কিয়েভের আকাশ-বাতাসে যে গুজব ঘুরছে, সেটি হলো প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি তাঁর সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান ভ্যালেরি জালুঝনিকে বরখাস্ত করতে চলেছেন। কারণ হলো জেলেনস্কি ও জালুঝনির মধ্যে বিরোধ চরমে পৌঁছেছে। জালুঝনিকে যে কারণে বরখাস্ত করা হবে, তার অজুহাত হিসেবে বলা হচ্ছে, দোনেৎস্ক অঞ্চলে ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ শহর আবদিভকায় ইউক্রেনীয় বাহিনীর শোচনীয় অবস্থা। গুজব ছড়িয়েছে যে ইউক্রেনের সেনা গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান কিরিলো বুদানভকে জেলেনস্কির স্থলাভিষিক্ত করা হবে।
যুদ্ধক্ষেত্রে বর্তমান পরিস্থিতি বলছে, আদদিভকা শহরের দক্ষিণ অংশ দিয়ে রুশ বাহিনী সামনের দিকে এগোচ্ছে। ইউক্রেনীয়দের একের পর এক পরিখা ও দুর্গ তারা গুঁড়িয়ে চলেছে।
আবদিভকা শহরের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় রুশ বাহিনী যে সফল হতে চলেছে, সে ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ কম। রুশ বাহিনীর অগ্রযাত্রাকে বিলম্ব করে দিতে পারলেও তাদের ঠেকিয়ে দেওয়ার সামর্থ্য ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর নেই। ইউক্রেনীয় বাহিনী যদি অন্য কোনো জায়গা থেকে সেনা এনে আবদিভকায় শক্তি বাড়াতে চায়, তাহলে ওই অঞ্চলে তাদের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা দুর্বল হয়ে যাবে।
আবদিভকা কৌশলগত দিক থেকে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটা মূল প্রশ্ন নয়। আসলে জালুঝনিকে সরানোর একটা অজুহাত খুঁজছেন জেলেনস্কি। নিজের অবস্থান ক্রমেই অনিশ্চিত হয়ে পড়ায় জেলেনস্কি এখন তাঁর চারপাশে অনুগত লোকদের খুঁজছেন। ইউরোপ ও আমেরিকায় জেলেনস্কির মিত্ররা, যাঁরা এখনো বলে চলেছেন যে তাঁরা ইউক্রেনকে অর্থ, অস্ত্র ও অন্যান্য সহযোগিতা দিয়ে যেতে চান, তাঁরা বুঝতে পারছেন যে রুশ বাহিনীর সামনে ইউক্রেনীয় বাহিনী দাঁড়াতে পারবে না।
এ কারণেই ইউরোপে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। ইউক্রেন নিয়ে ওয়াশিংটন নতুন নীতির দিকে ঝুঁকছে। ইউরোপ বিশ্বাস করে, রাশিয়া যদি ইউক্রেন যুদ্ধে জিতে যায়, তাহলে রাশিয়া ইউরোপের ওপর হুমকি সৃষ্টি করবে। আর এই হুমকির জন্য ইউরোপ মোটেই প্রস্তুত নয়।
ন্যাটোর প্রধানেরা এবং একই সঙ্গে জার্মানি, সুইডেন, হল্যান্ড, এস্তোনিয়া, পোল্যান্ড ও অন্য সদস্যদেশগুলো ন্যাটোর প্রতিরক্ষাব্যবস্থা শক্তিশালী করার আওয়াজ তুলছে। জানুয়ারি মাসেই ন্যাটো পাঁচ মাসব্যাপী সামরিক মহড়া শুরু করল। এই মহড়ার উদ্দেশ্য হলো, ন্যাটো রাশিয়াকে দেখাতে চায় যে তারা লড়াই করতে প্রস্তুত আছে। কিন্তু এই মহড়া একই সঙ্গে রাশিয়ার সামনে করণীয় কী, তা–ও বলে দিচ্ছে।
৯০ হাজার সেনার এই মহড়ার নাম দেওয়া হয়েছে দ্রুতগতির প্রতিরক্ষা। নিজেদের সামর্থ্যের জানান দিতেই ন্যাটোর এ আয়োজন। ন্যাটোর এ মহড়ার প্রেক্ষাপটে রুশ বাহিনী তাদের বড় একটি সামরিক মহড়া বাতিল করেছে। এর বদলে রাশিয়া এখন তাদের স্থল, নৌ ও বিমানবাহিনীর নতুন সেনাদের প্রশিক্ষণের ওপর জোর দিচ্ছে।
ইউরোপের পিছু হটার সুযোগ খুব কম। কেননা, প্রকৃতপক্ষে তাদের নিরাপত্তা যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল। সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের অনেক আগে থেকেই ইউরোপীয়রা সামরিক ব্যয়ের চেয়ে সামাজিক কল্যাণে ব্যয়ের দিকে মূল মনোযোগ দিয়েছে, প্রতিরক্ষা কর্মসূচিতে বিনিয়োগ সীমিত করে ফেলেছে।
সবচেয়ে খারাপ সংবাদ হচ্ছে, ইউরোপের কয়েকটি দেশ তাদের গোলাবারুদ ও অস্ত্রশস্ত্র ইউক্রেনকে দিয়ে নিজেদের ভান্ডার প্রায় খালি করে ফেলেছে।
জার্মানির ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাচ্ছি, তারা বাঁকবদলের বিন্দু স্লোগান তুলে সেনাবাহিনী পুনর্গঠনের পদক্ষেপ নিয়েছে। আবার জার্মান সরকার ইউক্রেনকে অস্ত্র ও আর্থিক সহায়তা দেওয়ার জন্য ১০৮ বিলিয়ন ডলারের তহবিল গড়ে তোলার কথা বলছে। রুশ সরকার এখন তাদের দেশে অস্ত্র ও গোলাবারুদ উৎপাদন বাড়ানোর জন্য সমরাস্ত্র কারখানাগুলোকে বাড়তি শিফটে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছে। সে তুলনায় ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
এ ছাড়া শ্রমিকসংকট, সরবরাহ শৃঙ্খলায় সমস্যা এবং কেনাকাটার দীর্ঘসূত্রতা তো আছেই। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র তাদের সবচেয়ে মোক্ষম অস্ত্র ইউক্রেনকে দিয়ে দিয়েছে। ফলে ইউরোপকে উদ্ধারের প্রয়োজন হলে তারা কী করবে, তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
এ প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রকে যে তার নীতি বদলাতে হবে, সেটা কি তারা বুঝতে পারছে? রাশিয়ার সঙ্গে কোনো প্রথাগত যুদ্ধে যে যুক্তরাষ্ট্র জিততে পারবে না, সে সত্যের স্বীকৃতি কি তারা দেবে? (চীন, ইরান, এমনকি খুদে শক্তির হুতিদের সঙ্গেও প্রথাগত যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র জিততে পারবে না।)
ইউক্রেন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র নতুন নীতি নিচ্ছে। যদি ঠিকঠাকভাবে এই নীতি বুঝতে পারি, তাহলে বলব, ইউক্রেন যে যুদ্ধে হারতে যাচ্ছে এবং ইউক্রেন সরকারকে কিয়েভ থেকে সরিয়ে আনার প্রয়োজন হতে পারে—এ বাস্তবতার ওপর ভিত্তি করে সেটি প্রণীত হচ্ছে। ইউক্রেনের রাজধানী সম্ভবত লিয়েভে সরিয়ে নেওয়া হতে পারে। নতুন রাজধানীর সুরক্ষার জন্য বুদানভের শহরের ওপর কার্যকর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে হবে। নতুন মার্কিন নীতির মূল বিষয় এটাই।
নতুন নীতি অনুযায়ী ইউক্রেনীয় বাহিনী তাহলে কী করবে? গুপ্তহত্যা, বোমাবর্ষণ, পারমাণবিক চুল্লি উড়িয়ে দেওয়াসহ অন্যান্য যেকোনো পথে রাশিয়ানদের শায়েস্তা তারা করে যাবে।
ওয়াশিংটনের সামনে এখন তিনটি বিকল্প আছে। প্রথমত, তারা ইউক্রেন যুদ্ধ চালু রাখতে পারে এবং কংগ্রেসের কাছে অর্থ ছাড়ের আবেদন করে যেতে পারে। কিন্তু ইউক্রেনীয় বাহিনী যদি বিপর্যস্ত হতেই থাকে, তাহলে অর্থ ছাড় করা খুব কঠিন হবে। কেননা, পরাজিত কারও জন্য অর্থ ছাড় করা মোটেই সহজ নয়।
দ্বিতীয় পথটি হলো, কিয়েভে পশ্চিমাপন্থী সরকারের কার্যক্রম চালিয়ে নিতে দেওয়া। প্রয়োজনে কিয়েভ থেকে রাজধানী লিয়েভে সরিয়ে নিয়ে সরকারকে সমর্থন দিয়ে যাওয়া।
তৃতীয় পথটি হলো, রাশিয়ার সঙ্গে ইউরোপের সব সম্পর্ক ছিন্ন করে দেওয়া। এর মানে হচ্ছে, মস্কোর সঙ্গে ইউরোপের দেশগুলোর সব চুক্তি বাতিল করে দেওয়া।
কিয়েভে রাশিয়ানরা যদি মস্কোপন্থী সরকার বসাতে পারে, তাহলে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক কী হবে, তা নিয়ে ইউরোপিয়ানদের জন্য একটা বাস্তবসম্মত সমাধানে আসা দরকার। এ ক্ষেত্রে ইউরোপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হচ্ছে জার্মানি। বর্তমান জার্মান সরকার রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা করতে রাজি নয়। কিন্তু নিকট ভবিষ্যতে সেটা পাল্টে যেতে পারে।
স্টিফেন ব্রায়েন সেন্টার ফর সিকিউরিটি পলিসি অ্যান্ড ইয়র্কটাউন ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ ফেলো
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত