বাংলাদেশের পাঁচ সদস্যের ১৩তম নির্বাচন কমিশন ৫ সেপ্টেম্বর হঠাৎ সংবাদ সম্মেলন করে একযোগে পদত্যাগ করেছে। ঘটনাটি ঘটল এই কমিশনের মেয়াদের দুই বছরের মাথায়। কমিশনের নেতৃত্বে ছিলেন কাজী হাবিবুল আউয়াল। এমন ঘটনা অবশ্য নতুন নয়। এর আগে ২০০৭ সালে ১ বছর ৭ দিনের মাথায় জাতীয় সংসদ নির্বাচন না করিয়েই চাপে পড়ে বিচারপতি আজিজ কমিশন পদত্যাগ করেছিল। বাংলাদেশের প্রায় সব নির্বাচন কমিশন নিয়েই অল্পবিস্তর বিতর্ক আছে। দু–একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে নির্ধারিত সময়ের আগেই পদত্যাগও করতে হয়েছে।
বাংলাদেশে বেশির ভাগ নির্বাচন কমিশন এবং এর কর্মকাণ্ড নিয়ে বিতর্কের প্রধান কারণ নির্বাচন কমিশনের গঠনপ্রক্রিয়া। পতিত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা সরকারের আমলে কার্যত হাতে গোনা ও পছন্দসই ব্যক্তিদেরই নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। প্রথমে একটি লোকদেখানো সিলেকশন কমিটির মাধ্যমে নিয়োগ দিলেও ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন যেভাবে হয়েছে, সে বিষয়ে নতুন করে বলার তেমন কিছু নেই।
২০১৮ সালের নির্বাচনকে রাতের ভোট আর ২০১৪ সালের নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচন হিসেবে নাম দেওয়া যায়। ২০২৪ সালের নির্বাচন যে কমিশনের অধীন হয়েছিল, সেই কমিশন গঠিত হয়েছিল একটি কথিত অ্যাক্ট ২০২২–এর মাধ্যমে। সেখানেও ছিল বেজায় ফাঁক। কমিশনে যাঁদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, তাঁদের নিয়ে প্রথম থেকেই বিতর্ক শুরু হয়। তাঁদের মাধ্যমেই শেখ হাসিনা সরকার চূড়ান্তভাবে স্বৈরশাসকের রূপ ধারণ করে। এ ধরনের ত্রুটিযুক্ত নির্বাচনের মাধ্যমে ‘নির্বাচিত স্বৈরশাসক’ই তৈরি হয়।
আমার এই লেখার উদ্দেশ্য নির্বাচন কমিশন গঠনপ্রক্রিয়া এবং এর জন্য সম্ভাব্য আইন নিয়ে ধারণা দেওয়া। নির্বাচন ও নির্বাচন কমিশনে আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আর এ বিষয় নিয়ে আমার পড়াশোনার আলোকে এই আলোচনা করব। নির্বাচন কমিশন গঠন এবং কমিশনার ও প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের পদ্ধতি হওয়া উচিত স্বচ্ছ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। উপমহাদেশের প্রায় সব দেশেই মোটামুটি স্বচ্ছ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়।
ভারত একটি ফেডারেল কাঠামোর রাষ্ট্র। রাজনীতির পক্ষপাতমুক্ত আমলা ও অপেক্ষাকৃত সচেতন ভোটার এবং বহুদলীয় গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতার কারণে নির্বাচন নিয়ে সেখানে বড় ধরনের প্রশ্ন ওঠে না। তবে এবারের কমিশনের কার্যকলাপ নিয়ে সেখানকার নাগরিক সমাজ প্রশ্ন তুলছেন। ভারতে নির্বাচন কমিশন বাছাইয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয় যে তিন সদস্যের পর্ষদ, সেখানে সরকার থেকে দুজন ও বিরোধী দল থেকে থাকেন একজন। কাজেই সরকারের প্রাধান্যই থেকে যায়।
বাংলাদেশে চাপে পড়ে হাসিনা সরকার লোকদেখানো সার্চ কমিটি তৈরি করেছিল। প্রথমে প্রজ্ঞাপন দিয়ে রকিব ও নূরুল হুদা কমিশন তৈরি হয়েছিল, যাদের ওপরে প্রথম থেকেই জনগণের আস্থা ছিল না। নূরুল হুদা কমিশন ‘দিনের ভোট রাতে’ করিয়ে কুখ্যাত হয়েছে। পরে ২০২২ সালে অ্যাক্ট দ্বারা তৈরি হলো সিলেক্ট কমিটি। এই অ্যাক্টের শিরোনাম ‘চিফ ইলেকশন কমিশনার অ্যান্ড আদার ইলেকশন কমিশনারস অ্যাপয়েন্টমেন্ট অ্যাক্ট ২০২২’। কমিশনের অধীন এ বছরের ৭ জানুয়ারি জাতীয় সংসদের যে নির্বাচন হয়েছে, তা ছিল অভিনব; যার নাম দেওয়া যায় ‘আমরা আমরা’ নির্বাচন। সেখানে বিরোধী দল বলতে কিছু ছিল না।
স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত ১৩টি নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে। এর মধ্যে চারটি নির্বাচন কমিশন ছিল গ্রহণযোগ্য। তারা একটি বিতর্কিত উপনির্বাচন ছাড়া অন্যান্য নির্বাচন যথেষ্ট গ্রহণযোগ্যভাবে সম্পন্ন করেছিল। বাকি নির্বাচন কমিশনগুলোর কার্যকলাপ জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারেনি। কারণ, নির্বাচন কমিশনের গঠনপ্রক্রিয়া স্বচ্ছ ছিল না। উল্লেখ্য, আমাদের সংবিধানের ১১৮ নম্বর অনুচ্ছেদে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠনের কথা বলা হয়েছে। কাজেই এই কমিশনের সদস্যদের হতে হবে নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ; কোনো দলের বা অংশের অনুগত নয়।
বর্তমান পরিস্থিতি জনবান্ধব ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য উপযুক্ত। গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠন করার পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণয়ন করার এখনই সময়। আমার মতে, আমাদের দেশে এত বড় কমিশনের প্রয়োজন নেই। আগের মতো তিন সদস্যের কমিশনই যথেষ্ট। এই সদস্যদের প্রশাসনিক, আইনি ও নিরাপত্তার বিষয়ে অভিজ্ঞ হতে হবে। অন্যথায় চলমান পাঁচ সদস্যের কমিশন বহাল থাকতে পারে।
কমিশনারদের যোগ্যতা হিসেবে সংবিধানের ধারা ৬৬–তে বর্ণিত গুণাবলি থাকতে হবে। সঙ্গে কয়েকটি অতিরিক্ত গুণ সংযোজন করা যায়— ক. বয়স ন্যূনতম ৪৫ বছরের ঊর্ধ্বে হতে হবে; খ. কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বা রয়েছেন, এমন ব্যক্তি এই পদের জন্য যোগ্য হবেন না; গ. শিক্ষাগত যোগ্যতা: যেকোনো স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ন্যূনতম স্নাতকোত্তর হতে হবে; ঘ. ঋণখেলাপি হবেন না এবং ঙ. স্বাধীনতাবিরোধী হওয়ার কারণে কোনো প্রকার দণ্ডপ্রাপ্ত হবেন না।
নতুন আইনে চূড়ান্ত বাছাই ও নিয়োগ রাষ্ট্রপতি দ্বারাই হতে হবে। তবে চূড়ান্ত বাছাই তিন অথবা দুই স্তরে হতে পারে। তিন স্তরে হলে প্রথম স্তরে প্রাপ্ত নামগুলো গ্রহণ ও যোগ্যতা বাছাই করতে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটি থাকতে পারে। বাকি দুজনের মধ্যে একজন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও অন্যজন কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর কর্তৃক নির্ধারিত জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক।
এ কমিটি প্রস্তাবিত ব্যক্তিদের যোগ্যতা নিরূপণের পর পাঁচ সদস্যের বাছাই কমিটিতে প্রেরণ করবে। বাছাই কমিটির প্রধান হবেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন বয়োজ্যেষ্ঠ বিচারপতি। অপর চারজন সদস্য হবেন সাংবিধানিক পদধারী—সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (না থাকলে সাবেক প্রধান অথবা একজন কমিশনার), পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান, দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রধান, অডিটর জেনারেল ও প্রধান আইন কর্মকর্তা বা অ্যাটর্নি জেনারেল।
এই কমিটি প্রতিটি পদের জন্য ন্যূনতম তিনজনের নাম বাছাই করবে এবং পরবর্তী তৃতীয় স্তরে প্রেরণ করবে। তৃতীয় স্তর হবে সংসদের বিজনেস কমিটি অথবা স্পেশাল কমিটি। এই কমিটির প্রধান থাকবেন প্রধানমন্ত্রী, থাকবেন সংসদের বিরোধী দলের নেতা এবং উভয় পক্ষের সমসংখ্যক সদস্য। এই কমিটি চূড়ান্তভাবে প্রতিটি পদের জন্য (প্রধান ও কমিশনার) দুটি করে নাম চূড়ান্ত করে রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের জন্য পাঠাবে। রাষ্ট্রপতি সংসদীয় বিশেষ কমিটি বা বিজনেস কমিটির চূড়ান্ত সুপারিশ থেকে একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অনুমোদিতসংখ্যক কমিশনার নিয়োগ দেবেন। বর্তমানে দেশে কোনো সংসদ কার্যকর নেই। সে ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন নিয়োগ দেওয়ার প্রয়োজন হলে উপদেষ্টা পরিষদ কর্তৃক সুপারিশকৃত নামগুলো থেকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দিতে পারেন।
এই প্রস্তাবিত তিন স্তর বিবেচ্য না হলে প্রথম স্তর বাদ দিয়ে দুই স্তরে প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করা যেতে পারে। তবে সংসদীয় কমিটির চূড়ান্ত নাম জনসমক্ষে প্রকাশ করা ভালো হবে। তিন অথবা দুই স্তরে নির্বাচন কমিশন নির্বাচন ও চূড়ান্ত নিয়োগ সর্বজনগ্রাহ্য হতে পারে। এ প্রক্রিয়ায় সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দলগুলোর সম্পৃক্ততা থাকবে বলে নির্বাচিত কমিশন অধিকতর গ্রহণযোগ্য হবে।
ড. এম সাখাওয়াত হোসেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বস্ত্র, পাট ও নৌপরিবহন উপদেষ্টা এবং সাবেক নির্বাচন কমিশনার
hhintlbd@yahoo.com