মতামত

সোনিয়া গান্ধীর শ্যাম ও কুল রাখার লড়াই

শ্যাম ও কুল—দুই-ই রাখা সোনিয়ার পক্ষে কঠিন। তবে রাজনীতিতে অসম্ভব কিছুই নয়
ছবি: রয়টার্স

৭ থেকে ১০ দিন ধরে যা ঘটে গেল, তা দেখেশুনে বলা যায়, কংগ্রেস আছে কংগ্রেসেই।কংগ্রেস সভাপতি পদে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অপ্রত্যাশিত যে জট পাকিয়েছিল, বিস্তর টালবাহানার পর তা খুলেছে। রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলট রণে ভঙ্গ দিয়েছেন। অঘোষিত ‘সরকারি প্রার্থী’ হয়েছেন মল্লিকার্জুন খাড়গে। কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব আপাতত কয়েকটা দিন হাঁপ ছাড়ার সময় পেল।

পরিবারপন্থী অতি অনুগত কেউ কেউ বলতে শুরু করেছেন, মল্লিকার্জুন খাড়গে নাকি গান্ধীদের ‘তুরুপের তাস’। কিন্তু ঘটনা হলো তুরুপের তাস নন, কর্ণাটকের এই অশীতিপর নির্বিবাদী রাজনীতিক গান্ধী পরিবারের ‘মুশকিল আসান’ হয়েছেন। শেষ বিচারে এতে দলের লাভের লাভ কতটা হবে, তা অবশ্য ভিন্ন প্রশ্ন। সে প্রশ্ন ভবিষ্যতের বিবেচনা। আপাতত অনস্বীকার্য, সোনিয়া গান্ধী একটা বড় ঝটকা সামলালেন।

সভাপতি পদে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তিনি এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চেয়েছিলেন। পছন্দের ও বিশ্বস্ত অশোক গেহলটকে ওই পদে বসিয়ে রাজস্থানের পটপরিবর্তন করে দেবেন ভেবেছিলেন।

এমন নয় যে তিনি ও তাঁর পুত্র-কন্যা গেহলটকে নিয়ে বীতশ্রদ্ধ কিংবা গেহলট মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে অপদার্থতার প্রমাণ রাখছিলেন। তাঁকে রাজ্য থেকে বের করে দলের সভাপতির গুরুদায়িত্ব অর্পণের পেছনে সোনিয়ার তাগিদ ছিল দুটি।

এক. বিশ্বস্ত ও অনুগতকে দলের দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকা। দুই. নবীন প্রজন্মের হাতে নির্বিঘ্নে রাজ্যের ক্ষমতা হস্তান্তর। ২০১৪ থেকে টানা ছয় বছর প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি পদে থাকা শচীন পাইলটকে সেই প্রতিশ্রুতির কথা সোনিয়া, রাহুল ও প্রিয়াঙ্কা বারবার শুনিয়ে এসেছেন।

কিন্তু পালন করতে পারেননি গেহলট ভেটো দেওয়ায়। ২০২০ সালে অসহিষ্ণু পাইলট বেঁকে বসে চাপ সৃষ্টি করাতে গান্ধী পরিবারও চঞ্চল হয়েছিল। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তাঁকে শান্ত করতে হয়েছিল। সেই থেকে টানা দুই বছর উপমুখ্যমন্ত্রিত্ব ও সভাপতিত্ব খুইয়ে স্রেফ বিধায়ক থেকে অপেক্ষায় রয়েছেন পাইলট। সোনিয়ার ছক অশোক গেহলট শেষ মুহূর্তে বানচাল করায় এখনই কেউ নিশ্চিত নন, রাজস্থানের জট কীভাবে ছাড়ানো যাবে।

সেই প্রশ্ন ঝুলিয়ে রেখে আপাতত সোনিয়া শিরেসংক্রান্তির মোকাবিলা করলেন। প্রচুর জল ঘোলার পর বেছে নিলেন মল্লিকার্জুন খাড়গেকে। তাঁর চ্যালেঞ্জার শশী থারুর নিশ্চয় উপলব্ধি করছেন, লড়াইটা হবে সেই আড়াই দশক আগের মতো। ১৯৯৭ সালে কোনো রাজ্যে প্রচারে না গিয়ে সেবার স্রেফ ঘরে বসে হেলায় সভাপতি নির্বাচনে জিতেছিলেন সীতারাম কেশরী।

‘দলিত’ দ্রৌপদী মুর্মুকে রাষ্ট্রপতি করে বিজেপি যে প্রচার চালিয়েছে, তার বিপ্রতীপে ‘দলিত’ খাড়গে কংগ্রেসের উত্তর। কর্ণাটকের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী বাসবরাজ বোম্মাই নানা চাপে নাজেহাল। বিজেপির হাল ওই রাজ্যে বেশ নড়বড়ে। তা থেকে নিষ্ক্রমণের জন্যই হিজাব–বিতর্কের জন্ম। খাড়গের উত্তরণ ওই রাজ্যে কংগ্রেসের বাড়তি প্রেরণা হতে পারে। আসছে বছর ওই রাজ্যে বিধানসভার ভোট।

এআইসিসির ৯ হাজার প্রতিনিধির মধ্যে পেয়েছিলেন ৬ হাজার ২২৪ ভোট। তাঁর প্রতিপক্ষ ছিলেন শারদ পাওয়ার ও রাজেশ পাইলট। পাওয়ার পেয়েছিলেন ৮৮২ ভোট, পাইলট ৩৫৪। শশী তবু চেষ্টার ত্রুটি রাখছেন না। বলছেন, গতানুগতিকতা ও ধারাবাহিকতার পরিবর্তন দরকার। দলকে একবিংশ শতাব্দীর উপযুক্ত করে গড়ে না তুললে বিনাশ অনিবার্য।

গেহলটকে চূড়ান্ত করার আগে সোনিয়া তাঁকে তাঁর সব তাস দেখিয়েছিলেন কি? প্রশ্নটা উঠছে কারণ, শচীন পাইলটের সঙ্গে গেহলটের সম্পর্ক যে আদায়-কাঁচকলায়, তা সবার জানা। ওই সম্পর্কের জন্যই দুই বছর ধরে শচীন একজন বিধায়ক ছাড়া আর কিছু নন। অথচ গত বিধানসভার ভোটের পর তিনি ছিলেন একাধারে উপমুখ্যমন্ত্রী ও প্রদেশ সভাপতি! গান্ধীরা চাইলেও শচীন ও তাঁর অনুগামীদের একজনকেও মন্ত্রিসভায় ঠাঁই দেননি গেহলট।

সেই শচীনকে বিনা প্রশ্নে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে গেহলট মেনে নেবেন, এটা যদি সোনিয়া ধরে থাকেন, তাহলে তা ছিল তাঁর বিরাট রাজনৈতিক ভুল। উল্টো দিকে, সব জানানো সত্ত্বেও গেহলট যদি শেষ বেলায় কথার খেলাপ করে পাশার দান উল্টে দিয়ে থাকেন, তাহলে বুঝতে হবে দলে গান্ধী পরিবারের রাশ আলগা হয়ে গেছে। ঠিক এই জায়গাটাই ধরতে চাইছেন শশী থারুর। তাঁর সুবিধা, সোনিয়া নিজেই তাঁকে বলেছেন, আনুষ্ঠানিকভাবে কংগ্রেসের পদাধিকারীরাও, দলের ‘সরকারি প্রার্থী’ কেউ নন। গান্ধী পরিবার এই লড়াইয়ে ‘নিরপেক্ষ’।

গেহলটের গুণাবলি খাড়গের মধ্যেও রয়েছে। বয়স তাঁর ৮০। তিন–তিনবার কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী হতে পারতেন। কিন্তু সে জন্য হাইকমান্ডের ওপর কখনো চাপ সৃষ্টি করেননি। কখনো বিতর্কিত কোনো মন্তব্য করে দলকে ফ্যাসাদে ফেলেননি। দুর্নীতির তেমন কোনো অভিযোগও তাঁর বিরুদ্ধে নেই। সবাইকে মানিয়ে-গুনিয়ে চলার একটা সহজাত ক্ষমতা খাড়গের আছে। তা ছাড়া সামাজিক দিক থেকেও তাঁকে পছন্দ করার কারণ রয়েছে।

‘দলিত’ দ্রৌপদী মুর্মুকে রাষ্ট্রপতি করে বিজেপি যে প্রচার চালিয়েছে, তার বিপ্রতীপে ‘দলিত’ খাড়গে কংগ্রেসের উত্তর। কর্ণাটকের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী বাসবরাজ বোম্মাই নানা চাপে নাজেহাল। বিজেপির হাল ওই রাজ্যে বেশ নড়বড়ে। তা থেকে নিষ্ক্রমণের জন্যই হিজাব–বিতর্কের জন্ম। খাড়গের উত্তরণ ওই রাজ্যে কংগ্রেসের বাড়তি প্রেরণা হতে পারে। আসছে বছর ওই রাজ্যে বিধানসভার ভোট।

২০১৯ সালে লোকসভা ভোটে কর্ণাটকের ২৮টি আসনের মধ্যে বিজেপি পেয়েছিল ২৫, কংগ্রেস ১, জেডিএস ১, একজন স্বতন্ত্র। এখন রাজ্য রাজনীতির যা হাল, তাতে ২০২৪ সালে ২০১৯–এর পুনরাবৃত্তি হবে কি না, বিজেপি নিজেই নিশ্চিত নয়। কংগ্রেসেরও যতটুকু সম্ভাবনা এখনো অবশিষ্ট, বেশিটাই দাক্ষিণাত্যে। খাড়গে তাই ভালো পছন্দ। রাহুল গান্ধীর ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ শুরুও দাক্ষিণাত্য থেকে। কেরালায় কাটিয়েছেন ১৮ দিন। কর্ণাটক ও রাজস্থানে থাকবেন ২১ দিন করে।

কংগ্রেসের একাংশের (জি-২৩ গোষ্ঠী) দাবি ছিল, দলে একজন সর্বসময়ের নির্বাচিত সভাপতি চাই। অতঃপর তা পূর্ণ হতে চলেছে। তবে ৮০ বছর বয়সী কোনো ব্যক্তি সভাপতি হিসেবে কতটা পরিশ্রমী ও কর্মঠ হবেন, সেই প্রশ্ন থাকছেই। সেই বিচারে ৬৬ বছরের শশী থারুর যোগ্যতর।

তবে তাঁর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা কম। অন্ধ অনুগত না হওয়ায় তাঁর প্রতি গান্ধীদের আস্থা ও ভরসাও কম। এই ভোটের একমাত্র আকর্ষণ এখন একটাই। শশী কত ভোট টানেন। কেশরীর বিরুদ্ধে পাওয়ার ও পাইলট সম্মিলিতভাবে যত ভোট পেয়েছিলেন, তার বেশি না কম।

দ্বিতীয় আগ্রহটি অবশ্যই রাজস্থানকেন্দ্রিক। সভাপতি নির্বাচনের জট কোনোরকমে কাটিয়ে উঠেছেন সোনিয়া। কিন্তু রাজস্থানের জট কাটাবেন কী করে? এটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে কংগ্রেস রাজনীতির পরবর্তী আকর্ষণ। বছর ঘুরলে রাজস্থানে ভোট। রাজস্থান ও ছত্তিশগড়—এই দুই রাজ্য এখন হারাধনরূপী কংগ্রেসের শেষ দুই ছেলে। রাজস্থানে অশোক গেহলটকে ভোট পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী রেখে দিলে শচীন পাইলটের কাছে গান্ধীদের মুখ থাকে না।

সে ক্ষেত্রে বিশ্বাস হারানো পাইলট দলত্যাগী হলে গান্ধীরাই দোষের ভাগী হবেন। আবার গেহলটকে পদত্যাগে বাধ্য করলে রাজস্থানের দশাও হবে পাঞ্জাবের মতো। অশোক গেহলট আর যা–ই হোন, গুলাম নবি আজাদ বা শেষ বয়সের অমরিন্দর সিং নন। নিজের জোরে ভোটে জেতার ক্ষমতা তাঁর আছে; অনুগামীদের জেতানোরও।

শ্যাম ও কুল—দুই-ই রাখা সোনিয়ার পক্ষে কঠিন। তবে রাজনীতিতে অসম্ভব কিছুই নয়। রাজস্থানের জট তিনি কীভাবে ছাড়াবেন, সেই কাজে সফল হবেন না ব্যর্থ, কংগ্রেস রাজনীতির নজর এখন সেদিকেই। সভাপতি পদে নির্বাচন সেই আখ্যানের গৌরচন্দ্রিকা।

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি