মতামত

ভোটারদের অনীহা রোগ নয়, উপসর্গ

চার ধাপে অনুষ্ঠেয় ষষ্ঠ উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ধাপের নির্বাচন ৮ মে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীরের মতে, এ ধাপের নির্বাচনে ১৩৯টি উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে ভোট পড়ার হার ছিল ৩৬ দশমিক ১ শতাংশ।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অধীন অনুষ্ঠিত চারটি উপজেলা নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির হার ছিল যথাক্রমে ২০০৯ সালে ৬৮ দশমিক ৩২ শতাংশ, ২০১৪ সালে ৬১ শতাংশ এবং ২০১৯ সালে ৪০ দশমিক ২২ শতাংশ। অর্থাৎ গত চারটি উপজেলা নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির হার ক্রমান্বয়ে কমেছে এবং এবারের প্রথম ধাপের নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির হার ছিল সর্বনিম্ন।

উপজেলা নির্বাচনে এভাবে ক্রমান্বয়ে ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার কারণ কী? এ থেকে উত্তরণই–বা কোন পথে?

সাম্প্রতিক কালে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সঙ্গে জড়িত স্বেচ্ছাব্রতীদের আঞ্চলিক সভায় যোগদানকালে সারা দেশের এ পর্যন্ত হাজারখানেক সচেতন নাগরিকের সঙ্গে মতবিনিময় করার আমার সুযোগ হয়। এসব মতবিনিময় থেকে আমার কাছে যেটি সুস্পষ্ট হয়েছে যে উপজেলা নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার মূল কারণ হলো আস্থাহীনতা। ভোটারদের নির্বাচনব্যবস্থা, নির্বাচন কমিশন, নির্বাচনব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত সব প্রতিষ্ঠান, বিশেষত প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর আস্থাহীনতা।

অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে অনেক নাগরিকের মনেই এ সন্দেহ জন্মেছে যে তাঁরা ভোটকেন্দ্রে যেতে চাইলেও তা পারবেন কি না, ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হলেও ভোট দিতে পারবেন কি না এবং ভোট দিতে পারলেও তা সঠিকভাবে গণনা করা হবে কি না। অন্যভাবে বলতে গেলে, তাঁদের ভোট দেওয়া না–দেওয়ার ওপর জয়-পরাজয় নির্ভর করবে না, ক্ষমতাসীনেরা যাঁদের চান, তাঁরাই নির্বাচনে জিতবেন।

নাগরিকদের মনে এমন সন্দেহ সৃষ্টি হওয়ার যথেষ্ট কারণও রয়েছে। অনেকেই ঢাকার দুটি, বরিশালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনসহ অতীতের অনেকগুলো স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র দখল, জাল ভোট প্রদানসহ অন্যান্য কারচুপির কথা ভুলে যাননি। আরও ভুলে যাননি ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মধ্যরাতের ভুতুড়ে ভোটের কথা।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে শতাধিক গায়েবি মামলা দিয়ে তাঁদের জেলে অন্তরিণ বা ঘরছাড়া করার এবং অনেক ক্ষেত্রে সাজানো মামলায় তড়িঘড়ি করে নির্বাচনের আগে তাঁদের দেড় হাজারের মতো সহযোগীকে সাজা প্রদান করে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অযোগ্য করার স্মৃতি অনেক নাগরিকের স্মৃতিতে এখনো অম্লান।

আউয়াল কমিশনের সদস্যদের এমন বক্তব্য ও নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সদস্যদের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ নাগরিকদের নির্বাচনব্যবস্থার ওপর আস্থাহীন না করে পারে না। আর এমন আস্থাহীনতার কারণেই বিএনপিসহ প্রধান বিরোধী দলগুলো নির্বাচন বর্জন করেছে। বিরোধী দলের নির্বাচন বর্জনও প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচনে অসন্তোষজনক ভোটার উপস্থিতির আরেকটি কারণ।

নির্বাচন কমিশনের কথাতেই আসা যাক। বর্তমান আউয়াল কমিশনের নিয়োগের নৈতিকতা, এমনকি আইনগত বৈধতা নিয়েই জনমনে গুরুতর প্রশ্ন রয়েছে।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২২-এর অধীন নির্বাচন কমিশনে নিয়োগের জন্য শুধু রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবী সংগঠনের নাম প্রস্তাব করার বিধান থাকলেও কমিশনে নিয়োগের জন্য গঠিত অনুসন্ধান কমিটি আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে যেকোনো নাগরিককে যেকোনো নাম, এমনকি নিজের নাম প্রস্তাব করার সুযোগ করে দেয়। ফলে আইনগতভাবে অযোগ্য ব্যক্তিদের প্রস্তাবের ভিত্তিতে বর্তমান আউয়াল কমিশন গঠিত হয়।

এমনকি প্রধান নির্বাচন কমিশনার হাবিবুল আউয়ালের নামও প্রয়াত ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী প্রস্তাব করেছিলেন। জাফর ভাই একজন অতি শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি হলেও তিনি নির্বাচন কমিশনে নিয়োগের জন্য নাম প্রস্তাব করার জন্য আইনগতভাবে যোগ্য ছিলেন না।

এ ছাড়া সাবেক নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসাইন, যিনি ২০১৮ সালে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রার্থী ছিলেন, তিনি অনুসন্ধান কমিটির একজন সদস্য ছিলেন। তাই যে নির্বাচন কমিশনের নিয়োগের নৈতিকতা ও আইনসিদ্ধতা প্রশ্নবিদ্ধ, তাদের সব কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য। তাই বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ওপর নাগরিকদের আস্থার ঘাটতি থাকাই স্বাভাবিক।

আরেকটি কথাও ভুললে চলবে না যে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নূরুল হুদা কমিশনের মদদে একশ্রেণির প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য অন্তত লোকচক্ষুর অন্তরালে রাতের আঁধারে ভোট জালিয়াতি করেছিলেন। কিন্তু আউয়াল কমিশনের সামনে ক্ষমতাসীনেরা বিরোধী দলকে গায়েবি মামলা দিয়ে এবং বিতর্কিত বিচারের মাধ্যমে সাজা দিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা থেকে দিনদুপুরে বিরত রাখল এবং নির্বাচনে সমতল ক্ষেত্র নিশ্চিত করার দায়িত্বে নিয়োজিত সাংবিধানিকভাবে স্বাধীন প্রতিষ্ঠানটির কোনো সদস্যই টুঁ শব্দটিও করলেন না! বরং একটি একতরফা নির্বাচনের আয়োজন করলেন, যেখানে ভোটারদের সামনে ভিন্ন মত-পথ-কর্মসূচি নিয়ে কোনো বিকল্প প্রার্থী ছিল না।

ভোটাররাও প্রভাবমুক্তভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারলেন না। ফলে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কোনোভাবেই একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচন বলা যায় না।

প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠানের সাংবিধানিক ম্যান্ডেট পূরণে ব্যর্থতা সত্ত্বেও আউয়াল কমিশন ‘বিগত নির্বাচন অভূতপূর্ব সুষ্ঠু’ হওয়ার দাবি করছে (‘বিগত নির্বাচন অভূতপূর্ব সুষ্ঠু হয়েছে: ইসি রাশেদা সুলতানা,’ প্রথম আলো অনলাইন, ২৮ এপ্রিল ২০২৪)। এমনকি প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিজেও এমন দাবি করেছেন (উপজেলা নির্বাচন ব্যর্থ হলে ৭ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্র ক্ষুণ্ন হবে,’ বণিক বার্তা, ২৫ এপ্রিল ২০২৪)। কমিশনের সদস্যদের এমন দাবি আউয়াল কমিশনকে সচেতন নাগরিকদের কাছে হাসির পাত্র না করে পারে না।

আউয়াল কমিশনের সদস্যদের এমন বক্তব্য ও নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সদস্যদের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ নাগরিকদের নির্বাচনব্যবস্থার ওপর আস্থাহীন না করে পারে না। আর এমন আস্থাহীনতার কারণেই বিএনপিসহ প্রধান বিরোধী দলগুলো নির্বাচন বর্জন করেছে। বিরোধী দলের নির্বাচন বর্জনও প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচনে অসন্তোষজনক ভোটার উপস্থিতির আরেকটি কারণ।

উপজেলা নির্বাচন নিয়ে ভোটারদের অনীহার আরেকটি কারণ হলো এটি বর্তমানে একটি অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। আর এ অকার্যকারিতার বড় কারণ হলো উপজেলা পরিষদের ওপর সংসদ সদস্যদের সংবিধানবহির্ভূত হস্তক্ষেপ এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের অযাচিত নিয়ন্ত্রণ।

অনেকেরই হয়তো স্মরণ আছে যে গত বিএনপি আমলে একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে জেলা মন্ত্রীর পদ সৃষ্টি করা হয়, যার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে একটি মামলা হয়।

মামলার রায়ে বিচারপতি খায়রুল হক ও বিচারপতি ফজলে কবির ওই প্রজ্ঞাপন বাতিল এবং স্থানীয় নির্বাচনে সংসদ সদস্যদের জড়িত হওয়াকে ক্ষমতার পৃথক্‌করণ নীতি লঙ্ঘনের কারণে অসাংবিধানিক ঘোষণা করেন [আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বনাম বাংলাদেশ, ১৬বিএলটি(এইচসিডি)(২০০৮)]।

তবু সংবিধান অমান্য করে ক্ষমতাসীন সরকারের আমলে সংসদ সদস্যদের উপজেলা পরিষদের উপদেষ্টা করা হয় এবং স্থানীয় উন্নয়নের জন্য তাঁদের কোটি কোটি টাকা দেওয়া হয়।

একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অধীন কাজ করার কথা থাকলেও আমাদের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা সংবিধান উপেক্ষা করে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রণ করছেন। এ ছাড়া বর্তমানে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোতে সম্পদ ও জনবলের চরম সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যা–ও এসব প্রতিষ্ঠানকে অকার্যকর করে ফেলেছে।

এটি সুস্পষ্ট যে বর্তমানে আমাদের নির্বাচনব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। আমাদের নির্বাচনব্যবস্থা এখন নির্বাসনে চলে গেছে। এ ছাড়া অযাচিত হস্তক্ষেপের ফলে উপজেলা পরিষদসহ আমাদের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো অকার্যকর হয়ে পড়েছে।

ভঙ্গুর নির্বাচনব্যবস্থা ও অকার্যকর উপজেলা পরিষদই মূল রোগ এবং নির্বাচনের ব্যাপারে ভোটারদের অনীহা যার উপসর্গমাত্র। তাই সত্যিকারার্থেই রোগের চিকিৎসা করতে হলে নির্বাচন কমিশনসহ নির্বাচনের সঙ্গে সম্পৃক্ত সব প্রতিষ্ঠানের পক্ষপাতদুষ্টতা নিরসন করতে এবং উপজেলা পরিষদকে কার্যকর করার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে।

● ড. বদিউল আলম মজুমদার সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)