বেসরকারি কর্মজীবীদের জন্য বেশ কয়েকটি মতামত কলাম লেখার পর, কয়েকজন মালিকপক্ষের মানুষ আমাকে জানিয়েছিলেন, তাঁরা নিজেদের অফিসে ভালো পরিবেশ আর সুযোগ-সুবিধা দেবেন। কিন্তু এখনকার অর্থনৈতিক অবস্থাতে বেশির ভাগ বেসরকারি খাতই সুযোগ-সুবিধা দিতে অপারগ।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, সুখী কর্মচারী আরও ভালো কোম্পানি দিতে পারেন নিজেদের দায়িত্ব থেকেই। হয়তো এই সুযোগ-সুবিধার ফলে ৩ থেকে ৫ শতাংশ কোম্পানির খরচ বাড়বে, কিন্তু কর্মদক্ষতা বাড়ার সুবিধা পাওয়া যাবে বেশি। যার সফলতা দেশই পাবে।
কিন্তু তাঁরা এসব কথা মানবেন না বা উঁচু পদের কিছু কর্মকর্তা আছেন, যাঁরা নিজেদের পারফরম্যান্স দেখানোর জন্য এসব সুযোগ দিতে চান না। একবারও কি কেউ ভেবে দেখেন না—বিদেশি কোম্পানিগুলো এত সুযোগ দিয়ে কীভাবে তাদের ব্যবসায় সফলতা নিয়ে এসেছে? যেহেতু বেসরকারি অফিস দেবে না, তাই এখন সরকারের উচিত এগিয়ে এসে ৯৫ শতাংশ জনগোষ্ঠীর জন্য আইন প্রণয়ন করে, তাদের ভালো থাকার ব্যবস্থা করা।
বেসরকারি চাকরিজীবীদের বেশি চাওয়া–পাওয়া নেই। আসলে তাঁরা অল্প কিছু চাওয়া–পাওয়ার আবর্তেই ঘুরপাক খাচ্ছেন। এখন দেখে নেই, কী কী আইন করা জরুরি?
ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মানসিক চাপের শহর। আবার ট্রাফিক জ্যামে আমাদের জীবনের বড় একটা অংশ ব্যয় হয়। এমতাবস্থায় দুই দিনের ছুটি সবার জন্য জরুরি। বিশ্বের অনেক দেশেই তিন দিনের ছুটির ধারণা চলে এসেছে, সেখানে বাংলাদেশে দুই দিন ছুটি চাওয়া কি খুব বেশি? হ্যাঁ! আমাদের চাপ কমানো যায় যদি শুক্রবারের পরিবর্তে রোববার ছুটি করা হতো।
তাহলে বাইরের বিশ্বের সঙ্গে আমাদের সময় মিলে যেত, আর কাজ ও অনেক কম সময়ে সম্ভব হতো। ধর্মীয় বিবেচনায় বিষয়টা আমাদের জন্য মানা কঠিন। তবে এটিও সত্য, বিশ্বের সব থেকে বড় মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়া বা মধ্যপ্রাচ্যের দেশ আরব আমিরাত বা অনেকের পছন্দের নেতা রিসেপ তায়েফ এরদোয়ানের দেশ তুরস্কে শনি-রোববার ছুটি। জুমার সময়ে শুধু একটা বড় বিরতি থাকে। ধর্মীয় সব পক্ষের সঙ্গে বসে এটি নিয়ে আলোচনা করা যায়।
বিবদমান অবস্থাতে বাংলাদেশ বহির্বিশ্বের সঙ্গে মাত্র চার কর্মদিবস পায়, তা দেশের জন্যই ঠিক করা জরুরি। মানুষের সুস্বাস্থ্য সব থেকে বেশি গুরুত্ব পাওয়া উচিত, সর্বাবস্থায়। বাস্তবতা হচ্ছে, মানুষ কাজ করে তাঁর পরিবারের জন্য। তাই পরিবারের সঙ্গে যদি ভালো সময় কাটাতে পারেন, তার ফল তাঁদের কাজে আসবেই। আর দুই দিন ছুটি হলে মূল্যবান বিদ্যুৎ, পেট্রল বা ডিজেল কম খরচ হবে, যা দেশের জন্যই ভালো।
সরকার সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা করতে চাচ্ছে, কিন্তু পুরো ব্যবস্থাটাই ডিপিএসের আরেক রূপ। এটা সংস্কার করে সবার ট্যাক্স থেকে ফান্ড বানিয়ে সরকারি কর্মচারীদের মতো ৬৫ বছরের ওপর সব জনগোষ্ঠীর জন্য পেনশন ব্যবস্থা চালু করা হোক। এক দেশে দুই রকম আইন থাকতে পারে না।
বেসরকারি খাতের জন্য প্রভিডেন্ট ফান্ড ও গ্র্যাচুইটি ঐচ্ছিক না রেখে বাধ্যতামূলক করার আইন হোক। এই ব্যবস্থা সহজ করা এবং কোম্পানি রেজিস্ট্রেশনের অংশ হিসেবে চালুকরণ বাধ্যতামূলক করলে কোম্পানির জন্য কর্মচারীদের দায়বদ্ধতা বাড়ত। সহজে কেউ অন্য চাকরিতেও যেত না।
সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা—কোম্পানিগুলোকে নিশ্চিত করাতে পারলে সরকারের জন্যই ভালো। আমাদের চিকিৎসা খরচ এখন অনেক বেড়ে গেছে। কোনো কোনো অসুখ একটা পরিবারকে শেষ করে দিতে পারে। এদিকে কোম্পানির জন্যও এই খরচ বহন করা কঠিন, কিন্তু তাদেরও তো দায়বদ্ধতা আছে। এই অবস্থা থেকে দুই পক্ষকে রক্ষা করতে পারে বিমা। স্বল্প খরচে কোম্পানি থেকে বিমা সুবিধা দিয়ে একটা পরিবারকে সাহায্য করা যায়, কিন্তু এর জন্য আইন প্রয়োজন। এই জন্য অবশ্য বিমা কোম্পানির ও নিজেদের উন্নয়ন করা লাগবে, যাতে মানুষ ভরসা করতে পারে তাদের।
এটা এমন একটা বিষয়, কেউ দেয়, কেউ দেয় না। এটা বাধ্যতামূলক করা উচিত সবার জন্য। এটা প্রমাণিত যে, প্ল্যান করা ছুটির পর সবাই আরও ভালোভাবে কাজে ফেরত আসতে পারেন।
আইনে পরিষ্কারভাবে পেইড আপ ক্যাপিটাল এক কোটির বেশি হলে নেট মুনাফার ৫ শতাংশ দেওয়া বাধ্যতামূলক (ওয়ার্কার্স প্রফিট পারটিসিপেটরি ফান্ড)। এটা দিলে ট্যাক্সে সুবিধাও হয়। কিন্তু বেশির কোম্পানি তা কর্মচারীদের দেয় না। এই মুনাফার ২০ শতাংশ যেহেতু সরকারি ফান্ডে জমা থাকে, তাই এ ব্যাপারে সরকারের শক্ত মনিটরিং করা উচিত আর এটা মনিটরিং করা কঠিন কিছুও নয়। কারণ, ট্যাক্স জমা দিতে গেলেই বা অডিটেই সব প্রকাশ হয়ে যায়।
সরকারি অফিসে মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস থাকলেও বেসরকারিতে এই ছুটি ঠিকমতো দেওয়া হয় না, অনেকে একেবারে দিতেও চায় না। নারী উন্নয়নে এটা একটা বড় বাধা। এদিকে ভালো ডে কেয়ার না থাকাতে অনেক মা ইচ্ছা থাকলেও চাকরি চালিয়ে নিতে পারেন না। সরকারের এই ব্যাপারে আইন প্রয়োগের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা জরুরি।
বেসরকারি খাতে বেতন বৃদ্ধির কোনো ধারাবাহিকতা নেই। দিন দিন মূল্যস্ফীতির ফলে তিন থেকে চার বছর পর দেখা যায় বেতন আসলে কমে গেছে। তাই আইন করা উচিত, সেসব কোম্পানি যারা মুনাফাতে থাকবে, তারা তাদের কর্মকর্তা–কর্মচারীদের জন্য ন্যূনতম মূল্যস্ফীতি পরিমাণ বেতন বৃদ্ধি করে প্রতিবছর।
আমি আগেও উল্লেখ করেছিলাম, বেসরকারি কর্মজীবীদের জন্য আসলে কোনো আইন নেই। ফলে তারা ১৮৭২ সালের কন্ট্রাক্ট অ্যাক্ট দিয়ে, সঙ্গে লেবার ল দিতে চলে, যা আসলে কোম্পানিগুলোই নির্ধারণ করে তাদের জন্য কী কী জিনিস চুক্তিতে থাকবে। লেবার ল’তে অনেক কিছু ঐচ্ছিক বলে কোম্পানিগুলো তার সুফল নেয়। ফলাফল অনেক ক্ষেত্রে তারা হয়ে যায় চাকর শ্রেণিভুক্ত। এ থেকে উদ্ধারে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, সরকারের অনেক আইনপ্রণেতাই ব্যবসায়ী এবং তাঁরা তাঁদের অধীনস্থ ব্যক্তিদের সুযোগ দিতে উৎসাহী নন। ফলে সব চাওয়া–পাওয়াই হয় অরণ্যে রোদন।
সুবাইল বিন আলম টেকসই উন্নয়নবিষয়ক কলামিস্ট
ই–মেইল: subail001@gmail.com