শিরোনামটি ধার করা। সদ্য প্রয়াত আকবর আলি খানের প্রায় ২০ বছর আগে প্রকাশিত পরার্থপরতার অর্থনীতি বইটির দ্বিতীয় অধ্যায়ের শিরোনামটি ধার করেছি। অর্থনীতির অনেক কঠিন তত্ত্ব আর তার বিপরীতে আমাদের রূঢ় বাস্তবতার সহজ-সরল চিত্র ফুটিয়ে তোলার কারণে বইটি ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে।
‘শুয়োরের বাচ্চাদের অর্থনীতি’ অধ্যায়ের কয়েকটি বাক্য উদ্ধৃত করার লোভ সামলাতে পারলাম না, ‘...তবু দুর্নীতি নির্মূল করা সহজ হবে না। শুয়োরের বাচ্চারা এক দিনে জন্ম নেয় না, কাজেই রাতারাতি তারা উধাও হবে না। দীর্ঘস্থায়ী এ প্রক্রিয়ার প্রথম পদক্ষেপ হতে হবে সরকারের আয়তন হ্রাস। জনগণেরও ভালো করে বুঝতে হবে যে বর্তমান কাঠামোতে সরকার জনগণের ভালো করতে গেলে তাদের উপকার হবে না, হবে অনিষ্ট।’
‘উন্নয়নশীল দেশের জনগণকে তাদের সরকারকে বলতে হবে: “হুজুর আমরা আপনার কাছে উপকার চাই না, শুধু মেহেরবানি করে আপনার শুয়োরের বাচ্চাদের সামলান।”
‘সাম্প্রতিক গবেষণায় দুর্নীতির চার ধরনের কুফলের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। প্রথমত, দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্রে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত হয়। রাজস্ব বিভাগে দুর্নীতির ফলে সরকারের পক্ষে প্রয়োজনীয় সম্পদের জোগান দেওয়া সম্ভব হয় না।
অন্যদিকে দুর্নীতিপরায়ণ সরকারের ব্যয় বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা দেয়। আয় ও ব্যয়ের অসামঞ্জস্যের ফলে বাজেট ঘাটতি বেড়ে চলে এবং মূল্যস্ফীতির ধাবমান ঊর্ধ্বগতি দেখা দেয়। দ্বিতীয়ত, দুর্নীতিপ্রবণ সমাজে পরিবেশের দ্রুত অবক্ষয় ঘটে। দুর্নীতির কারসাজিতে পরিবেশসংক্রান্ত আইনকানুন সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হয় না।
তৃতীয়ত, দুর্নীতি সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্যকে প্রকটতর করে। দুর্নীতির পূর্ণ দায় বহন করে সমাজের দরিদ্র ও বিত্তহীন জনগোষ্ঠী। যারা ধনী, তারা ঘুষ দিয়ে সাত খুন মাফ পেয়ে যায়। দুর্নীতির মাশুল শোধ করে অসহায় ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী। সর্বোপরি বিভিন্ন সমীক্ষা হতে দেখা যায় যে দুর্নীতি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করে।...’
২০ বছর আগে আকবর আলি খান যা লিখেছিলেন, তার সত্যতা এখন আমরা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করছি। উন্নয়নের দুর্ভাগ্যে আমাদের কপাল পুড়ছে।
এভাবে দেশ চলতে পারে না। সমস্যাগুলোর সমাধান দুরূহ নয়, কিন্তু আমাদের সরকার এ সমাধান চাইবে, নাকি কর্তৃত্ববাদ বজায় রাখবে, সেটাই দেখার বিষয়। কর্তৃত্ববাদ বজায় থাকলে আমাদের কপাল আরও খারাপ হবে।
আরেকটি উদ্ধৃতি না দিলেই নয়। ১৮ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত প্রথম আলোর ষষ্ঠ পাতার এক খবরের শিরোনাম ছিল, ‘বর্তমান সরকার ও ছাত্রলীগের মতাদর্শ জঙ্গিবাদী’। তাতে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের বক্তব্য তুলে ধরে বলা হয়েছে, ‘...ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার ও তাদের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের মতাদর্শকে “জঙ্গিবাদী” মতাদর্শ বলে আখ্যা দিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ।
তিনি বলেন, “জঙ্গিবাদী চিন্তা হলো সেই চিন্তা, যা অন্য কোনো চিন্তাকে গ্রহণ করে না। অন্যের মতকে গ্রহণ করার মানসিকতা না থাকা এবং যেকোনো মত নিজের মতের বিরুদ্ধে গেলে হামলা করাই যদি জঙ্গিবাদী মতাদর্শ হয়, তাহলে বর্তমান সরকার ও তাদের ছাত্রসংগঠন জঙ্গিবাদী মতাদর্শ থেকে কীভাবে আলাদা হলো? তাদের মতাদর্শও তো জঙ্গিবাদী মতাদর্শ।”
‘আনু মুহাম্মদ বলেন, “সরকার বলছে যে তারা খুব জঙ্গিবিরোধী লড়াই করছে। কিন্তু জঙ্গিবাদী মতাদর্শ ধারণ করে একটা সরকার কী করে এই লড়াই করবে? জঙ্গিবাদবিরোধী লড়াইয়ের প্রধান শক্তি হচ্ছে সৃজনশীলতা, ভিন্নমত, প্রশ্ন উত্থাপন ও বিশ্লেষণী ক্ষমতা...”’
আকবর আলি খানের ওপরের উদ্ধৃতির মতো অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের কথাগুলোও যদি নিকট ভবিষ্যতে সত্যি প্রমাণিত হয়, তাহলে আমাদের কপালে দুর্ভাগ্যের রেখাটা শুধু গভীরই হবে না, আমাদের কপাল পুড়ে ছাই হবে।
পত্রপত্রিকায় পড়ছি আর টেলিভিশনের সংবাদে দেখছি, ২২ আগস্ট থেকে বিএনপির প্রতিবাদ সভা, মিটিং-মিছিলে প্রচুর সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। সবাই নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন, সংবাদগুলোর বিবরণ প্রায়ই এক গোছের। অর্থাৎ, বিএনপির মিটিং-মিছিলে বাধা দেওয়া হচ্ছে এবং ইটপাটকেল-লাঠিসোঁটা নিয়ে সরকারি দল ও তার অঙ্গসংগঠনের ‘প্রচণ্ড সক্রিয়’ নেতা-কর্মীরা চড়াও হচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও শামিল হচ্ছে লাঠিপেটা ও কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে। গোলাগুলিও হয়েছে। এ পর্যন্ত নিহত হয়েছেন তিনজন।
কয়েক দিন আগে প্রথম আলোতেই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল এই মর্মে যে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় অফিসের সামনে আর প্রেসক্লাবের মানববন্ধন ছাড়া বিএনপিকে কোথাও দাঁড়াতে দেওয়া হবে না। ২২ আগস্টের পর সরকারে কিছু মন্ত্রী অনবরত বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছেন যে সরকার যেকোনো মূল্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে বদ্ধপরিকর। এর জন্য দলীয় নেতা-কর্মী ও পুলিশ বাহিনী সর্বত্র সদা তৎপর।
এ ধরনের তৎপরতা বিশ্বের বহু কর্তৃত্ববাদী দেশকে দুটি অবশ্যম্ভাবী পরিণতির দিকে নিয়ে গেছে। প্রথমত, কিছু কর্তৃত্ববাদী দেশে বিরোধীদের দমনে সরকার সম্পূর্ণ সফল হয়েছে। ফলে তাদের স্থায়িত্ব বেড়েছে, জনগণের দুর্ভোগ আরও স্থায়ী হয়েছে। যেমন জিম্বাবুয়ের স্বাধীনতার পর রবার্ট মুগাবের একটানা ৩৭ বছরের শাসনামল। আর অন্য কিছু দেশে এই পথে কর্তৃত্ববাদী সরকার বিফল হয়েছে। পরিণতিতে দেশগুলো ও সমাজ চরম বিশৃঙ্খলা আর বিপর্যয়ে পড়েছে। দেশ রসাতলে গেছে।
দু-একটা উদাহরণ দেব। হাইতি মধ্য আমেরিকার একটা দ্বীপরাষ্ট্র। স্বাধীন হয়েছে কমবেশি ২০০ বছর আগে। জনসংখ্যা প্রায় সোয়া কোটি। পুলিশ আছে হাজার বারো। বেতন পাচ্ছে না বেশ কয়েক মাস ধরে।
এ কারণে তারা সংঘবদ্ধভাবে নেমেছে লুটপাট আর ডাকাতিতে। নাগরিকেরা যে যেভাবে পারছে, দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে। লেবাননের ব্যাংকগুলো ঘোষণা দিয়েছে, ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে তারা ব্যাংক আর খুলবে না।
ব্যাংকে গচ্ছিত জনগণের টাকা, বিশেষ করে ডলার গোছের বৈদেশিক মুদ্রা সরকার তুলে নিচ্ছে কয়েক বছর ধরেই। এ কারণে ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। নিজেদের গচ্ছিত টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য জনগণ ব্যাংকের কর্মচারীদের ওপর চড়াও হচ্ছে। তাই ব্যাংক বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ব্যাংকগুলো। লেবাননকে এককালে মধ্যপ্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড বলা হতো।
যেমন ধরা হতো ভেনেজুয়েলাকে দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে ধনী দেশ। সেই ভেনেজুয়েলায় এখন ক্ষুধার্তের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার কমবেশি অর্ধেক। ভেনেজুয়েলার লোকজন খাবারের আশায় নিজের দেশ থেকে পালাতে দিগ্বিদিক ছুটছে।
কথায় বলে, ‘একটা মিথ্যায় শুরু। তারপর মিথ্যার ফুলঝুরি। তারপর আসে পরিসংখ্যান।’ এটাও ধার করা কথা। শুধু একটা কথা যোগ করব। এখন আমরা আছি পরিসংখ্যানভিত্তিক উন্নয়নের বয়ানের দেশে। গাছের বয়স বাড়লে ডালপালা অবশ্যই গজাবে। বাড়বে, বড় হবে। দেশের বয়স তো ৫০ পেরিয়ে গেছে।
কিছু ডালপালা তো বড় হবেই। বাঁশের সাঁকোর বদলে ইট-সুরকি, সিমেন্ট-রডের সেতু-কালভার্ট হবেই। মেঠো রাস্তা পাকা হবে। তারপর অর্থ কামাইয়ের জন্য পাকা রাস্তা প্রশস্ত হবে। আর দিকে দিকে চলবে ছোট ছোট গোষ্ঠীর অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকার মতো উন্নতি।
১৩ থেকে ১৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদার দেশে তৈরি হয়েছে এর দ্বিগুণ উৎপাদন ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র। তারা বিদ্যুৎ উৎপাদন করে না, কিন্তু জনগণের কাছ থেকে তাদের জন্য আদায় করা হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা।
কোনো দেশেই রাজপ্রাসাদের আশপাশে বস্তি থাকে না। রাজপ্রাসাদে থেকে দুঃখী মানুষ দেখা যায় না বললেই চলে। আমাদের মতো কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলোর অন্তত একটা ব্যাপারে কপাল মন্দ। মিসরের পাঁচ হাজার বছরের সভ্যতার ইতিহাসে সুষ্ঠু ভোট হয়েছিল মাত্র একবার। সেই একবারের ভোটে জেতা প্রেসিডেন্টকে গদিছাড়া করা হয়েছিল। বেচারা মৃত্যুবরণ করেছেন জেলখানায়, ২০১৯ সালে।
পক্ষান্তরে আমাদের ভোটের বাতিক শুরু হয়ে গিয়েছিল সেই ১৯৫৪ সালে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জাতপাত, ধর্ম, বর্ণ, নারী-পুরুষ, রাজনৈতিক মতাদর্শনির্বিশেষে সব প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পেয়েছিলেন।
ধর্মবর্ণ-নির্বিশেষে সব প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করে যুক্তরাষ্ট্রে আইন পাস হয়েছিল ১৯৬৪ সালে। কিন্তু ১৯৭৬ সালে প্রথম এই আইনের বাস্তব প্রয়োগ হয়েছিল। অর্থাৎ, ওই বছরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ধর্মবর্ণ-নির্বিশেষে যুক্তরাষ্ট্রের সব নাগরিক ভোট দিতে পেরেছিলেন। আগেই বলেছি, আমরা পেরেছিলাম ১৯৭০ সালে।
এ দেশের মানুষ ভোট দিতে জানেন এবং প্রতি পাঁচ বছরে অন্তত একবার সুষ্ঠু ভোট চান। কিন্তু এত দিনে তাঁরা বুঝে গেছেন, তাঁদের ভোট এখন মূল্যহীন। তাঁরা নির্ভয়ে ভোট দিতে পারবেন এবং তাঁদের দেওয়া ভোটের সঠিক গণনায় নির্বাচনের জয়-পরাজয় নির্ধারিত হবে—এ আশা এখন বোধ হয় চলেই গেছে।
এভাবে দেশ চলতে পারে না। সমস্যাগুলোর সমাধান দুরূহ নয়, কিন্তু আমাদের সরকার এ সমাধান চাইবে, নাকি কর্তৃত্ববাদ বজায় রাখবে, সেটাই দেখার বিষয়। কর্তৃত্ববাদ বজায় থাকলে আমাদের কপাল আরও খারাপ হবে।
ড. শাহদীন মালিক বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক