প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে দেশে বহুল আলোচিত–চর্চিত বিষয় হলো আজিজ ও বেনজীর–সংক্রান্ত খবরাখবর। এগুলোকে ‘টক অব দ্য টাউন’ বললে কম বলা হবে, ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’ বলা যেতে পারে। আজিজ ও বেনজীর—এই দুই ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে খুব কাছাকাছি সময়ে কিছু তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে যেমন কিছু মিল রয়েছে, তেমনি অমিলও লক্ষ্য করা গেছে। লক্ষণীয় হলো, বেনজীর ও আজিজ ইস্যুতে কিছু প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে কিংবা এখনো আলোচনার বাইরে রয়ে গেছে।
একসময় সরকারের অতি ঘনিষ্ঠ সাবেক আইজিপি (পুলিশের মহাপরিদর্শক) বেনজীর আহমেদ যে সরকারের নেক নজরে নেই, বেশ কিছুদিন থেকেই সেটির ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল। অন্যদিকে সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা অনেকটা ‘বিনা মেঘে বজ্রপাত’–এর মতো। গত ১৪ মে দুই দিনের সফরে ঢাকায় আসেন মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। এই সফরে তিনি ‘তিক্ততা সরিয়ে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার বার্তা দিয়েছেন’—অনেকেই এমনটা মনে করেছিলেন। কিন্তু তিনি ফিরে যাওয়ার কয়েক দিন পরেই ২১ মে রাতে আজিজের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার খবরটি আসে।
ঘটনাক্রম থেকে প্রতীয়মান হয়, বেনজীরের বিরুদ্ধে সরকার নিজে থেকেই ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। অপর দিকে আজিজের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিষয়টা সরকারের জন্য ছিল ‘অপ্রত্যাশিত’।
বেনজীর ও আজিজের দুর্নীতি এবং বেইআইনি কর্মকাণ্ডের দায় সরকার এড়াতে পারে কি না, কেউ কেউ এমন প্রশ্ন তুলেছেন। এ রকম প্রেক্ষাপটে সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে তাদের কর্মকাণ্ডকে ব্যক্তিগত অপরাধ হিসেবে বলা হচ্ছে। (বেনজীর ও আজিজের অপরাধ ব্যক্তিগত, তাদের শাস্তি পেতেই হবে: ওবায়দুল কাদের, সমকাল, ২৯ মে ২০২৪)। স্বাভাবিকভাবেই যে প্রশ্নটা উঠেছে, তাদের অপরাধগুলো কী?
বেনজীরের বিরুদ্ধে তদন্ত ও সম্পত্তি জব্দের নির্দেশ এবং আজিজের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা নিয়ে সংবাদমাধ্যম ও জনপরিসরে যত আলোচনা হচ্ছে, সেগুলোর বিষয় হলো তাদের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ। তাঁরা নিজেরা এবং তাঁদের স্বজনেরা কীভাবে, কত অর্থ–বিত্ত–সম্পত্তির মালিক হয়েছেন, বেআইনি বা নিয়মবহির্ভূত কর্মকাণ্ড করেছেন এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করে সুযোগ–সুবিধা নিয়েছেন—আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুটা এখন পর্যন্ত সেদিকেই। কিন্তু আলোচিত এই দুই ব্যক্তির ‘অপরাধ’ কি এসবেই সীমাবদ্ধ?
যে প্রশ্নগুলো জোর দিয়ে তোলা দরকার, তা হলো মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য বেনজীর ও আজিজকে কি বিচারের মুখোমুখি করা হবে? তাঁদের এসব কর্মকাণ্ডে তো ক্ষমতাসীনেরাই লাভবান হয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রে দায় তো সরকারেরই বেশি। তাহলে সরকার কেন তাদের বিচার করবে?
আজিজ নতুন হলেও বেনজীর বেশ অনেক দিন ধরেই মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মধ্যে রয়েছেন। ২০২১ সালে র্যাব (র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন) এবং সংস্থাটির তৎকালীন ও সাবেক ছয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। তাঁদের মধ্যে র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) হিসেবে বেনজীরের নামও ছিল। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে এই নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল। তখন অবশ্য সরকারের পক্ষ থেকে এই অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছিল।
আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তিন মেয়াদে (২০০৯–২০২৪) বেনজীর তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। তিনি প্রথমে ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার, এরপর র্যাবের মহাপরিচালক এবং সর্বশেষ পুলিশের মহাপরিদর্শক ছিলেন। এসব পদে থাকা অবস্থায় তাঁর কথা ও কাজে ক্ষমতাসীন দলের প্রতি তাঁর সমর্থনের বিষয়টি ছিল বেশ খোলামেলা। বিভিন্ন সময় তিনি বিরোধী দলের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। বিরোধীদের অভিযোগ, ২০১৮ সালের নির্বাচনে পুলিশকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করেছিলেন তিনি। বেনজীরের বিরুদ্ধে তাই শুধু দুর্নীতি নয়, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার মতো অভিযোগও আছে।
বেনজীরের মতো আজিজও আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পেয়েছিলেন। তিনি প্রথমে বিজিবির (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) মহাপরিচালক এবং পরে সেনাপ্রধান হন। ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় আজিজ ছিলেন সেনাপ্রধান। সেই নির্বাচনের পরিস্থিতি ছিল ভিন্নরকম। নির্বাচনের আগে বিরোধী দলের কর্মী ও প্রার্থীদের গ্রেপ্তার এবং বিরোধীদের ওপর সরকারি দলের হামলার বহু অভিযোগ উঠেছিল। সে রকম এক সময়ে তিনি বলেছিলেন, ‘বিগত ৪৭ বছরে এ রকম শান্ত ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ আমি দেখিনি।’ ( গত ৪৭ বছরে নির্বাচনে এমন শান্তিপূর্ণ পরিবেশ দেখিনি: সেনাপ্রধান, ইত্তেফাক, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৮)
২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস মেন’ নামে একটি ডকুমেন্টারি প্রচার করেছিল। এই ডকুমেন্টারিতে তৎকালীন সেনাপ্রাধান আজিজ ও তাঁর ভাইদের কর্মকাণ্ড নিয়ে বিভিন্ন অভিযোগ তোলা হয়েছিল। তখন এসব অভিযোগ আমলে নেওয়া হয়নি; বরং এটাকে সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ড হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে।
লক্ষণীয় হলো, আজিজের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি জানাতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘তাঁর (আজিজ আহমেদ) কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবমূল্যায়ন এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়ার ওপর জনগণের আস্থা কমেছে।’ (প্রথম আলো অনলাইন, ২১ মে ২০২৪)
আজিজের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত ভিসা নীতি নয়, অন্য একটি আইনের অধীন নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। যেসব অপরাধের কারণে এ আইনে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়, তার মধ্যে রয়েছে ‘ক্লেপ্টোক্র্যাসি’। ক্লেপ্টোক্র্যাসির আভিধানিক অর্থ হলো ‘চোরদের শাসন’। বর্তমান সময়ে ক্লেপ্টোক্র্যাসি বলতে স্বৈরাচার ও অলিগার্কদের দ্বারা পরিচালিত রাষ্ট্রব্যবস্থাকে বোঝানো হয়। কোন ছোট বা মামুলি বা ব্যক্তিগত দুর্নীতি নয়, এরকম ব্যবস্থায় ক্ষমতাবানদের একটি চক্র বড় ধরনের রাজনৈতিক দুর্নীতিতে জড়িত থাকে।
ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কথামতো দুর্নীতির অভিযোগে বেনজীর ও আজিজ শেষ পর্যন্ত শাস্তি পাবেন কি না, সে বিষয়ে জোর দিয়ে কিছু বলা যাচ্ছে না। কারণ, তাদের নিয়ে সরকারের অবস্থান এখনো পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। অতীত ও বর্তমানের ভূমিকার জন্য কে কতটা ছাড় পাবেন আর কে কতটা রোষানলে পড়বেন, সেটিও বোধগম্য হচ্ছে না।
এ রকম অবস্থায় যে প্রশ্নগুলো জোর দিয়ে তোলা দরকার, তা হলো মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য বেনজীর ও আজিজকে কি বিচারের মুখোমুখি করা হবে? তাঁদের এসব কর্মকাণ্ডে তো ক্ষমতাসীনেরাই লাভবান হয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রে দায় তো সরকারেরই বেশি। তাহলে সরকার কেন তাদের বিচার করবে?
বেনজীর ও আজিজ ছিলেন একটি ব্যবস্থার অংশ। প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়ায় তাঁদের আর আগের মতো গুরুত্ব নেই। কিন্তু সেই ব্যবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। বেনজীর ও আজিজের মতো আরও অনেকেই নিশ্চয়ই এখনো বহাল তবিয়তে আছেন এবং পূর্বসূরিদের দেখানো পথেই হাঁটছেন। সেই ব্যবস্থার পরিবর্তন ছাড়া মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণতন্ত্র ধ্বংসের জন্য তাদেরকে বিচারের মুখোমুখি করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক