ভোটের আগে রাজনীতিতে গরম হাওয়া বইবে, দলগুলো সক্রিয় হয়ে উঠবে—এটাই স্বাভাবিক। নির্বাচনের নির্ধারিত সময়ের বছরখানেক আগে রাজনীতিতে তেমন পরিস্থিতিই তৈরি হয়েছে। যদিও নির্বাচন কীভাবে হবে, তা নিয়ে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক শক্তির অবস্থান দুই মেরুতে। এ বাস্তবতায় রাজনীতির গরম হাওয়া কত দিন শুধু ‘হাওয়ার’ মধ্যেই আটকে থাকে, সে প্রশ্ন যৌক্তিক কারণেই আমাদের অনেকেরই মনের মধ্যে আছে।
বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে সরকারের প্রত্যক্ষ বাধা ছাড়া বেশ কিছু সমাবেশ আয়োজনের পর বিএনপি এখন বেশ চাঙা অবস্থায় আছে বলে মনে হয়। দলটির নজর এখন ঢাকায় ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশের দিকে। ১০ ডিসেম্বরের পর দেশ চলবে খালেদা জিয়ার কথায়—এমন একটি মন্তব্য করে বিএনপি নেতা আমানউল্লাহ আমান এ সমাবেশের গুরুত্ব বাড়ালেন, না একে হাস্যকর করে তুললেন, তা বোঝার জন্য আমাদের সেই দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের মুখে যা আসে, তা-ই বলার অভ্যাস নতুন কিছু নয়। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনীতির ‘গরম হাওয়া’ শুধু হাওয়ার মধ্যে আটকে না থেকে সংঘাতের আশঙ্কাকেই যেন বাড়িয়ে তুলছে।
আওয়ামী লীগের কথাবার্তায় মনে হচ্ছে, তারা বিএনপির ১০ ডিসেম্বরের ঢাকার সমাবেশকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গেই নিচ্ছে (১০ ডিসেম্বর কিছুই হবে না। ওই দিন আমরাও মাঠে থাকব। তাদের (বিএনপি) কোনো বাধা দেব না। কিন্তু তাঁরা যদি আগুন নিয়ে খেলতে চান, লাঠি নিয়ে খেলতে চান, তাহলে আমরা তা হতে দেব না। বিএনপির সঙ্গে খেলা হবে। খেলা হবে নির্বাচনে, খেলা হবে লুটপাটের বিরুদ্ধে, খেলা হবে ভোটচোরের বিরুদ্ধে।—আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের)। আর প্রথম আলোর প্রতিবেদন বলছে, বিএনপির সমাবেশ ঘিরে ১০ ডিসেম্বর রাজধানী ঢাকা ‘অবরুদ্ধ’ হয়ে পড়তে পারে। আওয়ামী লীগ ঢাকার প্রবেশমুখে এবং ভেতরেও নিজেদের উপস্থিতি নিশ্চিত করবে। পরিবহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও সতর্ক পাহারায় থাকবে।
দুই পক্ষই যদি এসব রাজনৈতিক বক্তব্যের পক্ষে অনড় অবস্থান নেয়, তবে আমাদের মতো সাধারণ জনগণের সংঘাতের আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন না হওয়ার কোনো কারণ আছে কি? একদিকে সরকার বলছে, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের কারণে ২০২৩ সাল আরও কঠিন হতে পারে, অন্যদিকে জোরদার হচ্ছে একটি রাজনৈতিক সংঘাতের ঝুঁকি। আমরা কি কেউ ভেবে দেখছি, সামনে কোনো ধরনের রাজনৈতিক সংঘাত ও এর চাপ নেওয়ার সক্ষমতা আদৌ বাংলাদেশের আছে কি না?
বিএনপির ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশ নিয়ে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক বক্তব্য ও দলের পরিকল্পনার বাইরে এখন যে বিষয় উত্তাপ ছড়াচ্ছে, তা হচ্ছে সমাবেশের স্থান। বিএনপি নয়াপল্টনে দলের কার্যালয়ের সামনে সমাবেশের প্রস্তুতি নিয়ে ১৫ নভেম্বর ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাছে আবেদন করেছে। এখন জানা যাচ্ছে, সরকার চায় বিএনপি এ সমাবেশ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে করুক। সরকারের এই চাওয়ার পেছনে নিশ্চয়ই রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ ও কৌশল কাজ করেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, বিএনপির ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশের জন্য জন্য সরকার যেখানে ভালো মনে করবে, সেখানেই অনুমতি দেওয়া হবে। তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, সরকার কারও কথা শুনতে বাধ্য নয়।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এ বক্তব্যের পর পুলিশ তার বাইরে যাবে না, এটা জানা কথা। প্রথম আলোর খবর বলছে, কয়েক দিনের আলোচনার পর আগামী ১০ ডিসেম্বর বিএনপিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক গতকাল রোববার প্রথম আলোকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। কেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান? এ প্রশ্নের জবাবও দিয়েছেন তিনি, ‘আমরা বিবেচনা করে দেখলাম যে পার্টি অফিসের সামনে সমাবেশের অনুমতি দিলে এবং সেখানে কয়েক লাখ লোক জমায়েত হলে তা বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে যাবে। পার্টি অফিসের সামনে ৫০ থেকে ৬০ হাজার লোক ধরবে। এতে রাস্তাঘাট ব্লকড হবে। নগরবাসীর কষ্ট হবে। গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে।’
বিএনপি যদি সরকারে এ অবস্থান মেনে নিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের আয়োজনের উদ্যোগ নেয়, তবে ভালো কথা। কিন্তু বিএনপি যদি তা না মানে?
সমাবেশের স্থান নিয়ে এ অনিশ্চয়তার মধ্যে বিএনপি নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের কাছে সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করেছিলেন, ১০ ডিসেম্বর বিএনপির ঢাকা গণসমাবেশ কোথায় হবে? তিনি বলেছেন, ‘আমরা নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে করার অনুমতি চেয়েছি। সেখানেই আমরা সমাবেশ করব। তারা (সরকার) যদি অপারগ হয়, তাহলেও করব। অনুমতি দিলেও করব, না দিলেও করব। অনুমতির অপেক্ষা করব না। মনে রাখতে হবে, এ দেশটা আমাদের সবার।’
জনসভার জায়গা নিয়ে যখন এ পাল্টাপাল্টি অবস্থান, তখন শোনা গেল বিএনপির সঙ্গে সংলাপ নিয়ে সরকারের অনাগ্রহের কথা। মহিলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘অনেকে বলেন ডায়ালগ করতে হবে। আলোচনা করতে হবে। কাদের সঙ্গে? ওই বিএনপি, খালেদা জিয়া-তারেক জিয়া? সাজাপ্রাপ্ত আসামি, যারা গ্রেনেড হামলা করে আমাকে হত্যার চেষ্টা করেছে। এখন ওই দুর্নীতিবাজ-সাজাপ্রাপ্ত, এতিমের অর্থ আত্মসাৎকারী, অর্থ ও অস্ত্র পাচারকারী, গ্রেনেড হামলাকারী, আইভি রহমানের হত্যাকারীদের সঙ্গে সংলাপ করতে হবে?’
সরকার যেমন বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় অনাগ্রহী, তেমনি বিএনপিও চায় না সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসতে। বিএনপি বলছে, তারা সংলাপের কোনো দাবি করেনি। প্রধানমন্ত্রী উদ্দেশ্যমূলকভাবে এসব কথা বলছেন। দলটির সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, ‘এ সরকারের অধীন যে অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয়, সেটা বারবার প্রমাণিত হয়েছে। তাই আমরা এ সরকারের পদত্যাগ, সংসদ ভেঙে দেওয়া এবং নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীন নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করছি। একই সঙ্গে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিও রয়েছে। এই দাবি মেনে নেওয়ার আগে কোনো সংলাপ বা আলোচনা নয়। দাবি মেনে নেওয়ার পর সংলাপ বা আলোচনা হতে পারে।’ তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী যে ভাষায় আমাদের আক্রমণ করে কথা বলছেন, আমরা সে রকম হলে ২০১৮ সালে আমাদের সঙ্গে সংলাপ করেছেন কীভাবে?’ (ডয়েচে ভেলে)
দুই পক্ষই যদি এসব রাজনৈতিক বক্তব্যের পক্ষে অনড় অবস্থান নেয়, তবে আমাদের মতো সাধারণ জনগণের সংঘাতের আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন না হওয়ার কোনো কারণ আছে কি? একদিকে সরকার বলছে, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের কারণে ২০২৩ সাল আরও কঠিন হতে পারে, অন্যদিকে জোরদার হচ্ছে একটি রাজনৈতিক সংঘাতের ঝুঁকি। আমরা কি কেউ ভেবে দেখছি, সামনে কোনো ধরনের রাজনৈতিক সংঘাত ও এর চাপ নেওয়ার সক্ষমতা আদৌ বাংলাদেশের আছে কি না?
এ কে এম জাকারিয়া প্রথম আলোর উপসম্পাদক
akmzakaria@gmail.com