মতামত

ড. ইউনূস, নোবেল বিজয়ী-রাষ্ট্রনেতাদের উদ্বেগ ও কিছু কথা

ড. মুহাম্মদ ইউনূস
ছবি: রয়টার্স

প্রায় ৩০ বছর আগের কথা। আমি তখন কাজ করি এক আন্তর্জাতিক সংস্থায়, ওয়াশিংটনে। সংস্থার কাজে আমাকে প্রায়ই বাইরে অন্যান্য দেশে যেতে হতো। ড. মুহাম্মদ ইউনূস তখন বিশ্বজোড়া নাম পেয়েছেন তাঁর গ্রামীণ ব্যাংকের জন্য। যদিও তখনো তিনি নোবেল পুরস্কার পাননি, কিন্তু তাঁর গ্রামীণ ব্যাংকের কথা পৃথিবীর বিভিন্ন বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক নেতা থেকে সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। সেবার আমি এক দেশে সংস্থার কাজ সেরে ফেরার পথে প্যারিস ছিলাম দুই দিন।

এক সকালে ট্যাক্সি নিলে আফ্রিকান ট্যাক্সিচালক আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমি ভারতীয় কি না? আমি যখন তাঁকে বললাম, ‘না, আমি বাংলাদেশি।’ তিনি হেসে বললেন, ‘তাহলে আপনি ইউনূস সাহেবের দেশের লোক?’ তখন তিনি নিজে থেকেই বললেন, কীভাবে ইউনূস সাহেবের গ্রামীণ ব্যাংক তাঁর দেশ ক্যামেরুনে কাজ করছে। তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের কাজের পদ্ধতি সম্বন্ধে ভালোভাবে জেনেছেন দেশে থাকতেই। আমার গর্বে বুক ভরে গেল। তাঁকে আমি আর বলতে গেলাম না, গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা আমার কত পরিচিত আর তাঁর প্রতিষ্ঠানের জন্ম যেখানে, সেখানে আমি গিয়েছি, আর খুব কাছ থেকে প্রথম গ্রামীণ ব্যাংকের কাজ দেখেছি।

সেদিন কেন, তার বহুদিন আগে থেকে অধ্যাপক ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংক আর তাঁকে নিয়ে বহু সেমিনার, আলোচনা, আন্তর্জাতিক সম্মেলনে আমি গিয়েছি, তাঁর সম্বন্ধে বহু পাণ্ডিত্য এবং গবেষণামূলক আলোচনা থেকে আরম্ভ করে রাজনৈতিক সমালোচনাও শুনেছি। তবে সব আলোচনা আর সব সময় সমালোচনার শেষ কথা এই ছিল যে গ্রামীণ ব্যাংক শুধু গ্রামের দরিদ্র নারীদের অর্থ উপার্জনের পথ খুঁজে দেয়নি, এটি একটি দেশের দারিদ্র্য মোচনের একটি অভিনব পন্থা।

এটি এমনই একটি পন্থা, যা শুধু পৃথিবীর দরিদ্র দেশ নয়, উন্নত দেশগুলোও গ্রামীণ ব্যাংকের উদাহরণ নিয়ে তাদের অনুন্নত অঞ্চলগুলোতে কাজ শুরু করে। এমনটিই করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন, যখন তিনি আরকানসাস রাজ্যের গভর্নর ছিলেন। তিনি আরকানসাস রাজ্যে ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প শুরু করেন গ্রামীণ ব্যাংকের আদলে। আজ সে প্রচেষ্টা পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে যুক্তরাষ্ট্র গ্রামীণ ফাউন্ডেশনের নামে ছড়িয়ে পড়েছে, যার বীজ বপন করেন অধ্যাপক ইউনূস।

বিশ্বের নেতারা এবং নোবেল বিজয়ীদের এই আবেদনের প্রতি আমাদের নেতাদের এবং এক শ্রেণির সমর্থকদের প্রতিক্রিয়া ছিল আশ্চর্যজনক। এই আবেদন তাঁরা আমলে না নিয়ে একে তাঁরা অনাহূত এবং দেশের আইনের প্রতি অবজ্ঞার সমতুল্য করলেন। কেউ মন্তব্য করলেন যে এসব আবেদনকারী আংশিক কথা শুনে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন, যেন তাঁরা জানলে অধ্যাপক ইউনূসের বিরুদ্ধে তাঁরাও কয়েকটি মামলা ঠুকে দিতেন।

অধ্যাপক ইউনূস এবং তাঁর প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংকের নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তি শুধু তাঁদের কাজের প্রতি সম্মাননা ছিল না, ব্যক্তি বিশেষের চেয়ে এটি বেশি ছিল তাদের কাজে বিশ্বের দারিদ্র্য মোচনে তাঁদের অবদানের স্বীকৃতি। তাঁদের সম্মান করা আমাদের বাংলাদেশকে সম্মান করা। আজকে বাংলাদেশি হিসেবে ইউনূসকে নিয়ে যত না গর্ব বোধ করি, তার চেয়ে বেশি গর্ব করি আমাদের দেশের নারীদের নিয়ে, যাঁদের জন্য গ্রামীণ ব্যাংক এত সফলতা পেয়েছে।

যাঁদের কারণে আজ বাংলাদেশে ৪০টি জোনে আড়াই হাজারের বেশি গ্রামীণ ব্যাংকের শাখা আর ব্যাংকটির সদস্য ৯০ লাখের বেশি—যার মধ্যে ৯৬ শতাংশই নারী। আজ তাই অধ্যাপক ইউনূসের সফলতাকে আমরা দেশের মেহনতি নারীদের সফলতার চোখে দেখি। এটা একটা গর্বের বিষয়, কোনো ঈর্ষা বা হিংসার বিষয় নয়। অধ্যাপক ইউনূস বা তাঁর গ্রামীণ ব্যাংকের নোবেলপ্রাপ্তি তাঁকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পর্যায়ে আনেনি, কিন্তু এটা এনেছে বাংলাদেশিদের জন্য সম্মান। বিশ্বদরবারে আমাদের একটি পরিচিতি। এই সম্মান যাঁরা এনেছেন, তাঁদের হেনস্তা করা বা অবমাননা করা প্রকারান্তরে তা আমাদের নিজেদেরই অবমাননা করা।

কিন্তু এতত্সত্ত্বেও গত কয়েক বছর ধরে প্রায় ১৬৬ দেওয়ানি মামলা আর দুটি ফৌজদারি মামলার শিকার হয়েছেন অধ্যাপক ইউনূস। তাঁদের কোনো কোনো অভিযোগ গ্রামীণ সংস্থার অঙ্গপ্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ফোনের সাবেক কর্মীদের আনীত, কোনো কোনোটি দুর্নীতি দমন কমিশনের আনা, কোনো কোনোটি আয়কর বিভাগ কর্তৃক আর শেষ একটি শ্রম আইন আদালতে আনীত।

মোদ্দাকথা, অধ্যাপক ইউনূস একের পর এক মামলার সম্মুখীন হচ্ছেন কয়েক বছর ধরে। হতে পারে কোনো আইন বা প্রতিশ্রুতি ভাঙার কারণে এই মামলা, বা হতে পারে এই সম্বন্ধে অধ্যাপক ইউনূস কিছু জানতেন না।

যাঁরা ব্যবসায় বা রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, তাঁদের কোনো না কোনো মামলায় বিবাদী হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। অস্বাভাবিক সেসব ব্যক্তির জন্য যাঁরা আপাতদৃষ্টে অন্তত জনসাধারণের চোখে রাজনীতি বা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত নন, তাঁরা যখন মামলার শিকার হন। তা-ও এক-দুটি নয়, ১৬৮টি মামলার বিবাদী হন। এটা কি স্বাভাবিক?

অধ্যাপক ইউনূসের বিশ্বব্যাপী খ্যাতি একজন নোবেল বিজয়ী হিসেবে নন, একজন অভূতপূর্ব দারিদ্র্য মোচনের নতুন পথের দিশারি হিসেবে। তার অগণিত গুণগ্রাহীদের মধ্যে রয়েছেন পৃথিবীর অনেক নেতা, নোবেল পুরস্কার বিজয়ী এবং পৃথিবী বিখ্যাত শিক্ষাবিদ। তাদের মধ্যে যখন ১৭০ জনের ঊর্ধ্বে শীর্ষ ব্যক্তিরা অধ্যাপক ইউনূসের বিরুদ্ধে আনীত অস্বাভাবিক সংখ্যক মামলার প্রতিবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ জানান মামলাগুলো সরিয়ে অধ্যাপক ইউনূসকে হয়রানি থেকে বাঁচানোর জন্য, তাঁরা আমাদের দেশের আইনের প্রতি অশ্রদ্ধা জানাচ্ছেন না।

তাঁরা আমাদের সার্বভৌমত্বের প্রতি অবজ্ঞা দেখাচ্ছেন না। তাঁরা তাঁদের উদ্বেগ প্রকাশ করছেন যে অধ্যাপক ইউনূস যেন কোনো রাজনৈতিক উষ্মার শিকার না হন। তাঁরা চাইছেন একটি স্বচ্ছ প্রক্রিয়া, যাতে ইউনূসের বিরুদ্ধে আনীত সব মামলা নিষ্পত্তি হয়। সরকার যেন তাঁকে হয়রানিমূলক প্রক্রিয়ায় না ফেলে একটার পর একটা মামলা এনে।

বিশ্বের নেতারা এবং নোবেল বিজয়ীদের এই আবেদনের প্রতি আমাদের নেতাদের এবং এক শ্রেণির সমর্থকদের প্রতিক্রিয়া ছিল আশ্চর্যজনক। এই আবেদন তাঁরা আমলে না নিয়ে একে তাঁরা অনাহূত এবং দেশের আইনের প্রতি অবজ্ঞার সমতুল্য করলেন।

কেউ মন্তব্য করলেন যে এসব আবেদনকারী আংশিক কথা শুনে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন, যেন তাঁরা জানলে অধ্যাপক ইউনূসের বিরুদ্ধে তাঁরাও কয়েকটি মামলা ঠুকে দিতেন।

কেউ বললেন, এই প্রতিবাদ আমাদের দেশের সার্বভৌমত্বের ওপর হস্তক্ষেপ। তাঁরা এটা স্মরণে আনলেন না যে পৃথিবীতে যখনই কোনো মানবাধিকার বিঘ্নিত হয়েছে, তখন পৃথিবীর সব সচেতন মানুষ প্রতিবাদ জানিয়ে, যেখানে এসব ঘটনা ঘটেছে, সেখানের নেতা বা রাষ্ট্রনায়কের তা দৃষ্টিগোচর করে তার প্রতিকার চাওয়া হয়েছে। যেমন হয়েছে মিয়ানমারের সু চি বরখাস্ত আর তাঁর কারাবন্দী করার বিরুদ্ধে, যেমন হয়েছে নেলসন ম্যান্ডেলার মুক্তির জন্য, যেমন হয়েছে সাম্প্রতিক কালে যুক্তরাষ্ট্রে ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনের পক্ষে। এই প্রতিবাদের ফলে হয়েছে প্রতিকার, যা একদিনে না হলেও পরে হয়েছে।

কাজেই আমাদের নেতাদের কাছে যখন বাইরের এসব সজ্জন ব্যক্তি কোনো ব্যাপারে নেতার হস্তক্ষেপ কামনা করে চিঠি লিখেন, তা তাঁদের কোনো নিজস্ব স্বার্থে বা সে ব্যক্তি দ্বারা তাড়িত হয়ে নয়। তাঁরা উদ্বিগ্ন হন, একজন বিশ্বব্যাপী খ্যাত ব্যক্তি যেন কোনো রাজনৈতিক উষ্মার শিকার না হন। তাঁর বিরুদ্ধে আনীত প্রক্রিয়া যেন একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া না হয়। তাঁরা চান একটি স্বচ্ছ প্রক্রিয়া, যা সবাই দেখতে পায়, আর বুঝতে পারে। এটি কোনো বাইরের ষড়যন্ত্র নয়, যা আমরা আজকাল বাইরের কোনো পরামর্শকে সেভাবে দেখি।

অধ্যাপক ইউনূস কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা নন, এবং এখন তাঁর কোনো রাজনৈতিক অভিলাষ আছে কি না, আমরা জানি না। তবে ২০০৭ সালে দল গঠন করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছিলেন। এখন তাঁর কোনো ইচ্ছা আছে বলে শোনা যায় না, জানাও যায় না। থাকলে আমরা বহু আগে তা দেখতে পেতাম। তিনি একজন দেশের মানুষের সেবক। তাঁর প্রতিষ্ঠানগুলো তাই প্রমাণ দেয়। আমি আশা করব, সে হিসেবে আমরা সবাই তাঁকে দেখি এবং সম্মান করি।

  • জিয়াউদ্দিন চৌধুরী সরকারি ও বিশ্বব্যাংকের প্রাক্তন কর্মচারী