পশ্চিমবঙ্গে ডব্লিউবিসিএস পরীক্ষাসহ কিছু নীতিতে পরিবর্তন এনেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এসব করতে গিয়ে মুসলমান ভোটাররা তাঁর ওপর কিছুটা ক্ষুব্ধ। নির্বাচনের মৌসুম শুরুর আগে রাজ্যে সংখ্যালঘু রাজনীতির নতুন মেরুকরণ হচ্ছে।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ বেসামরিক পরিষেবা (সিভিল সার্ভিসেস) পরীক্ষায় সম্প্রতি বাংলা বাধ্যতামূলক করেছে রাজ্য সরকার। সরকারি গেজেটে উল্লেখ করা হয়েছে, এখন থেকে ৩০০ নম্বরের বাংলা ভাষার প্রশ্নের উত্তর দেওয়া বাধ্যতামূলক। আগে থেকেই ডব্লিউবিসিএস (ওয়েস্ট বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসেস) পরীক্ষায় ২০০ নম্বরের ইংরেজি ছিল বাধ্যতামূলক। তবে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে হিন্দি, উর্দু, সাঁওতালি বা গুরুমুখি ভাষায় ৩০০ নম্বরের পরীক্ষা দিতে পারতেন পরীক্ষার্থীরা। এবার সেই ব্যবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। আগামী বছর থেকে নতুন ব্যবস্থা কার্যকর হবে।
রাজ্য সরকারের এই সিদ্ধান্তে পশ্চিমবঙ্গের উর্দু ও হিন্দিভাষী মুসলমান সম্প্রদায় প্রবল ক্ষুব্ধ হয়েছে। ইতিমধ্যে তারা অসন্তোষের কথা জানিয়েছে। তাদের পক্ষে পশ্চিমবঙ্গ ভাষাগত সংখ্যালঘু সমিতি বিষয়টি নিয়ে সংখ্যালঘুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ভাষাবিষয়ক সংখ্যালঘু বিভাগে অভিযোগ করেছে। উর্দুর পাশাপাশি হিন্দি ও সাঁওতালি ভাষাও পরীক্ষা ব্যবস্থা থেকে অপসারণ করা হয়েছে বলে তারা উল্লেখ করেছে। বিষয়টির কোনো নিষ্পত্তি হয়নি, হওয়ার সম্ভাবনাও খুব একটা দেখা যাচ্ছে না।
পশ্চিমবঙ্গের কোনো পত্রপত্রিকায় বিষয়টি নিয়ে খুব বেশি লেখালেখি হয়নি। উর্দু কাগজেও সরকারি এই সিদ্ধান্তকে খুব বেশি জায়গা দেওয়া হয়নি। তবে বিষয়টির একটু গভীরে গেলেই পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিক মুসলমান ও হিন্দু—দুই সম্প্রদায়ের রাজনীতির নানা দিক সামনে আসবে। এ সময় বিষয়টি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, আর এক মাস পরেই পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত ভোট এবং তার আট মাস পরেই লোকসভা নির্বাচন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার অর্থাৎ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন এমন সিদ্ধান্ত নিলেন? বিশেষ করে তাঁর বিরুদ্ধে যখন একটি অভিযোগ, তিনি সংখ্যালঘুবিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে অবাঙালি মুসলমানদের বসিয়েছেন।
নিঃসন্দেহে এর প্রধান কারণ হতে পারে, পশ্চিমবঙ্গের ৯০ শতাংশ বাঙালি মুসলমানসহ রাজ্যের মোটামুটি ৮৫ শতাংশ বাঙালিকে সন্তুষ্ট করা। এক ঢিলে দুই পাখি মারলেন মমতা। মোটামুটি ১৫ শতাংশ হিন্দি ও উর্দুভাষীকে অসন্তুষ্ট করে ৮৫ শতাংশ বাঙালিকে সন্তুষ্ট করলেই তো তাঁর লাভ বেশি। এই বাঙালি জাতিভিত্তিক রাজনীতির ওপরে জোর দিয়েই ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে প্রায় ৭৫ শতাংশ আসন পেয়েছেন মমতা।
■ ডব্লিউবিসিএসে ৩০০ নম্বরের বাংলা পরীক্ষা বাধ্যতামূলক।
■ হিন্দি ও উর্দুভাষী হিন্দু–মুসলমানরা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ।
■ সাগরদিঘি আসনের বিধানসভা নির্বাচনে হার চিন্তায় ফেলেছে মমতাকে।
■ মুসলমান ভোটাররা কেন মমতার প্রতি বিমুখ, তা জানতে তৎপর তৃণমূল।
■ কর্ণাটকে কংগ্রেসের জয়ের পর জোট নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে মমতাকে।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) পত্রিকায় সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতে হিন্দুত্ববাদের পাশাপাশি আঞ্চলিকতাবাদের রাজনীতি বাড়ছে। সেই আঞ্চলিক রাজনীতির প্রভাবে কর্ণাটকে বিজেপি হেরেছে। এই নির্বাচনের ঠিক পরেই বাঙালিদের সন্তুষ্ট করে ডব্লিউবিসিএসে উর্দু ও হিন্দি সরিয়ে ৩০০ নম্বরের বাংলা ঢুকিয়ে দিলেন মমতা।
দ্বিতীয়ত—এটাকে বিরোধীদের জন্য মমতার রাজনৈতিক ফাঁদও বলা যেতে পারে। মনে করা হয়ে থাকে, পশ্চিমবঙ্গে হিন্দিভাষীদের প্রায় পুরোটাই বিজেপির সঙ্গে রয়েছে। যেসব অঞ্চল হিন্দিভাষী অধুষ্যিত, সেখানে বিজেপি ভালো আসন পেয়ে থাকে। ফলে বাধ্য হয়েই রাজ্যে বিজেপির বিরোধী দল নেতা শুভেন্দু অধিকারীকে হিন্দিভাষীদের পক্ষ নিয়ে কথা বলতে হয়েছে।
শুভেন্দু বলেছেন, ‘বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে রাজ্য সরকারকে আমি অনুরোধ করব, গত ১৫ মার্চের বিজ্ঞপ্তি প্রত্যাহার করুন এবং পুরোনো ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনুন। পুরোনো ব্যবস্থার পরিবর্তনের কোনো দরকার নেই। এই বিজ্ঞপ্তির ফলে হিন্দি, সাঁওতালি, উর্দু ও গুরুমুখিভাষী মানুষ গভীরভাবে বঞ্চিত হবে। ডব্লিউবিসিএস ক্যাডারে তাদের আর কোনো সুযোগ থাকবে না। বিধানসভার অধিবেশন শুরু হলে আমরা এই ইস্যুটি জোরালো উত্থাপন করব।’
শুভেন্দুর মতোই বক্তব্য দিয়েছেন সিপিআইএম (কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া–মার্ক্সিস্ট) নেত্রী সায়রা শাহ হালিম। তিনি বলেছেন, রাজ্য সরকারের নতুন সিদ্ধান্তে উর্দু ভাষাভাষী মানুষের অসুবিধা হবে।
এই প্রশ্নের উত্তর পেতে অপেক্ষা করতে হবে নভেম্বর-ডিসেম্বর পর্যন্ত। ওই সময় অন্যান্য রাজ্যের সঙ্গে ভারতের দুটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশে নির্বাচন হবে। এই দুটি নির্বাচনে যদি কংগ্রেস হারে, তাহলে হয়তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নীতি হবে মধ্যপন্থা বজায় রাখা। যদি বিজেপি হারে, সে ক্ষেত্রে তিনি হয়তো অনেকটাই সরে যাবেন বিরোধী জোটের দিকে। পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সম্প্রদায়ও নিঃসন্দেহে তাদের নির্বাচনী রাজনীতি স্থির করবে মুখমন্ত্রীর গতিবিধি দেখেই।
শুভেন্দু বা সায়রার বক্তব্যের সরাসরি বিরোধিতা করেনি তৃণমূল কংগ্রেস। কারণ, অনেক আসনে তৃণমূলের হিন্দি বা উর্দুভাষী হিন্দু ও মুসলমান ভোট রয়েছে। সেসব ভোট চলে গেলে ওই আসন তাদের হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। কিন্তু ‘বাংলা পক্ষ’ বলে একটি সংগঠন (বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষের সংগঠন এবং কিছুটা তৃণমূলঘেঁষা হিসেবে পরিচিত) এই ইস্যুতে অধিকারী ও সায়রার বক্তব্যের সমালোচনা করেছে এবং তাঁদের কড়া ভাষায় আক্রমণ করেছে। বিজেপি ও সিপিআইএম—দুটি দলকেই ‘বাঙালি স্বার্থবিরোধী’ দল হিসেবে উল্লেখ করেছে তারা। এই ইস্যুতে অবস্থান নিয়ে সংগঠনটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ ভালোই সমর্থন পেয়েছে।
অবশ্য সামাজিক মাধ্যমে এই সংগঠনের বিরুদ্ধে অবাঙালি সংগঠন কথা বলছে। তবে তাতে বাংলা পক্ষ এবং তৃণমূলেরই লাভ হয়েছে। কারণ, নির্বাচন সামনে রেখে বাঙালি–অবাঙালি একটা মেরুকরণ হলে তাতে লাভ হয় ক্ষমতাসীন তৃণমূলের। অর্থাৎ, ১৫ শতাংশ অবাঙালি হিন্দু ও মুসলমানকে অসন্তুষ্ট করে ৮৫ শতাংশ বাঙালি হিন্দু ও মুসলমানের কাছে মমতা বার্তা দিলেন, তিনি বাঙালিদের স্বার্থ নিয়ে বেশি চিন্তিত। এটিই হচ্ছে ‘আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদ’, যা নিয়ে হিন্দুত্ববাদীরা চিন্তিত।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে শুধু আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদ নিয়ে চিন্তা করলেই হয় না। নির্বাচনের খাতিরে আরও অসংখ্য বিষয়কে মিলিয়ে একটা সার্বিক ‘বয়ান’ তাঁকে তৈরি করতে হয়। বয়ানের একদিকে যদি হিন্দি ও উর্দুভাষী মানুষ থাকেন, অন্যদিকে রয়েছেন শুধু হিন্দুরা। তাদেরও কাছে টানার কিছু ব্যবস্থা করতে হয়। কারণ, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে দেখা গেছে, ভোটের সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ হয়ে হিন্দু ভোটারদের বড় অংশ বিজেপির দিকে চলে গেছে। এবারও তেমন হলে তৃণমূলের সমূহ বিপদ। সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের কারণে ২০১৯ সালের নির্বাচনে তৃণমূল ৪২ আসনের মধ্যে ১৮টি হারিয়েছিল। সেই বিষয়টি মাথায় রেখে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হিন্দু সম্প্রদায়কে (হিন্দিভাষী ও বাঙালি) খুশি করতে একাধিক পদক্ষেপ নিয়েছেন।
যেমন কথা নেই বার্তা নেই, উত্তর প্রদেশে কুম্ভ মেলার আদলে হুগলি জেলার ত্রিবেণীতে কুম্ভের আয়োজন করেছিল রাজ্য সরকার। মার্কিন এক গবেষকের পরামর্শে নাকি এই মেলার আয়োজন করা হয়েছিল। তৃণমূল কংগ্রেসের হুগলি জেলার নেতারা গণমাধ্যমে এমনটাই দাবি করেছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের এই আয়োজনকে ‘দেশের স্বর্ণযুগের সঙ্গে যুব সম্প্রদায়কে জোড়ার এক প্রশংসনীয় উদ্যোগ’ বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
কুম্ভ মেলার পাশাপাশি কলকাতাসহ গোটা পশ্চিমবঙ্গে ব্যাপক হারে হিন্দু মন্দির গজিয়ে উঠেছে। কখনো তা স্থানীয় দেবতার নামে—যেমন শনি ঠাকুর, কখনো ধর্মীয়-ইতিহাসিক চরিত্রের নামে যেমন বাবা লোকনাথ, কখনো বাঙালি হিন্দুদের ঘরোয়া দেবতা শিব-কালী-লক্ষ্মী ইত্যাদির নামে। আবার কখনোবা সরাসরি উত্তর বা দক্ষিণ ভারত থেকে আমদানি করা রামচন্দ্র, হনুমান (বজরংবলী), গণেশ বা সাঁই বাবার নামে। সে তুলনায় রাজ্যে নতুন মসজিদ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। এই রাজ্যে মোটামুটি ৩০ শতাংশ মুসলমান। স্বাভাবিকভাবেই এই নীতির প্রতিক্রিয়া হবে। কারণ, মানুষ ধরে নেবেন তৃণমূলের কাউন্সিলর, এমএলএদের সহযোগিতা ছাড়া এই ধরনের মন্দির স্থানীয় মানুষের পক্ষে বানানো সম্ভব নয়। এর পেছনে বিজেপি আছে কি না, সে প্রশ্ন অবান্তর। কারণ, সর্বত্রই তৃণমূলের রমরমা। মুসলমান সম্প্রদায়ের নারাজ হওয়ার এটাও একটা কারণ।
এ ছাড়া কোনো রাজনৈতিক দল ভারতে এক দশকের বেশি ক্ষমতায় থাকলে স্বাভাবিকভাবে ক্ষমতাসীনদের বিরোধিতার হাওয়া (অ্যান্টি-ইনকামবেন্সি) বইতে শুরু করে। ভারতে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপিকেও এই হাওয়ার মুখোমুখি হতে হচ্ছে বলে মনে করছে খোদ আরএসএস। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের বিরুদ্ধে একই হাওয়া বইছে। ফলে হিন্দু ও মুসলমান—দুই সম্প্রদায়ই তৃণমূল কংগ্রেসের ওপরে খেপে আছে। মুসলমানদের ক্ষোভ একটু বেশি। কারণ, মমতার নানা পদক্ষেপকে তাঁরা সম্পূর্ণ হিন্দুত্ববাদী বলে
মনে করছেন।
এই কারণেই হয়তো গত ফেব্রুয়ারিতে মুর্শিদাবাদ জেলার সাগরদিঘিতে অনুষ্ঠিত বিধানসভা উপনির্বাচনে তৃণমূল থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন সংখ্যালঘু মসুলমানরা। সাগরদিঘিতে জনসংখ্যার ৬৫ শতাংশ মুসলমান। সেখানে একজন হিন্দু ব্রাহ্মণ প্রার্থী দিয়েছিলেন মমতা। তৃণমূল কংগ্রেসের এক সাবেক মুসলমান এমপির কথায়, দিদি হয়তো দেখাতে চেয়েছিলেন, মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে তাঁর প্রভাব কমেনি। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে হিন্দু প্রার্থী দিয়েও তিনি তাঁকে জিতিয়ে আনার ক্ষমতা রাখেন। কিন্তু মুসলমান সম্প্রদায় তাঁকে ভুল প্রমাণ করেছেন।
মমতা ভালো করেই বোঝেন, পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান ভোটে ভাঙনের কী অর্থ হতে পারে। ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট সরকারের হেরে যাওয়ার যদি একটি মাত্র কারণ বলতে হয়, তাহলে বলতে হবে সংখ্যালঘু ভোটে ভাঙন। সাগরদিঘি ইঙ্গিত দিচ্ছে, তৃণমূলের সংখ্যালঘু ভোটে ভাঙন শুরু হয়েছে।
অবশ্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বসে থাকার পাত্রী নন। সাগরদিঘিতে হারের সঙ্গে সঙ্গেই তিনি মাঠে নেমে পড়েন। প্রথমেই তিনি হারের কারণ খতিয়ে দেখতে মুসলমান সম্প্রদায়ের নেতাদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেন। সরিয়ে দেন সংখ্যালঘুবিষয়ক দপ্তরের মন্ত্রীকে এবং ওই দপ্তরে ফিরিয়ে আনেন তাঁর প্রিয় সচিব পি বি সেলিমকে। একটি সংখ্যালঘু উন্নয়ন বোর্ড গঠনের পাশাপাশি মুসলমান সম্প্রদায়ের আলেম-ইমামদের দায়িত্ব দেন, মুসলমান সম্প্রদায় কেন তৃণমূল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে—সে সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে। মুসলমান সম্প্রদায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বললে তাঁরাই প্রথম আলোকে এসব তথ্য জানিয়েছেন।
সবশেষে সাগরদিঘি উপনির্বাচনে জয়ী কংগ্রেস প্রার্থী বায়রন বিশ্বাসকে নিজেদের দলে ভিড়িয়ে নেয় তৃণমূল। বায়রন নিজেও অকপটে বলেন, ‘আমি তো বরাবর তৃণমূলই করতাম।’
তবে মমতা যতই পদক্ষেপ নেন বা তৎপরতা দেখান, তারপরও বাঙালি ও অবাঙালি দুই গোষ্ঠীর মুসলমানের অনেকেই ঘরোয়া কথাবার্তায় বলছেন, মধ্য বাংলায় অর্থাৎ মালদা ও মুর্শিদাবাদে যেখানে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং কংগ্রেস এখনো শক্তিশালী, সেখানে তাঁরা কংগ্রেসকে ভোট দেবেন। আরও কয়েকটি জেলায়ও তাঁরা কংগ্রেসকে ভোট দেওয়ার কথা ভাবছেন। এটা তৃণমূলের জন্য সুখের খবর নয়।
হঠাৎ পশ্চিমবঙ্গে মৃতপ্রায় কংগ্রেসের প্রতি মুসলমান সম্প্রদায়ের একটা অংশের আস্থা বৃদ্ধির পেছনে একটা ব্যাখ্যা হলো কর্ণাটক নির্বাচনে তাদের বিরাট জয়। কংগ্রেসের এই জয় মমতাকেও যে কিছুটা চিন্তায় ফেলেছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই।
গত মার্চে মমতা জোর দিয়ে বলেছিলেন, আগামী লোকসভা নির্বাচনে কোনো দলের সঙ্গে হাত না মিলিয়ে তৃণমূল একাই লড়বে। কিন্তু মে মাসে কর্ণাটকে কংগ্রেসের জয়ের পর তিনি বলেছেন, যেখানে কংগ্রেস শক্তিশালী, সেখানে তাদের সমর্থন দিতে তৃণমূলের আপত্তি নেই। তবে ওদেরও আঞ্চলিক দলকে সমর্থন দেওয়া উচিত।
অর্থাৎ কংগ্রেসসহ বিরোধী জোট থেকে গত মার্চে খানিকটা দূরে সরে গেলেও আবার কিছুটা কাছাকাছি ফেরার চেষ্টা করছেন মমতা। এ অবস্থায় কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা তৃণমূল কংগ্রেসের ওপরে চাপ বাড়াচ্ছে, তাদের নেতা–নেত্রীদের নিয়মিত জেরা করা হচ্ছে। দলের দ্বিতীয় প্রধান নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর স্ত্রী রুজিরাকেও জেরা করছে ইডি-সিবিআই। অর্থাৎ সরাসরি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিবারের ওপরে চাপ শুরু হয়েছে।
একদিকে প্রধান ভোটব্যাংক মুসলমানদের চাপ এবং অন্যদিকে কেন্দ্রের গোয়েন্দা সংস্থার লাগাতার জেরা—এই অবস্থায় আগামী লোকসভা নির্বাচনের আগে কী করবেন মমতা? একটু কি বিজেপির দিকে ঘেঁষবেন নাকি সরে যাবেন জোটের দিকে?
এই প্রশ্নের উত্তর পেতে অপেক্ষা করতে হবে নভেম্বর-ডিসেম্বর পর্যন্ত। ওই সময় অন্যান্য রাজ্যের সঙ্গে ভারতের দুটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশে নির্বাচন হবে। এই দুটি নির্বাচনে যদি কংগ্রেস হারে, তাহলে হয়তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নীতি হবে মধ্যপন্থা বজায় রাখা। যদি বিজেপি হারে, সে ক্ষেত্রে তিনি হয়তো অনেকটাই সরে যাবেন বিরোধী জোটের দিকে। পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সম্প্রদায়ও নিঃসন্দেহে তাদের নির্বাচনী রাজনীতি স্থির করবে মুখমন্ত্রীর গতিবিধি দেখেই।
শুভজিৎ বাগচী প্রথম আলোর কলকাতা সংবাদদাতা