মতামত

ফিলিস্তিনে বড়দিনের সত্যিকারের শান্তি আসবে কবে

বড়দিনের প্রথম প্রহরে বেথলেহেমের চার্চ অব ন্যাটিভিটিতে ভক্তদের মোমবাতি প্রজ্বালন
এএফপি

ফিলিস্তিনি শহর বেথলেহেমের মেয়র হিসেবে আমার মানজার স্কয়ারে ক্রিসমাস ট্রির আলোকসজ্জায় আলো জ্বালানোর এবং চতুর্থ শতাব্দীতে বাইজেন্টাইন সম্রাজ্ঞী হেলেনার বানানো বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন গির্জায় আয়োজিত মধ্যরাতের খ্রিষ্ট সমাবেশে অংশ নেওয়ার সুযোগ হয়েছে। তবে এর চেয়ে বড় দায়িত্ব, বলা যায় আমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো মানুষকে ভরসা দেওয়া ও শান্তির বিষয়ে আশ্বস্ত করা।

৩ ডিসেম্বর যখন আমি ক্রিসমাস ট্রিতে আলো জ্বালাচ্ছিলাম, তখন আশা করছিলাম, এই আলো গোটা বিশ্বে আমাদের শান্তির আকাঙ্ক্ষাকে ছড়িয়ে দেবে। আমরা সম্মিলিতভাবে প্রার্থনা করছিলাম, ক্রিসমাস যেন তার প্রতিশ্রুতি পূরণ করে এবং শতধাবিভক্ত মানবসমাজকে যেন একত্র করে।

দখলদারদের অধীনে থাকা ফিলিস্তিনিদের কাছে জনগণকে একত্র করার দুটি অর্থ আছে। একটি অর্থ হতে পারে বন্ধু ও আত্মীয়দের একসঙ্গে জীবন কাটানো এবং আরেকটি হলো বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজেরা এক থাকা। কিন্তু দুই হাজার বছর আগে যে শহরে খ্রিষ্টানদের যাত্রা শুরু হয়েছিল, সেই শহরের মেয়র হিসেবে আমাকে অবশ্যই বৃহত্তর ফিলিস্তিনি পরিবারের কথা ভাবতে হবে।

বাস্তবতা হলো, আমরা কয়েক দশক ধরে দখলদারির অধীনে বাস করছি। তার মানে হলো, দুনিয়ার সবখানে মানুষ যেভাবে বড় বড় ছুটির দিনগুলো, বিশেষ করে ধর্মীয় উৎসবের ছুটির দিনগুলো সবাই এক হয়ে উদ্‌যাপন করে, কয়েক দশক ধরে আমরা সেই ঐক্যের অনুভূতি উপভোগ করতে পারি না।

গাজায় থাকা আমাদের ফিলিস্তিনি ভাইবোনেরা বেথলেহেমে অবাধে আসতে পারেন না। জর্ডান এবং অন্যান্য দেশে থাকা ভাইবোনেরাও দখলদারদের অতি কড়াকড়ির কারণে এখানে আসার ভিসা সহজে পান না। লেবানন ও সিরিয়ার মতো মধ্যপ্রাচ্যের যে দেশগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলের শান্তিচুক্তি নেই, সেসব দেশের নাগরিকদের এখানে আসার সুযোগই নেই।

আমার মতো একজন ফিলিস্তিনি খ্রিষ্টান বা নিকটবর্তী আরব দেশে বসবাসকারী একজন খ্রিষ্টান বড়দিন উদ্‌যাপনের জন্য বেথলেহেমে আসতে পারে না—এটা যেমন সবার কাছে অগ্রহণযোগ্য হওয়া উচিত; ঠিক তেমনি আট মিটার উঁচু দেয়াল (২০০৪ সালে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত যাকে অবৈধ ঘোষণা করেছে) তুলে আমাদের বিচ্ছিন্ন করে রাখাকে অন্যায় হিসেবে দেখা উচিত। এই দেয়াল আমাদের এক করার বদলে সারাক্ষণ বিভাজনের কথা মনে করিয়ে দেয়।

কিন্তু আমরা ফিলিস্তিনি খ্রিষ্টানরা, যারা দুই হাজার বছর ধরে বেথলেহেমে নিরবচ্ছিন্নভাবে বসবাস করে আসছি, তারা চাই না আমাদের গির্জাগুলো জাদুঘরে পরিণত হোক। আমরা চাই আরব খ্রিষ্টানসহ সারা বিশ্বের খ্রিষ্টান তীর্থযাত্রীরা বেথলেহেমে আসুক। তবে আপাতত, আমরা জোরদার কোনো শান্তি আলোচনা না থাকলেও আমাদের জনগণ এখনো একটি ভালো আগামীর প্রত্যাশা করে।

এ বছর বেথলেহেম পৌর কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠার দেড় শ বছর পূরণ হচ্ছে। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ আইন অনুযায়ী, এই শহরের মেয়র হয়ে থাকেন একজন খ্রিষ্টান আরব। বেথলেহেমের মতো ফিলিস্তিনি অন্য শহরগুলোতেও একই নিয়ম চালু আছে।

কিন্তু দখলদারির কারণে ফিলিস্তিনে খ্রিষ্টান আরবদের ধরে রাখা আগের চেয়ে কঠিন হয়ে পড়েছে। যদিও অনেক ফিলিস্তিনি বিদেশি সামরিক শাসনের অধীনে ভুগছে এবং তঁারা এই পরাধীন জীবন থেকে মুক্তির জন্য এখান থেকে চলে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন; কিন্তু তাঁরা যেতে পারেন না। তবে ফিলিস্তিনি খ্রিষ্টানদের অধিক সংখ্যায় এলাকা থেকে চলে যাচ্ছেন। কারণ, গির্জা ও পর্যটন ব্যবসার সুবাদে তাদের বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ আছে।

দুই হাজার বছর আগে মেরি ও জোসেফের সময় বেথলেহেমে যত মানুষ ছিল কালের পরিক্রমায় তার চেয়ে সেখানে এখন মানুষ বহুগুণ বেড়েছে। এখানে হোটেলের কক্ষের সংখ্যাও বাড়ছে। কিন্তু দখলদারেরা আমাদের জনসংখ্যার বৃদ্ধি এবং পর্যটকদের আবাসন সংকুচিত করে রাখছে। আমাদেরই ভূমিতে ইসরায়েল দেয়াল তুলে আমাদের আটকে রাখছে, বাইরের লোকদেরও এখানে আসতে দিচ্ছে না। ইসরায়েল এখানে বসতি গড়ার পরিকল্পনা করার কারণে আমাদের স্বাভাবিক নগর-পরিকল্পনা অনুসরণ করার অনুমতি দিতে অস্বীকার করছে।

আমাদের আধুনিক বাড়িঘর তুলতে দেয় না। ইসরায়েল এখানে যে বসতি গড়ে তুলছে, তা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ কর্তৃক দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ বলে বিবেচিত। তারপরও ইসরায়েল আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে বসতি তুলছে এবং জমি বাজেয়াপ্ত করে চলেছে।

শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বেথলেহেমে ভিন্ন তিন দিনে বড়দিন পালিত হয়ে আসছে। এই উৎসবগুলোতে মূলত খ্রিষ্টানদের তিন সম্প্রদায়ের তিনটি প্রধান গির্জার আচার-অনুষ্ঠান প্রতিফলিত হয়। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসরণ করা ক্যাথলিক সম্প্রদায় বড়দিনের উৎসব করে ২৫ ডিসেম্বর মধ্যরাতে; পূর্ব দেশীয় ক্যালেন্ডার অনুসরণ করা অর্থোডক্স খ্রিষ্টানরা উদ্‌যাপন করে ৬ জানুয়ারি এবং আর্মেনীয়রা করে ১৮ জানুয়ারি।

অটোমান সাম্রাজ্যের সময় থেকে একই নিয়মে এখানে আমরা এই উৎসব উদ্‌যাপন করে আসছি। অলিখিত নিয়মের এই শতাব্দী-প্রাচীন ব্যবস্থার জন্য একটি অত্যন্ত কঠোর প্রটোকল পরিচালনার প্রয়োজন। কারণ, রেওয়াজ অনুযায়ী এখানে স্থানীয় নেতারা সংশ্লিষ্ট গির্জার প্রধানের সঙ্গে দেখা করেন এবং তাঁদের বিভিন্ন স্থানের প্রবেশদ্বারে ও পয়েন্টে প্যাট্রিয়ার্ক এবং বিশপদের সঙ্গে ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়।

দশ বছর আগে ইউনেসকো বেথলেহেমের চার্চ অব দ্য নেটিভিটিকে সংকটের মুখে পড়া স্থাপনা হিসেবে ঘোষণা করেছিল। ব্যক্তিগত ও সরকারি দাতাদের অর্থায়নে ফিলিস্তিনি সরকার সেটির ব্যাপক সংস্কার করে। কয়েক শতাব্দী আগে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত গির্জার মোজাইক এবং অন্যান্য উপাদান ঠিক করা হয়েছিল।

কিন্তু আমরা ফিলিস্তিনি খ্রিষ্টানরা, যারা দুই হাজার বছর ধরে বেথলেহেমে নিরবচ্ছিন্নভাবে বসবাস করে আসছি, তারা চাই না আমাদের গির্জাগুলো জাদুঘরে পরিণত হোক। আমরা চাই আরব খ্রিষ্টানসহ সারা বিশ্বের খ্রিষ্টান তীর্থযাত্রীরা বেথলেহেমে আসুক। তবে আপাতত, আমরা জোরদার কোনো শান্তি আলোচনা না থাকলেও আমাদের জনগণ এখনো একটি ভালো আগামীর প্রত্যাশা করে।

যখন আমরা ক্রিসমাস ট্রিতে আলোকসজ্জা করছিলাম, তখন প্রার্থনা করেছিলাম, সামরিক দখলের অন্ধকারে থাকা বেথলেহেমের এই আলো সমগ্র বিশ্বে পৌঁছে যাক।

দুই সহস্রাব্দ আগে বেথলেহেমের আকাশ আলোকিত হয়েছিল। তখন ‘পৃথিবীর জন্য শান্তি এবং সবার জন্য শুভকামনা’—দেবদূতেরা এই ঘোষণা করে যিশুর জন্মের ঘোষণা করেছিলেন। এই ক্রিসমাসে, আমরা সবাই যিশুর শহরে সেই সত্যিকারের শান্তির প্রতীক্ষা করছি।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

  • হান্না হানানিয়া বেথলেহেমের মেয়র