সংসদীয় রাজনীতিতে জাতীয় সংসদই রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র হওয়ার কথা। কিন্তু বাংলাদেশে গত ৫১ বছরে সে রকম কোনো আলামত দেখা যায়নি। বরং ক্ষমতাসীন দল সংসদকে যেমন নিজেদের হাতের মুঠোয় রাখতে চেষ্টা করেছে, সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে হক না হক আইন করেছে। আবার বিরোধী দল সংসদে ভূমিকা না রেখে মেয়াদের মাঝামাঝি এসে বর্জনের পথ হিসেবে বেছে নিয়েছে। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে খুব একটা ফারাক আছে বলে মনে হয় না। যখন যে দল বিরোধী দলে থাকেন, সরকারের দমনপীড়নের উচিত জবাব হলো রাজপথে ফয়সালা।
নিরুত্তাপ একাদশ জাতীয় সংসদের শেষ বেলায় এসে কিছুটা উত্তাপ ছড়াল। বিএনপি রাজপথে প্রধান বিরোধী দল হলেও জাতীয় সংসদে তাদের সদস্যসংখ্যা মাত্র সাতজন। তবে এই সাতজনের আওয়াজ কখনো কখনো আওয়ামী লীগের আড়াই শ জনের আওয়াজকে ছাপিয়ে যেতে দেখা গেছে। রুমিন ফারহানা ও হারুনুর রশীদের শক্ত যুক্তির কাছে আওয়ামী লীগের বাঘা বাঘা নেতা্রা লা জবাব। হ্যাঁ, তারা জবাব দেন ১৬ বছর ৩২ বছর আগের ঘটনা টেনে। কিন্তু মানুষ তো এখন দমবন্ধ পরিবেশে আছে।
দলীয় সরকারের অধীনে বিএনপির নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা সম্পর্কে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, নির্বাচনের এক বছর বাকি। এই এক বছরে অনেক কিছু ঘটবে। পদ্মা-মেঘনা-যমুনায় অনেক পানি গড়াবে। কিন্তু এক বছর পর সবকিছু যে সরকারের অভিপ্রায় অনুযায়ী চলবে, তার নিশ্চয়তা আছে কি? ২০১৪ ও ২০১৮-এর কৌশল ২০২৩ সালে কাজে নাও লাগতে পারে।
একদা আওয়ামী লীগের বি টিম বলে পরিচিত বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও আওয়াজ তুলতে শুরু করেছে। এই প্রেক্ষাপটে গত শনিবার রংপুরের জনসভায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঘোষণা দিয়েছেন, দল যখনই বলবে, তখনই বিএনপির সংসদ সদস্যরা পদত্যাগ করবেন। এর জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপির মাত্র সাতজন সদস্য পদত্যাগ করলে সংসদ অচল হয়ে যাবে না। তাঁর কথা অযৌক্তিক নয়। সাড়ে তিন শ আসনের জাতীয় সংসদ থেকে সাতজন সদস্য চলে গেলে সংসদের ইতরবিশেষ ঘটবে না। কিন্তু নৈতিকভাবে ক্ষমতাসীনদের পরাজয় ঘটবে।
এরই মধ্যে সংসদে জাতীয় পার্টির নাটকও দেশবাসী প্রত্যক্ষ করছে। একদিন আগে তারা জানালেন, দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদেরকে সংসদে বিরোধী দলের নেতার আসনে স্বীকৃতি না দেওয়া পর্যন্ত সংসদে যাবেন না। ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে সেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে বললেন, স্পিকারের আশ্বাসে জাতিায় পার্টির সংসদ সদস্যরা অধিবেশনে যাবেন। বর্তমানে সংসদে বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। আবার তাঁকে কেন্দ্র করে জাতীয় পার্টিতে ভাঙন ধরানোর চেষ্টা চলছে। গত ৩ সেপ্টেম্বর জাতীয় পার্টির সংসদীয় দল বৈঠক করে জি এম কাদেরকে সংসদে বিরোধী দলের নেতা নির্বাচন করে এবং বিষয়টি চিঠি দিয়ে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীকেও জানিয়ে দেওয়া হয়। এর মধ্যে প্রায় দুই মাস পার হলেও তিনি কোনো সিদ্ধান্ত দেননি।
প্রথম আলোর অন লাইন খবরে বলা হয়: সংসদে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে এক দিনের ব্যবধানে সরে এল জাতীয় পার্টি। দলটি গতকাল রোববার জানিয়েছিল, রওশন এরশাদের পরিবর্তে জি এম কাদেরকে সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা করতে স্পিকারের সিদ্ধান্ত চায়। এ দাবি না মানা পর্যন্ত আর সংসদে যাবে না। আজ সোমবার আবার সেই সিদ্ধান্ত পাল্টেছে দলটি। এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে দলটি জানিয়েছে, স্পিকারের আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যরা সংসদ অধিবেশনে যোগ দেবেন। জাতীয় পার্টির এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘জাতীয় সংসদের মাননীয় স্পিকারের আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় সংসদের অধিবেশনে যোগ দেবেন জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যরা। জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ (জি এম) কাদের আজ (সোমবার) এক নির্দেশনায় জাতীয় পার্টির সকল সংসদ সদস্যকে অধিবেশনে যোগ দিতে নির্দেশ দিয়েছেন।’
জাতীয় পার্টিতে সংসদে বিরোধী দলের নেতা নির্বাচনই একমাত্র সমস্যা নয়। বিরোধী দলের চিফ হুইপ ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক মসিউর রহমানকে দল থেকে প্রথমে অব্যাহতি এবং পরে বহিষ্কার করা হয়। দলের টিকিটে জয়ী কোনো সংসদ সদস্য দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গেলে কিংবা দল থেকে বহিষ্কার হলে তার সদস্য পদ বাতিল হয়ে যায়। রওশন এরশাদ যে আগামী ২৬ নভেম্বর দলের কাউন্সিল ডেকেছিলেন, তার পেছনে মসিউর রহমান ও এরশাদের ছেলে শাদ এরশাদের সক্রিয় ভূমিকা আছে। সর্বশেষ খবরে দেখলাম, রওশনপন্থীরা কাউন্সিল স্থগিত করেছেন। এটি কি তাঁরা ভয় পেয়ে করলেন, না সংসদে বিরোধী দলের নেতার পদ রক্ষার জন্য—বিষয়টি এখনো স্পষ্ট নয়। আবার রওশনপন্থীদের তৎপরতা ও নির্বাচন কমিশনে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টির (বিডিপি) নিবন্ধনের জন্য আবেদন করা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে নানা গুঞ্জন আছে। বিডিপির সব নেতা-কর্মীই নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন বাতিল হওয়া জামায়াতে ইসলামীর।
১৯৮৮ সালে চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ অধিকাংশ দল বর্জন করলে এরশাদ নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক দেখাতে আ স ম আবদুল রবের নেতৃত্বে ৭৩টি দলকে বিরোধী জোট করেন। আসম রব হন সংসদে বিরোধী দলেন নেতা।
আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে সাত সংখ্যাটির একটি ভিন্ন তাৎপর্য আছে। প্রথম জাতীয় সংসদেও বিরোধী দল ও স্বতন্ত্র মিলে সাতজন সদস্য ছিলেন। বাকি সবাই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের। কিন্তু ওই সংসদ মেয়াদ পূরণ করতে পারেনি। সংসদীয় ব্যবস্থা বাতিল করে রাষ্ট্রপতি শাসিত একদলীয় সরকার কায়েম করা হয়। বর্তমান সংসদ থেকে যদি বিএনপির সাতজন সদস্য পদত্যাগ করেন এবং জাতীয় পার্টির সদস্যরা যদি ভবিষ্যতে ফের কোনো কারণে সংসদে গরহাজির থাকেন, তাহলে জাতীয় সংসদ ১৪ দলীয় জোটের সংসদই হবে। এ রকম একতরফা সংসদ বিরোধী দলকে যতটা ক্ষতিগ্রস্ত করবে, তার চেয়ে বেশি করবে ক্ষমতাসীনদের।
বিএনপির সাতজন সদস্য চলে গেলে সংসদ অচল হবে না ঠিকই, কিন্তু সরকারি দলের অস্বস্তি বাড়বে। ওবায়দুল কাদেরের নিশ্চয়ই মনে আছে, ১৯৯৪ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে (যার অংশীদার ছিল জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী, কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ ইত্যাদি) যখন ১৪৭ জন সংসদ সদস্য পদত্যাগ করলেন, তখন বিএনপির নেতারাও বলেছিলেন, এরা পদত্যাগ করলে সংসদ অচল হবে না। প্রয়োজনে উপনির্বাচন হবে। তাই সংসদ কতজনকে নিয়ে কত দিনের জন্য চলল, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো সেই সংসদ জনগণের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করতে পারছে কি না?
দলীয় সরকারের অধীনে বিএনপির নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা সম্পর্কে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, নির্বাচনের এক বছর বাকি। এই এক বছরে অনেক কিছু ঘটবে। পদ্মা-মেঘনা-যমুনায় অনেক পানি গড়াবে। কিন্তু এক বছর পর সবকিছু যে সরকারের অভিপ্রায় অনুযায়ী চলবে, তার নিশ্চয়তা আছে কি? ২০১৪ ও ২০১৮-এর কৌশল ২০২৩ সালে কাজে নাও লাগতে পারে।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি