সাধারণ মানুষের হাতে কী রকম টাকা পয়সা আছে তার আরও কিছু নমুনা পাওয়া গেল কোরবানির ঈদে। বিশ লাখ গৃহপালিত পশু এবার অবিক্রীত রয়ে গেছে।
দেশের আমদানি রপ্তানির দশা কেমন, তা বোঝা যায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে হাহাকার শুনে।
সরকারের ‘নিজস্ব’ আয়–ব্যয়ের নিকট ভবিষ্যৎ কেমন তারও প্রতিফলন দেখি ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে।
‘নিজস্ব’ বলছি এ জন্য যে, এ দেশের করদাতারা ঠিকমতো বুঝতে পারে না, রাজস্ব নামক জিনিসটি তাদের দেওয়া এবং তাদেরই পেছনে তা ব্যয় হওয়ার কথা।
মানুষের ভালোবাসা (উপহার) থেকে এমনকি ডিজিটাল বাংলাদেশের অন্যতম উপাদানসহ (মোবাইল রিচার্জ) যেখানে সেখানে কর বসানো হয়েছে। এমনিতেই করোনা-পরবর্তী কালে আয় ও কর্মসংস্থানে ধস এবং দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়া পরিস্থিতিকে আরও অসহনশীল করে তুলেছে; নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য ও সেবার ভয়াবহ মূল্য বৃদ্ধি ঘটেছে; তার ওপর আবার করের পর কর!
তবে ৬ জুন ২০২৪-এ জাতীয় সংসদ ভবনে বাজেট প্রস্তাব পেশ করার আগে যা আশা (পড়ুন: আশঙ্কা) করা হয়েছিল তার সত্যতা মিলেছে।
সুযোগ থাকুক না থাকুক বয়োজ্যেষ্ঠ অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী রাজস্ব আদায়ে সরকারের বেপরোয়া অবস্থান তুলে ধরেছেন।
এই করের টাকা থেকেই মোট বাজেট বরাদ্দের প্রায় ১৫ শতাংশ বা ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা আগামী অর্থ বছরে পরিশোধ করতে হবে ঋণের সুদ।
এখনকার যুগে বাজেট প্রস্তাবের ধারণা আগে থেকেই থাকে; বিশেষ করে সাংবাদিক এবং অর্থনীতি সংক্রান্ত পেশাদারদের সে ধারণা থাকেই। এর আনুষ্ঠানিক ঘোষণাটি আসে অর্থ মন্ত্রণালয়ে রচিত ‘বার্ষিক আর্থিক বিবৃতি’ সাহিত্যের আকারে।
প্রধানত কাগজীয় বৈধতা প্রদানের উদ্দেশ্যে এই সাহিত্য খুব কষ্ট করে পাঠ ও অতিশয় ধৈর্য ধরে শ্রবণ করা হয় লুই কানের নকশায় নির্মিত সুন্দর ভবনে।
এই বাজেট সাহিত্যের বন্দনায় বর্তমান অর্থমন্ত্রী ইতিহাস সচেতনতার পাশাপাশি গদি প্রিয়তার পরিচয়ও দিয়েছেন। তবে যদি কোনো তরুণ বুঝতে চায় কোন আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে এই বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে, দুঃখিত, তার সহজ পাঠ এখানে নেই।
মাহমুদ আলী সাহেব বাংলাদেশের জনগণকে ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়োজন বা সাহস বোধ করেননি যে, তাঁর সরকারের আমলে ১৫টি বাজেট ঘোষণার পরও কেন, কীভাবে আজকের অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হলো।
অন্যায়ভাবে কামানো অথবা হতে পারে বৈধভাবে অর্জিত অপ্রদর্শিত টাকা সাদা করা যাবে বৈধ অর্থের চেয়ে কম হারে কর দিয়ে—আমাদের এই জানাশোনা ঠিক আছে তো?
এই সুযোগ দেওয়া হয়েছে এমনভাবে যেন বিদেশে পাচার হওয়া কোটি কোটি ডলার জাহাজে বা বাংলাদেশ ব্যাংকের চ্যানেল প্লাবিত করে দেশে ফিরে আসবে।
এই ব্যবস্থার নৈতিকতা নিয়ে বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন তুললে তিনি রীতিমতো ক্ষেপে যান। ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪-এর একতরফা নির্বাচনে সংসদ সদস্য হওয়া ভদ্রলোকের কৈফিয়ত দিতে অনীহায় আশ্চর্যের কিছু নেই।
মানুষেরও বাজেট-টাজেট নিয়ে খুব আগ্রহ আছে সে প্রমাণ দেখছি না। তাতে অবশ্য শাসকদের সুবিধাই হয়েছে। কিছু বিচ্ছিন্ন আলোচনা ছাড়া সংসদের বাইরে, ভেতরে মোটামুটি সমালোচনামুক্ত এই বাজেট। মন্দ কী!
অর্থমন্ত্রী ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করেছেন ও ভূরাজনীতির দোহাই দিয়েছেন জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের জন্য। শুধু নিজেদের শাসন ব্যবস্থার কোনো দায় খুঁজে পাননি, উদ্বেগজনক পরিস্থিতির কথাও সরাসরি স্বীকার করেননি। তারপরও তিনি বারবার আশার বাণী শুনিয়েছেন, জানি না কোন দুঃখে?
কিন্তু যে অপরাধ বা ভুল করেননি সৎ নাগরিকেরা সে জন্য খেসারত দিতে হচ্ছে তাদেরই—এই মন্তব্য এক শিক্ষিত ব্যবসায়ী বন্ধুর।
ব্যয়বহুল ব্যবসা পরিবেশ ও সেবার ঘাটতি কিন্তু অতি নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থার প্রেক্ষিতে কর প্রস্তাবের বাহুল্যকে তিনি আখ্যা দিয়েছেন ‘কর জুলুমশাহী’ হিসেবে।
কী আর করা! রাজত্ব তো হবে ক্ষমতা ও বিত্তশালীদেরই, নাকি?
‘আমি যে দেখেছি প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধে/বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে’—রবী ঠাকুরের এই লাইনগুলোর প্যারোডি মিলবে পররাষ্ট্র থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে আসা মন্ত্রীর বাজেট উপাখ্যানে।
অর্থমন্ত্রী ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করেছেন ও ভূরাজনীতির দোহাই দিয়েছেন জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের জন্য। শুধু নিজেদের শাসন ব্যবস্থার কোনো দায় খুঁজে পাননি, উদ্বেগজনক পরিস্থিতির কথাও সরাসরি স্বীকার করেননি।
তারপরও তিনি বারবার আশার বাণী শুনিয়েছেন, জানি না কোন দুঃখে?
‘আশা’ শব্দটি অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট সাহিত্য পঠনে উচ্চারণ করেছেন ১৩ বার! জীবনে কোথাও না কোথাও তো আশাবাদ থাকা দরকার। বাস্তবে না হোক, হোক কথামালায়!
মুদ্রাস্ফীতি, প্রবৃদ্ধি, রপ্তানি, বিনিয়োগ এসব বিষয়ে শক্তিশালী যুক্তি ও আত্মবিশ্বাস প্রকাশের বদলে তিনি আশাবাদের গোলকধাধায়ই জাতিকে আটকে রাখতে সচেষ্ট থেকেছেন। বাজেট বক্তৃতা লিখতে গিয়ে তিনি হয়তো ভেবেছেন যে ৮০ বারের অধিক ‘স্মার্ট’ শব্দটি বললে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠা না হয়ে যায় কোথায়?
‘টেকসই উন্নয়নের পরিক্রমায় স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্নযাত্রা’—কী গালভরা টাইটেল রে বাবা! এর প্রণেতা (রা) কিছু আপাতবিরোধ হয়তো খেয়াল করেননি।
ইংরেজিতে যাকে বলে ‘সাস্টেনেবল ডেভেলপমেন্ট’ তা হয়ে থাকলে অর্থনীতি ভঙ্গুর ও ঋণের জালে আবদ্ধ হলো কী করে?
আর অর্থমন্ত্রী সংকট থেকে উত্তরণের আর্থ-রাজনৈতিক ফর্মুলা না বাতলে স্মার্ট বাংলাদেশের যাত্রার কথা বলছেন, হতে পারে তা স্বপ্নে, তাও আবার তার আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশক ক্ষমতায় থাকার পর।
সুশাসন ও সংস্কারের বিষয়টিও উচ্চারিত হয়েছে, তবে ডিজিটাল ও আমলাতান্ত্রিক কর্তৃত্বের আলোকে। সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং ভোটাধিকারসহ সেই প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণ যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তার স্বীকৃতি এখানে নেই। অর্থমন্ত্রী বোধ হয় ভুলেই গেছেন যে তিনি যে মঞ্জুরি দাবি পেশ করেছেন, তা করা হয় শাসন বিভাগের পক্ষ থেকে সংসদের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের কাছে।
খাজা মাঈন উদ্দিন সাংবাদিক