বিরাট সিঁড়ি দিয়ে গট গট করে নায়িকার বাবা জনৈক ‘চৌধুরী সাহেব’ নেমে আসছেন। তাঁর গায়ে একটা চক্কর-বক্কর মার্কা আঁকিবুঁকি করা সিল্কের ড্রেসিং গাউন। কোমরের কাছে গাউনের দুটো ফিতে বিষ-গেরো দিয়ে বাঁধা। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। ঠোঁটের কোনায় কামড়ে ধরে থাকা কালো পাইপ।
শওকত আকবর টাইপের চৌধুরী সাহেব সিঁড়ি দিয়ে নেমে নিচতলায় দাঁড়িয়ে থাকা নায়ককে ভারী গলায় বললেন, ‘আমার মেয়ের জীবন থেকে সরে দাঁড়াতে বলো কত চাও? পঞ্চাশ হাজার? ষাট হাজার? সত্তর? আশি?’
চৌধুরী সাহেব টেনেটুনে বড়জোর এক লাখে গিয়ে ঠেকলেন। তার বেশি তাঁকে উঠতে হলো না।
তার আগেই মারাত্মক আত্মমর্যাদাবিশিষ্ট নায়ক বিকট চিৎকার করে ‘চৌধুরী সাহেব! টাকা দিয়ে সব কেনা যায়, ভালোবাসা কেনা যায় না’ টাইপের কিছু একটা বলেটলে পরিবেশ গরম করে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
সত্তর-আশির দশকের বাংলা সিনেমার এই কমন দৃশ্য এখন আর চলে না।
আজকের এই ডিভ্যালুয়েশনের বাজারে কোনো চৌধুরী সাহেব যদি নায়ককে বলেন, ‘কত চাও? পঞ্চাশ? ষাট? সত্তর? আশি?’ —তাহলে দর্শক ধরেই নেবে এই ‘পঞ্চাশ’ মানে ‘পঞ্চাশ হাজার’ না; ওটা হবে ‘পঞ্চাশ কোটি’, নিদেনপক্ষে ‘পঞ্চাশ লাখ’।
কারণ এই বাজারে কারও কারও বাড়ির কাজের লোকও চার শ কোটি টাকার মালিক। এই দেশে এমন লোকও আছে যার ইউরোপে দুই শর বেশি বাড়ি আছে।
কোনো কোনো পিয়নের কয়েক শ কোটি টাকার গাড়ি-বাড়ি আছে। সরকারি অফিসের এমন ড্রাইভারও আছে, যার বাড়ির একটা দরজা বানাতেই খরচ হয়েছে দশ লাখ টাকা।
গত দুই দশকে বিরাট ‘উন্নয়ন’ হয়েছে। লোকের ‘পারচেজ পাওয়ার’ কোথায় উঠেছে আর ‘ডিভ্যালুয়েশন’ কোথায় গিয়ে ঠেকেছে, তা হাতে এবং কলমে বুঝতে হলে রোববার (৪ নভেম্বর) রাতে উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরের ৩৩ নম্বর বাড়িতে ঘটে যাওয়া দৃশ্যপটে চোখ রাখতে হবে। মূল গেটের পাশে নামফলকে রোমান হরফে বাড়িটির নাম লেখা— ‘আলহামদুলিল্লাহ’।
সে বাড়িতে পরিবার নিয়ে থাকেন পল্লি উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ আমজাদ হোসেন। যৌথবাহিনীর সদস্যরা সে বাসায় চার ঘণ্টা ধরে তল্লাশি চালান।
তল্লাশি করে পাওয়া যায় নগদ এক কোটি সাড়ে ৯ লাখ টাকা, মার্কিন ডলার ও ইউরোসহ কয়েক ধরনের বিদেশি মুদ্রা, ১১টি আইফোন এবং দামি ব্র্যান্ডের সাতটি ঘড়ি।
ঘটনার ভিডিওচিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভিডিওতে দেখা গেছে, জব্দ করা টাকার বান্ডিলগুলো যখন সাজিয়ে রাখা হচ্ছিল, তখন আমজাদ সাহেব বলছিলেন, ‘...আমার সারা জীবনে দশ টাকার দুর্নীতি নাই। এগুলো আমার ওয়াইফের সঞ্চয়, আমার মেয়ের সঞ্চয়।’
আমজাদ সাহেবের স্ত্রী ক্রন্দনসিক্ত কণ্ঠে বলছিলেন, ‘বাজার কইর্যা, বাজারের টাকা থিকা দশ টাকা বিশ টাকা জমায়া আমি এই টাকা বানাইছি বাবা।’
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের কর্তারা আমজাদ সাহেব ও তাঁর স্ত্রীর এই বক্তব্যকে অমূল্য সম্পদ জ্ঞানে কাজে লাগাতে পারতেন।
সঞ্চয়ী জাতি গড়ে তুলতে তাঁরা এই দুজনের সঞ্চয়ের গল্প তাদের প্রচার-প্রচারণার লিফলেট বা ক্যালেন্ডারে উদ্দীপক ভাষ্য হিসেবে ছাপতে পারতেন।
‘বাজারের টাকা থিকা দশ টাকা বিশ টাকা জমায়া কোটিপতি হওয়া নিনজা টেকনিক’ শিরোনামে মোটিভেশনাল বইও লেখা যেত।
কিন্তু গণিতের হিসাবের জন্য তা সম্ভব হচ্ছে না।
কারণ জিনিসটা পাটিগণিতে ফেলে যদি গুন-ভাগ করা হয়, তাহলে দেখা যাবে, গড়ে প্রতিদিন ৩০ টাকা করে জমালে এই পরিমাণ টাকা জমাতে হাজার বছর লাগার কথা। আমজাদ সাহেবের স্ত্রী এক হাজার বছর ধরে বাজারের টাকা থেকে দশ-বিশ টাকা সরিয়েছেন, আর সেই খুচরা-খাচরা টাকা এক হাজার টাকার নোটের বান্ডিলে কনভার্টেড হয়ে গেছে—সেটা কোনো কাজের কথা না।
তবে বিশেষ ঘটনা হলো, কোনো রকম ব্যবসাপাতি না করে কিংবা কোনো দুর্নীতিতে না জড়িয়েও যে সরকারি চাকরিজীবীরা ঘরের আলমারিতে কোটি টাকা জমিয়ে ফেলতে পারেন, তার বড় উদাহরণ আমজাদ সাহেব সৃষ্টি করেছেন।
তিনি বলেছেন, ‘আমার সারা জীবনে দশ টাকার দুর্নীতি নাই। এগুলো আমার ওয়াইফের সঞ্চয়, আমার মেয়ের সঞ্চয়।’
সমস্যা হলো, শুধু সরকারি চাকরির বেতন ভাতার টাকায় সংসার চালানোর পর ভদ্রলোকের স্ত্রী ও ছেলে–মেয়ে এত টাকা জমিয়ে ফেললেন এবং লক্ষাধিক টাকা দামের আইফোন আর দামি মডেলের ঘড়িতে ঘর ভরে ফেললেন—এই জিনিস লোকে বিশ্বাস করতে চাচ্ছে না।
আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরও বিশ্বাস হয়নি। সে কারণে তাঁরা আমজাদ সাহেব এবং তাঁর ছেলে আসিফ হাসানকে গ্রেপ্তার করেছেন।
গত ২৬ আগস্ট জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, সব সরকারি কর্মচারীকে সম্পদের বিবরণী দাখিল করতে হবে। সেপ্টেম্বর মাসে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. মোখলেস উর রহমান বলেছিলেন, বছরে একবার এই বিবরণী জমা দিতে হবে। তিনি বলেছিলেন, ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে এটি একটি বার্তা। আয়করের বিবরণী সবাই জমা দেন না। যাঁদের করযোগ্য আয় আছে, তাঁরাই কেবল দেন। আর এখন যাঁদের কোনো সম্পদ নেই, তাঁদেরও তথ্য বা বিবরণী জমা দিতে হবে। এটি জনস্বার্থে দিতে হবে।...সোজা কথা, জমা না দিলে আইনানুগ খবর আছে। যত বড় যে-ই হোক, চোরকে চোর বলতে হবে।’
এক সময় কেউ লাখ টাকার মালিক হলে সে তার বাড়িতে একটা বিশেষ বাতি জ্বালাত। সেই বাতির নাম ‘লাখের বাতি’।
সেই বাতি দেখে লোকে বুঝত তিনি লাখপতি হয়েছেন।
সেই আমলে বলা হতো, ‘হাতি মরলেও লাখ টাকা’। তখন লাখের দাম ছিল। লাখপতির দাম ছিল। এখন লাখ তো দূরের কথা কোটিরই ‘বেইল নাই’।
বিশেষ বিশেষ খাতের বহু সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে কোটি টাকা সঞ্চয় করা কোনো ঘটনা না।
চাকরি পাওয়ার আগে যে লোককে অতি দীনহীন অবস্থায় ঘুরতে দেখেছি, উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার চার বছরের মাথায় তাঁকে নামে বেনামে বাড়ি-গাড়ি কিনতে দেখেছি।
অদ্ভুত বিষয় হলো, ওই কর্মকর্তাটির পরিবারের ধারণা, আমজাদ সাহেবের মতো তিনিও ‘সারা জীবনে দশ টাকার দুর্নীতি’ করেননি।
তার মানে, তাঁদের বিশ্বাস, সরকার তাঁকে বেতন ভাতা হিসেবে কোটি কোটি টাকা দিয়ে যাচ্ছে।
‘দশ টাকার দুর্নীতি’ না করেও কোটি টাকার সম্পদ গড়ে তোলা আমজাদ সাহেবদের সংখ্যা কত তা আমাদের জানা নেই। কিন্তু জানা দরকার। সেটি সম্ভবত সরকার আমাদের জানাতে যাচ্ছে।
গত ২৬ আগস্ট জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, সব সরকারি কর্মচারীকে সম্পদের বিবরণী দাখিল করতে হবে।
সেপ্টেম্বর মাসে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. মোখলেস উর রহমান বলেছিলেন, বছরে একবার এই বিবরণী জমা দিতে হবে।
তিনি বলেছিলেন, ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে এটি একটি বার্তা। আয়করের বিবরণী সবাই জমা দেন না। যাঁদের করযোগ্য আয় আছে, তাঁরাই কেবল দেন। আর এখন যাঁদের কোনো সম্পদ নেই, তাঁদেরও তথ্য বা বিবরণী জমা দিতে হবে। এটি জনস্বার্থে দিতে হবে।...সোজা কথা, জমা না দিলে আইনানুগ খবর আছে। যত বড় যে-ই হোক, চোরকে চোর বলতে হবে।’
রক্তকরবী নাটকের রাজা তাল তাল সোনা জমাত। আমাদের সরকারি খাতের আমজাদ সাহেবরা বান্ডিল বান্ডিল টাকা জমাচ্ছেন। টাকাগুলো তাঁরা কোথায় জমাচ্ছেন, কত জমেছে, তা জানা দরকার। এ বছরই জানা দরকার।
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
sarfuddin2003@gmail.com