি। এই যে চেতনা, এর নাম হলো সমন্বিত জীবনচেতনা যা ছাড়া সম্পদের সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। আর সম্পদের সামাজিক মালিকানা ছাড়া মানবজাতির সুখ সর্বাধিক করা যায় না।

পুঁজিবাদী অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি হলো প্রফিট-মোটিভ। কমিউনিস্ট অর্থনীতির চালিকা শক্তি তাহলে কী? এই প্রশ্নে মাও জেদং একটি উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘ধরুন নৌকার উচ্চতা উন্নতির সূচক। সে জন্য প্রত্যেক মাঝিই তাঁর নৌকাটিকে ওপরের দিকে তুলতে চেষ্টা করবেন, কিন্তু একার পক্ষে একটি নৌকা ওপরে তোলা সম্ভব নয়। অতএব, সবাই মিলে নদীর পানি বৃদ্ধি করতে হবে। নদীর পানি বৃদ্ধি পেলে প্রত্যেকের নৌকাই স্বয়ংক্রিয়ভাবেই ওপরে উঠে যাবে। এই উপমার মধ্য দিয়ে মাও জেদং আসলে সমন্বিত জীবনচেতনার কথাই বলছেন। প্রফিট-মোটিভের বিপরীতে কমিউনিস্ট অর্থনীতির চালিকা শক্তি, সমন্বিত জীবনচেতনাকেই তিনি ঊর্ধ্বে তুলে ধরছেন।

আইনস্টাইন, জ্যঁ পল সার্ত্র, জন রওলস, হেরাল্ড লাস্কি, অমর্ত্য সেন—সবারই বিশ্বাস ছিল শুধু জীবনমানের উল্লম্ফনে নয়, জীবনের উত্থানে এবং এর জন্য বড় বাধা বিরাজমান বৈষম্য। আর বৈষম্য দূর করতে চাই সমাজে সমন্বিত জীবনচেতনার বিকাশ। কী ধরনের রাষ্ট্র হবে, রাষ্ট্রের উন্নয়নদর্শন কী হবে, সমাজে গভীরেই তার বীজ উপ্ত। অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন সমন্বিত জীবনচেতনার বিকাশ ছাড়া সম্ভব নয়। বাংলাদেশেও রাষ্ট্রের উন্নয়নদর্শন নির্ধারণ করার জন্য আমাদের যেতে হবে সমাজের কাছে, প্রোথিত করতে হবে সমন্বিত জীবনচেতনা মানুষের মধ্যেই।

  • এন এন তরুণ অর্থনীতির অধ্যাপক, ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ। সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ। nntarun@gmail.com