রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতি আমাদের অঙ্গীকার

‘দশকের পর দশক ধরে বাংলাদেশের মানুষ উদারতা ও মহানুভবতার প্রমাণ দিচ্ছে মিয়ানমারের সংঘাত থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে।’
‘দশকের পর দশক ধরে বাংলাদেশের মানুষ উদারতা ও মহানুভবতার প্রমাণ দিচ্ছে মিয়ানমারের সংঘাত থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে।’

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবির—পিচঢালা রাস্তা শেষ হয়ে যেখানে ইটের রাস্তা শুরু হয়, যেখানে বুড়ো গাছ আর শস্যখেত শেষ হয়ে শুরু হয় কাঁটাতারের বেড়া আর বাঁশ–তেরপলের ঝুপড়ি ঘর, সেখানে আছে একদল মানুষ। যাদের কথা ভুলে গেছে পৃথিবীর অনেকেই। ক্যাম্পে ঢুকতেই চোখে পড়ে উচ্ছল শিশুর দল, বিভিন্ন বিতরণকেন্দ্রে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা নারী-পুরুষ, দৈনন্দিন ব্যবহারের হরেক রকম  ছোট ছোট দোকান, কিছুটা ভিন্ন পোশাকে থাকা শরণার্থী স্বেচ্ছাসেবী—সব মিলিয়ে ব্যস্ত এক জীবন।

পাঁচ বছর পর কক্সবাজারে ফিরে বুঝতে পারি, অনেক কিছু বদলে গেছে। কিছু পরিবর্তন হয়েছে ইতিবাচক, কিছু তেমন ভালো নয়। ২০১৭ থেকে ২০১৮ সালে যা ছিল একটি মানবিক জরুরি অবস্থা, তা এখন রূপ নিয়েছে প্রলম্বিত সংকটে। আমার স্মৃতিতে ছিল ধুলামাখা ধূসর ন্যাড়া পাহাড়, যেগুলো আবার ফিরে গেছে পুরোনো সবুজে। প্রকৃতি পুনরুদ্ধারের এক সফল প্রচেষ্টা। প্লাস্টিক আর বেড়ার ঘরগুলোর ছাদে নিজ চেষ্টায় লাগানো শাকসবজির গাছে দারুণ ফলন দেখি। আরও দেখতে পেলাম নতুন সব শিক্ষাকেন্দ্র, উন্নত পয়োনিষ্কাশন আর মজবুত বাঁশের ব্রিজ।

বাংলাদেশি এনজিও আর জাতিসংঘের কর্মীদের কাজ এখন আরও পরিকল্পিত আর গোছানো। সবাই একসঙ্গে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কাজ করছে শরণার্থীদের সুরক্ষায়। প্রায় সব ক্যাম্পে দেখা যায় সরকারি ক্যাম্প ইনচার্জ বা সিআইসিদের অফিস।

মৃদু বাতাস জানান দেয় শীতের আগমন। সবুজ ছায়ায় পুরো পরিবেশ মনোরম লাগে। কিন্তু ওই দূর পাহাড়ে নিজ বাড়ির দিকে তাকিয়ে থেকে শরণার্থীদের দীর্ঘশ্বাস? না, তা এখনো বদলায়নি। নিরাপদ পরিবেশ তৈরি হলেই নিজে দেশে ফিরে যাওয়ার সুতীব্র আকাঙ্ক্ষা এখনো সুস্পষ্ট। মিয়ানমারে নতুন করে শুরু হওয়া সংঘাতের কারণে সে আশা এখন আবারও ক্ষীণ।

এবার আমি বাংলাদেশে এসেছি জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরের প্রতিনিধি (রিপ্রেজেনটেটিভ) হয়ে। নতুন সম্ভাবনা আর নতুন দায়িত্ব আমাকে প্রেরণা দিচ্ছে। আর এগুলো করা সম্ভব শুধু মানবিক ও উন্নয়ন খাতের সম্মিলিত উদ্যোগের মাধ্যমে।

দশকের পর দশক ধরে বাংলাদেশের মানুষ উদারতা ও মহানুভবতার প্রমাণ দিচ্ছে মিয়ানমারের সংঘাত থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে। আমার এখনো মনে আছে, কীভাবে উখিয়া-টেকনাফের জনগণ এই নিপীড়িত মানুষদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছিল। আর বাড়িয়ে দিয়েছিল সাহায্যের হাত। মানবতা আর মানবিকতা সমুন্নত রেখেছে বাংলাদেশ। যার নিজের এক কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছিল ১৯৭১ সালে।

২০১৭ সাল থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা এখনো সংকটের সমাধানের অপেক্ষায়। স্বনির্ভর হওয়ার কোনো সুযোগও তাদের প্রায় নেই বললেই চলে। তারা মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল হয়েই রয়েছে। বৈশ্বিক বিভিন্ন সংকটের কারণে সেই মানবিক সাহায্যও এমনভাবে কমেছে যে প্রতিটি রোহিঙ্গা পরিবারের প্রত্যেক সদস্য খাবারের জন্য এখন মাসে ৮ ডলারের বেশি পাচ্ছে না। অনিশ্চয়তার এই জীবনে তাই আসে আরও প্রতিকূলতা; যার মধ্যে আছে ঝুঁকিতে থাকা মানুষদের নিরাপত্তার সমস্যা।

মানবেতর জীবন আর ক্যাম্পের বিভিন্ন ঝুঁকিসহ সব কঠিন সমস্যার সামনে শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নের জন্য রোহিঙ্গাদের অদম্য ইচ্ছা আমাদের দেখায় তাদের সুদৃঢ় প্রত্যয়। শরণার্থীদের জীবিকা উপার্জনের গঠনমূলক সুযোগ সাহায্য করতে পারে তাদের, আর পাশাপাশি তাদের আশ্রয় প্রদানকারী স্থানীয় জনগণকে। মানবিকতা, উন্নয়ন ও সৌহার্দ্যের সমন্বয় একটি টেকসই সমাধানের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

যতক্ষণ পর্যন্ত তা সম্ভব না হচ্ছে, তত দিন প্রয়োজন জরুরি ও সম্মিলিত প্রয়াস; যেন শরণার্থীরা হত্যা, হুমকি, অপহরণ, চাঁদাবাজির মতো ক্রমবর্ধমান ঝুঁকিগুলো ছাড়া তাদের দৈনন্দিন জীবন যাপন করতে পারে। রোহিঙ্গাদের ভয়ংকর সাগরযাত্রাও বাড়তে দেখছি আমরা।

ইউএনএইচসিআর অক্টোবর মাসে রোহিঙ্গা বিষয়ে উচ্চ পর্যায়ের এক আঞ্চলিক আলোচনার আয়োজন করেছিল। সেখানে বিভিন্ন দেশের সরকার, শরণার্থীদের দ্বারা পরিচালিত সংস্থা, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, উন্নয়ন অংশীদার, থিঙ্কট্যাংক, জাতিসংঘের সংস্থা ও এনজিওগুলো একত্র হয়েছিল। সেখানে সবাই আবার একাত্মতা প্রকাশ করেছিল রোহিঙ্গা শরণার্থী ও তাদের আশ্রয় প্রদানকারী দেশগুলো, বিশেষ করে বাংলাদেশের সঙ্গে। সম্মিলিতভাবে কাজ করার এই যৌথ প্রকাশ এই অঞ্চলে অবশ্যপ্রয়োজনীয়।

এর মধ্যে ছিল মিয়ানমারে নিরাপদে ও স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসনের পরিবেশ তৈরি হলে ফেরার অধিকার নিশ্চিত করা, আর তার সঙ্গে মানবিক সাহায্যের মাধ্যমে শরণার্থীদের আশ্রয় প্রদানকারী দেশ ও তাদের জনগণের জন্য সহায়তা, সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকা শরণার্থীদের অন্য দেশে স্থানান্তর এবং শিক্ষা ও শ্রমের গতিময়তা নিশ্চিতের মাধ্যমে সম্পূরক ব্যবস্থা তৈরির অঙ্গীকার।

ডিসেম্বর মাসে ইউএনএইচসিআর আয়োজন করছে গ্লোবাল রিফিউজি ফোরাম, যেখানে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি আলোচনার জন্য একটি আলাদা অধিবেশনের প্রস্তুতি চলছে। যদিও বর্তমান বিশ্বে বেশ কিছু শরণার্থী সমস্যা চলছে, তারপরও সেখানে বিশ্বের সব প্রান্ত থেকে আসা অংশীদাররা রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা ও সমাধান নিয়ে কথা বলবেন, আর তাদের জন্য নতুন নীতিগত ও আর্থিক অঙ্গীকার প্রকাশ করবেন।

এবার বাংলাদেশে এসে আরেকটা ব্যাপার আমি দেখতে পাচ্ছি, আর তা হচ্ছে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সঙ্গে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর নাটকীয় ও করুণ এক দূরত্ব। এই দূরত্ব শুধুই শারীরিক নয়, অনেকটুকু মানসিক। পৃথিবীতে শরণার্থী ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখেছি, শরণার্থী ও স্থানীয় জনগণের মধ্যে সুসম্পর্ক আসলে উভয় জনগোষ্ঠীকেই সাহায্য করে শান্তি ও সমৃদ্ধি অর্জন করতে, ঠিক যেমন কক্সবাজার অঞ্চল এখন নতুন সম্ভাবনা ও মনযোগ পাচ্ছে বিভিন্ন দিক থেকে।

টেকসই প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনা নিয়ে যখন আলোচনা চলছে, তখন রাখাইন ও মিয়ানমারের অস্থিরতা পর্যবেক্ষণে রাখা উচিত। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। এই সুন্দর দেশ ও তার মানুষগুলোর মধ্যে পাঁচ বছর পর এসে আমার পরিচিত একটা পরিবেশে ফিরে এসেছি। আমি সবাইকে আহ্বান করি, একসঙ্গে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিয়ে কাজ করে যেতে। আর একটি ভালো ভবিষ্যতের জন্য তাদের আশাটা বাঁচিয়ে রাখতে।

  • সুম্বুল রিজভি জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরের বাংলাদেশ অপারেশনের প্রধান।