শরীফার গল্প: তর্ক–বির্তকে কেন আমি পক্ষে কেন বিপক্ষে

পত্রিকার পাতা ভিজিট করলে কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্ক্রল করলে যে কেউ বলবে—এ মুহূর্তে টক অব দ্য কান্ট্রি হলো সপ্তম শ্রেণির বইয়ের ‘শরীফার গল্প’। সমাজের একটি অংশ মনে করছে, এই গল্পের মাধ্যমে প্রচ্ছন্নভাবে সমকামিতাকে উৎসাহিত করা হয়েছে, যা তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক; অন্য একটি অংশ মনে করছে, এই গল্পের সঙ্গে সমকামিতার কোনো সম্পর্ক নেই।

পাঠ্যক্রমে এই বিষয়ের অন্তর্ভুক্তি কতটা ইতিবাচক এবং এটি সপ্তম শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত করা ঠিক হয়েছে কিনা, এমন প্রশ্ন আমার এবং এ লেখাতে এর উত্তরও খুঁজেছি।

এই গল্পের কোনো জায়গায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ—কোনোভাবে সমকামিতাকে উৎসাহিত করা হয়েছে কিনা, সেটিও আমি দেখতে চাই।

তবে দুই অংশের সঙ্গেই ভিন্ন ভিন্নভাবে একমত হয়ে আমি বলতে চাই, এই গল্প নতুন করে লেখার দাবি রাখে। গোটা লেখাটি পড়লে আশা করি এ দাবির বিষয়টি পাঠকদের কাছে খোলাসা হবে।

নতুন কারিকুলামের সপ্তম শ্রেণির সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে ‘শরীফার গল্প’ আমার নজরে পড়ে ২০২৩ সালে নতুন কারিকুলাম যখন পরীক্ষামূলকভাবে প্রথম শুরু হয়।

এই গল্প পড়ে আমার কাছে মনে হয়েছিল, গল্পের মূল চরিত্র শরীফার আইডেনটিটি নিয়ে যথেষ্ট পরিমাণে অস্পষ্টতা রয়েছে। গল্পের অসংগতি তুলে ধরে গল্পটি পরিমার্জনার সুপারিশ করে ২০২৩ সালে ২৩ জানুয়ারি বাংলা ট্রিবিউনে ‘সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য ট্রান্সজেন্ডার পাঠ কতটা জরুরি?’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম।

আমি উক্ত নিবন্ধে দেখিয়েছিলাম, শরীফার গল্পে শরীফার জবানিতে লেখা ‘…আমরা নারী বা পুরুষ নই, আমরা হলাম “ট্রান্সজেন্ডার”’—একটি স্ববিরোধী বাক্য। কারণ, শরীফা ও তার পরিচিত ব্যক্তি—উভয়েরই জেন্ডার এক্সপ্রেশন আছে এবং উভয়ই নিজেদের বায়োলজিক্যাল সেক্সের বিপরীত জেন্ডার হিসেবে চিহ্নিত করে, যাকে বৃহৎ অর্থে ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তি বলা যায়।

স্বাভাবিকভাবেই এ বছর নতুন বই আগ্রহ নিয়ে পড়তে গিয়ে লক্ষ করি, উল্লেখিত বাক্যের শেষ অংশে ‘ট্রান্সজেন্ডার’ পদকে ‘থার্ড জেন্ডার’ দ্বারা প্রতিস্থাপন করে লেখা হয়েছে—‘আমরা নারী বা পুরুষ নই, আমরা হলাম তৃতীয় লিঙ্গ (থার্ড জেন্ডার)’ (‘শরীফার গল্প’, ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান, ২০২৪, সপ্তম শ্রেণি, পৃষ্ঠা নম্বর ৪০)।

আপাতদৃষ্টিতে সমস্যার সমাধান হয়েছে মনে করা হলেও মূল সমস্যা কিন্তু এখনো রয়ে গিয়েছে। কেননা, প্রথমত, ওই গল্পে শরীফা ও তার পরিচিত ব্যক্তি—উভয়ের ক্ষেত্রে, অর্থাৎ তাদের জন্মগত কোনো শারীরিক ত্রুটি নেই। বরং তারা জৈবিক লিঙ্গের বিপরীত লিঙ্গের ব্যক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন। সুতরাং বৃহৎ অর্থে তারা উভয়েই ট্রান্সজেন্ডার। আর ট্রান্সজেন্ডার বলেই সেক্স রিঅ্যাসাইনমেন্ট না করলেও তারা তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তি নন; ‘নারী নই, পুরুষও নই’—এই দাবি তাদের চরিত্রের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ।

দ্বিতীয়ত, ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তির ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি শর্ত হচ্ছে ‘পাসিং’। এই পাসিং শর্তের মধ্যে আছে, সেক্স রিঅ্যাসাইনমেন্ট সার্জারি, হরমোনাল ট্রিটমেন্ট, চুলের কাট, পোশাক, অঙ্গভঙ্গি, আচরণ ইত্যাদির মধ্য দিয়ে সমাজে পুরুষ থেকে নারী কিংবা নারী থেকে পুরুষে রূপান্তরিত হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা। শরীফা ও তার সহযোগী সেক্স রিঅ্যাসাইনমেন্ট সার্জারি, হরমোনাল ট্রিটমেন্ট না করে থাকলেও ‘পাসিং’-এর অন্যান্য শর্ত ভালোভাবে পূরণ করতে পেরেছে।

তৃতীয়ত, ‘শিক্ষক সহায়িকা’-এর ২১ নম্বর পৃষ্ঠায় স্পষ্টভাবে হিজড়া ও ট্রান্সজেন্ডারের পার্থক্য তুলে ধরা হয়েছে। এ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘...হিজড়া একটি সংস্কৃতির নাম। তারা প্রথাগত সমাজের বাইরে একটি সুনির্দিষ্ট জীবনযাত্রার ধরন গড়ে তোলে। এই সুনির্দিষ্ট জীবনযাত্রার বাইরের মানুষের লিঙ্গপরিচয় যা-ই হোক না কেন, সে হিজড়া সংস্কৃতির অংশ না।’ এর পরের অনুচ্ছেদে বুলেট পয়েন্টে বলা হয়েছে, ‘গল্প পড়া শেষে শিক্ষার্থীদের একজন/কয়েকজন ট্রান্সজেন্ডার মানুষের ছবি দেখান।...বাংলাদেশের অনেক ট্রান্সজেন্ডার এবং হিজড়া জনগোষ্ঠীর মানুষ সমাজজীবনে এবং পেশাগত জীবনে সাফল্য পেয়েছেন। তাদের সম্পর্কে জানান এবং দেশের বাইরের অন্যান্য লিঙ্গের সফল মানুষের কথাও বলুন।’ (শিক্ষক সহায়িকা, ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান, ২০২৪, সপ্তম শ্রেণি, পৃষ্ঠা: ২১)

অর্থাৎ ‘শরীফার গল্প’ এবং এই ‘শিক্ষক সহায়িকা’ পড়ে আমার মনে হয়েছে, গল্পটি যতটা না হিজড়াদের বঞ্চনার গল্প, তার চেয়ে বেশি ‘জেন্ডার ডিসফোরিয়া’ বা ট্রান্সজেন্ডার নরনারীর শরীর ও মনের দ্বন্দ্ব এবং সংঘাতের সংক্ষিপ্ত ও অপূর্ণাঙ্গ উপাখ্যান। ‘হিজড়া’ শিরোনামের মোড়কে এ গল্পে আসলে ট্রান্সজেন্ডার-সংক্রান্ত আলোচনা করা হয়েছে।

অন্যভাবে বলা যায়, এখানে ‘হিজড়া সম্প্রদায়ের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিকে উপস্থাপন করা হয়েছে, যদিও তাদের পরিচয় দেওয়া হয়েছে তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তি হিসেবে। সুতরাং এই গল্পে লেখক একদিকে যেমন শরীফা ও তার সহযোগীকে আইডেনটিটি ক্রাইসিসে ফেলে তাদের প্রতি অন্যায় করেছেন, তেমনি এখানে হিজড়া সম্প্রদায়ের প্রধান প্রতিনিধিত্বকারী তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিকে ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তির সঙ্গে ‘আইডেনটিক্যাল’ করা হয়েছে; উপেক্ষিত হয়েছে হিজড়া সম্প্রদায়ের অন্য প্রতিনিধিদের। কেননা, ‘হিজড়া’ যদি একটি সেট হয়, ট্রান্সজেন্ডার সেই সেটের অতি ক্ষুদ্র একটি উপসেটমাত্র।

এর অর্থ এই নয় যে এ গল্পে সমকামিতাকে উৎসাহিত করা হয়েছে। বস্তুত, একজন ব্যক্তির সেক্স আইডেনটিটি ও জেন্ডার এক্সপ্রেশনের সঙ্গে তার সেক্সুয়াল অরিয়েন্টেশনের কোনো সম্পর্ক নেই। কোনো ব্যক্তিকে সমকামী বলা হবে যদি সে তার রোমান্টিক সম্পর্কের সঙ্গী হিসেবে একই সেক্সের ব্যক্তিকে বেছে নেয়। এ ক্ষেত্রে একজন সিসজেন্ডার ব্যক্তি (যার জন্মগত বায়োলজিক্যাল লিঙ্গ তার জেন্ডার এক্সপ্রেশনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ) যেমন সমকামী হতে পারেন, তেমনি সমকামী হতে পারেন একজন ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিও।

শরীফার গল্পে শরীফা ও তার সহযোগীর রোমান্টিক সম্পর্ক নিয়ে কোনো আলোকপাত করা হয়নি। এ ক্ষেত্রে শরীফার রোমান্টিক সঙ্গী হিসেবে একজন ট্রান্সপুরুষ (যার বায়োলজিক্যাল লিঙ্গ নারী, কিন্তু মানসিকভাবে পুরুষ) অথবা বায়োলজিক্যালি পুরুষ, কিন্তু মানসিকভাবে নারী অথবা সেক্স রিঅ্যাসাইনমেন্টকারী সম্পূর্ণ ট্রান্সপুরুষ অথবা সম্পূর্ণ ট্রান্সনারী অথবা সিসপুরুষ অথবা সিসনারী কল্পনা করা যেতে পারে, অথবা শরীফাকে আজীবন অবিবাহিতও কল্পনা করা যেতে পারে।

উপরোক্ত বিকল্পগুলোর মধ্যে কেবল দ্বিতীয়, তৃতীয় ও পঞ্চম বিকল্প সত্যি হলেই শরীফা একজন সমকামী হবেন, যেখানে একজন সিসনারীর জন্য প্রথম, চতুর্থ ও ৬ষ্ঠ বিকল্প সত্যি হলে তাকে সমকামী বলা যাবে। অর্থাৎ জেন্ডার পরিবর্তন কিংবা সেক্স রিঅ্যাসাইনমেন্ট কোনোটির সঙ্গেই সমকামিতার কোনো সম্পর্ক নেই, নেই কোনো বিরোধও। উপরন্তু, জেন্ডার পরিবর্তন না করেও সমকামিতায় লিপ্ত হওয়ার অনেক উদাহরণ আছে।

প্রশ্ন হলো, সমকামিতাকে উৎসাহিত না করলেও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য ট্রান্সজেন্ডার পাঠ কতটা জরুরি? আমি মনে করি, সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য ট্রান্সজেন্ডার পাঠ দেওয়া মানে হলো একজন আন্ডারওয়েট ব্যক্তির কাঁধে কয়েক মণের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া। খেলা শুরু হওয়ার আগে যেমন মাঠ প্রস্তুত করা প্রয়োজন, তেমনি কোনো শিক্ষার্থীকে একটি বিশেষ বিষয়ের পাঠদানের পূর্বে সেটি গ্রহণের মতো তার পর্যাপ্ত প্রস্তুতি আছে কি না, সেটি মাথায় রাখা প্রয়োজন।

লিঙ্গ নির্ধারণে ক্রোমোজম ও জিন সিকোয়েন্স অল্টারেশন, জিন এক্সপ্রেশন অল্টারেশনের ভূমিকা কতটুকু, সেই পাঠ না দিয়ে XX এবং XY ক্রোমোজমের বিন্যাসের কারণে ইন্টারসেক্স ব্যক্তির জন্ম হয়, এ ধারণা দেওয়া মানে হলো একজন শিক্ষার্থীকে সংখ্যার ধারণা না দিয়ে যোগ, বিয়োগ, ভাগের সমীকরণ শেখানো। শিক্ষা একটি পিরামিডের মতো। এখানে একটি মজবুত ভিত্তির ওপর গাঁথুনি দিয়ে ধীরে ধীরে অধিকতর জটিল ও কঠিন বিষয়ের পাঠ দিতে হয়।

বয়স বিচারে সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের প্রতি শিক্ষাক্রমের মূল দায়িত্ব হলো তাদের মানবিক মানুষ হিসেবে তৈরি করা। সমাজে তারা যাতে বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ ও গোত্রের মানুষের সঙ্গে বৈষম্যহীন আচরণ করতে শেখে, সেই নির্দেশনা প্রদান করা। সেই বিচারে সমাজের নিগৃহীত শ্রেণি হিসেবে ‘হিজড়া’ সম্প্রদায়ের প্রতি বৈষম্যহীন আচরণ ও নিজেদের একজন হিসেবে গ্রহণ করার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। আর এ কাজ করার জন্য শুধু পাঠ্যপুস্তকে পাঠদানের মধ্যে বিষয়টিকে সীমাবদ্ধ না রেখে ‘হিজড়া’ জনগোষ্ঠীকে মূলধারার সঙ্গে শিক্ষা, চাকরিসহ সব ক্ষেত্রে যাতে সমান নাগরিক সুবিধা ভোগ করতে পারে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে।

জন্মগত ত্রুটির কারণে কোনো ব্যক্তিকে যাতে তাঁর পরিবার ছাড়তে বাধ্য হতে না হয়, শিক্ষা, চাকরি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে তাঁদের অধিকার নিশ্চিত করাটাও জরুরি। সেই সঙ্গে জরুরি সব শ্রেণির ব্যক্তিকে একই ক্লাসরুমে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যবস্থা করা। সবচেয়ে বড় কথা, একটি সমাজে কার লিঙ্গপরিচয় কী, কে নিজেকে কী হিসেবে অনুভব করে, সেই হিসাব না কষে সমাজের প্রত্যেক মানুষের প্রতি মানবিক আচরণের শিক্ষা দান করা।

আমার কাছে মনে হয়েছে, ‘শরীফার গল্প’ যেভাবে লেখা হয়েছে, তাতে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে মূলধারার সমাজে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি উপেক্ষিত হয়েছে। তার পরিবর্তে তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিকে হিজড়া সম্প্রদায়ের সদস্য হিসেবে গ্রহণ করে তার নিগৃহীত জীবনাচারকে পরোক্ষভাবে সমর্থন দেওয়া হচ্ছে।

অন্যদিকে ‘শিক্ষক সহায়িকা’র পৃষ্ঠা ২০ ও ২১-এর লিঙ্গবৈচিত্র্য বা জেন্ডার বৈচিত্র্য সেকশনে ব্যক্তির লিঙ্গ নির্ধারণে XX এবং XY ক্রোমোজমের বিন্যাস সম্পর্কে খুবই অস্পষ্ট ও দায়সারাভাবে ধারণা দেওয়া হয়েছে। ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তির জেন্ডার পরিবর্তনে কী কী শারীরিক, মানসিক, আইনগত, আর্থিক ও নৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, সে বিষয়ে কোনো ধারণা দেওয়া হয়নি। কেননা, সেক্স রিঅ্যাসাইনমেন্ট অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। এ ক্ষেত্রে আছে কিছু স্বাস্থ্যঝুঁকি, ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তি জেন্ডার পরিবর্তনের পর তাঁর সিদ্ধান্তের জন্য পরবর্তীকালে অনুতাপ করবেন কি না, সেটিও বিবেচনা করা জরুরি।

এ প্রক্রিয়ায় অনুসরণ করতে হয় আইনগত ও নৈতিক প্রক্রিয়া। সপ্তম শ্রেণিতে এ বিষয়ে পাঠদানকারী শিক্ষকের সক্ষমতা কতটুকু আছে, সেটি বিবেচনায় নেওয়া জরুরি। কারণ, এ বিষয় সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা পেতে হলে বায়োলজি ভালোভাবে জানার সঙ্গে সঙ্গে সমাজবিজ্ঞান ও দর্শনের বিভিন্ন তত্ত্ব সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা আবশ্যক; থাকা আবশ্যক এ বিষয়ে বিশেষায়িত জ্ঞান। সুতরাং ছাত্রকে শিক্ষিত করতে হলে শিক্ষককে শিক্ষিত করা বেশি প্রয়োজন।

তাই  ট্রান্সজেন্ডারের মতো নাজুক, বিতর্কিত ও জটিল বিষয়ের পাঠদানের জন্য যে প্রস্তুতি দরকার, সেটি আমাদের কতটা আছে সেই উত্তর খোঁজা জরুরি। ট্রান্সজেন্ডার-সংক্রান্ত পাঠ একাদশ বা দ্বাদশ শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি ভেবে দেখা যেতে পারে।

সপ্তম শ্রেণিতে এই গল্প অন্তর্ভুক্ত করার উদ্দেশ্য ভালো হলেও মনে রাখতে হবে, একটি সমাজের পরিবর্তন হয় ধীরে ধীরে বিবর্তনের মধ্য দিয়ে। বহু দিনের লালিত ধ্যানধারণা, রীতিনীতি হঠাৎ বদলে দিলে সেখানে সমাজের মানুষ তাকে তাদের ওপর আরোপিত সিদ্ধান্ত বলে মনে করে।

ট্রান্সজেন্ডারের ক্ষেত্রে এমন অনেক বিষয় আছে, যে বিষয়ে বিশেষজ্ঞরাও ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেননি। সে ক্ষেত্রে সমাজের বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণের মানুষ ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারবেন, সেই ধারণা কল্পনাতীত বটে। এমনকি কানাডার মতো উদার ও প্রগতিশীল দেশেও ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তি শিক্ষা ও চাকরির মতো কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা ভোগ করলেও সমাজে তাঁদের গ্রহণযোগ্যতা সিসজেন্ডার ব্যক্তির পর্যায়ে এখনো আসেনি।

সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বয়স বিবেচনা করলে দেখা যায়, এ বয়সে শিক্ষার্থীরা কৌতূহলী ও অনুকরণপ্রিয়। তাই তাদের সামনে এমন দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করা থেকে বিরত থাকা উচিত, যা তাদের জেন্ডার পরিবর্তনের মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজে উৎসাহিত করে। কারও ক্ষেত্রে জেন্ডার পরিবর্তন যদি অবশ্যম্ভাবী হয়, সেটি ব্যক্তির অধিকার। তবে মনে রাখতে হবে, পাঠ্যবইয়ের কোনো বিশেষ কনটেন্ট পড়ে কেউ যেন এমন এক্সপেরিমেন্ট করতে আগ্রহী না হয়, যার জন্য তাকে পরবর্তীকালে অনুতাপ করতে হয়।

পরিশেষে বলতে চাই, ‘শরীফার গল্প’ ব্যক্তির দৈহিক ও মনোজগতের অন্তর্দ্বন্দ্বের গল্প না হয়ে হয়ে উঠুক পরিবার ও সমাজের সদস্য হওয়া সত্ত্বেও নিজের অধিকার থেকে বঞ্চিত এক ব্যক্তির গল্প। শরীফার গল্প জনমনে বিভ্রান্তি নয়, বরং মানবিক মানুষ তৈরিতে ভূমিকা পালন করুক। একই সঙ্গে যদি ট্রান্সজেন্ডার ইস্যু পড়াতেই হয়, তবে তা একাদশ বা দ্বাদশ শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত করা হোক। পুরো গল্প পুনরায় লিখে ঢেলে সাজানো হোক।

  • নাসরীন সুলতানা সহযোগী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং পিএইচডি শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অন্টারিও, কানাডা

    ই-মেইল: nsultana79ju@gmail.com