চীন সফরে মিয়ানমারের সাবেক প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন
চীন সফরে মিয়ানমারের সাবেক প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন

মিয়ানমারে চীনের ভূরাজনৈতিক প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা

মিয়ানমারের সম্ভাব্য নির্বাচন চীনকে দেশটিতে কূটনৈতিক সম্পর্ক বাড়াতে উৎসাহিত করছে। এই পদক্ষেপ ওই অঞ্চলে চীনের প্রভাব বাড়ানোর ক্ষেত্রে একটি কৌশলগত প্রচেষ্টা। শাসক দল ও বিরোধী দলগুলোকে আলোচনায় আমন্ত্রণ জানিয়ে, চীন নিজেকে শান্তি প্রতিষ্ঠায় মধ্যস্থতাকারী ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় প্রকৃত বন্ধু হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছে।

যাহোক এই মুখোশের আড়ালে চীনের একটি কৌশলগত অ্যাজেন্ডা রয়েছে। মিয়ানমারের সব পক্ষের কাছে চীন আরও আস্থা অর্জন করতে চায়। মিয়ানমারে আরও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, অবকাঠামো প্রকল্প ও বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগে (বিআরআই) বিনিয়োগ বাড়াতে চায়।

চীন সম্প্রতি মিয়ানমারে সাবেক প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন এবং বর্তমান জান্তা সরকারের উপপ্রধান জেনারেল সো উইনসহ উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। এই সফরের পেছনে বড় কী তাৎপর্য ও চীনের উদ্দেশ্য কী, তা নিয়ে নানা জল্পনা ও গুজব ছড়িয়ে পড়েছে। থেইন সেইনকে অভ্যর্থনা জানান চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই। তাঁদের মধ্যে যে আলোচনাটি হয়েছে, তাতে মিয়ানমারের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে চীনের ভূমিকাবিষয়ক জল্পনাকে উসকে দিয়েছে।

মিয়ানমারের রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের শুভেচ্ছা সফর চীনকে তার উন্নয়ন মডেল এবং ভবিষ্যতে বিআরআই প্রকল্পের জন্য নিশ্চয়তা নিশ্চিতের সুযোগ করে দিয়েছে। মিয়ানমারের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে চীনের সম্পৃক্ততার বিষয়টিও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের একটি রূপ হিসাবে বিবেচিত হবে।

সরকারিভাবে থেইন সেইনের এই সফর ছিল শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থানের পাঁচ মূলনীতি ঘোষণার ৭০ বছর স্মরণ উপলক্ষে। যাহোক এই সফর চীনের জন্য মিয়ানমারের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে থেইন সেইনের মতামত শোনার এবং রাজনীতিতে তার সম্ভাব্য প্রত্যাবর্তন সম্পর্কে জানার সুযোগ করে দিয়েছে।

জেনারেল সো উইনের ছিনডাউ সফরটি চীনের পরবর্তী কৌশলগত সম্পৃক্ততার বিষয়টিকেই সামনে আনে। সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) আয়োজিত গ্রিন ডেভেলপমেন্ট ফোরামে তিনি আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। সো উইনের সঙ্গে আলোচনায় মিয়ানমারে চীনের বিনিয়োগের নিরাপত্তা, সীমান্তের স্থিতিশীলতা এবং একটি প্রস্তাবিত নির্বাচন যা এই অঞ্চলে স্থিতিশীলতা ও চীনের বিনিয়োগ সুরক্ষা দেয়—এসব প্রসঙ্গে কথা হয়েছে।

মিয়ানমারের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের এমন এক সময়ে আমন্ত্রণ জানাল, যখন জান্তা আগামী বছর নির্বাচন করার কথা চিন্তা করছে। শাসক দল ও বিরোধী পক্ষ—উভয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ততার মধ্য দিয়ে চীন নিজেদের সংলাপ ও শান্তির নিরপেক্ষ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। যেমনটা তারা করেছে ইউক্রেনের ক্ষেত্রে। বিশ্বজুড়ে চীন এমন একটি মধ্যস্থতাকারী হিসেবে দেখাতে চায়, যারা কিনা জটিল সমস্যার সমাধান করতে পারে। যাহোক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মিয়ানমারের ব্যাপারে চীনের আরও হিসাবনিকাশ রয়েছে।

জান্তাপন্থী কট্টর রাজনীতিবিদ ও অন্যান্য উগ্রপন্থী রাজনৈতিক উপদলের সঙ্গে সম্পৃক্ততার মধ্য দিয়ে মিয়ানমারের রাজনৈতিক মানচিত্রে চীনের প্রভাব বাড়ানোর কৌশল। প্রধান প্রধান রাজনৈতিক কুশীলবের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে চীন চাইছে আসন্ন নির্বাচনে যিনিই ক্ষমতায় আসুন না কেন চীন তার স্বার্থ ও বিনিয়োগের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে। মিয়ানমারে চীনের কৌশলগত স্বার্থ শুধু রাজনৈতিক প্রভাবের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের সম্পৃক্ততার ক্ষেত্রে বিআরআই নোঙরের ভূমিকা পালন করছে।

মিয়ানমারে চীনের বিআরআই মহাপরিকল্পনার আওতায় প্রকল্পগুলোর মধ্যে জলবিদ্যুৎ, আন্তসীমান্ত শিল্পাঞ্চল, উচ্চগতির রেলওয়ে এবং কায়ুকফায়ু গভীর সমুদ্র বন্দরও রয়েছে। ২০১৩ সালে চালু হওয়া মিয়ানমার-চীন গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্প ছাড়া অন্য প্রকল্পগুলো চালু হতে বিলম্ব হয়েছে। চীনের বিআরআইয়ের উদ্দেশ্য হচ্ছে—এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকার দেশগুলোর সঙ্গে বিশাল একটা বাণিজ্য ও অবকাঠামো প্রকল্পের নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা। কৌশলগত অবস্থান, সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক সম্পদ ও গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ মিয়ানমার এই প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ।

চীন এরই মধ্যে মিয়ানমারের বন্দর, রেলসহ অবকাঠামো খাতে এবং জ্বালানি প্রকল্পে বিশাল বিনিয়োগ করেছে। যাহোক, এসব প্রকল্প যাতে মসৃণভাবে চলতে পারে এবং আরও বিকশিত হতে পারে সে জন্য চীন মিয়ানমারের রাজনৈতিক অভিজাতদের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার চেষ্টা অব্যাহতভাবে রেখে চলেছে।

মিয়ানমারের রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের শুভেচ্ছা সফর চীনকে তার উন্নয়ন মডেল এবং ভবিষ্যতে বিআরআই প্রকল্পের জন্য নিশ্চয়তা নিশ্চিতের সুযোগ করে দিয়েছে। মিয়ানমারের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে চীনের সম্পৃক্ততার বিষয়টিও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের একটি রূপ হিসাবে বিবেচিত হবে।

মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের সংঘাতের ক্ষেত্রে চীনের পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া ইউনাইটেড ওয়া স্টেট আর্মি (ইউডব্লুউএসএ) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ইউডব্লুউএসএ সম্প্রতি নর্দান শান স্টেটের তাংইয়ান শহরে সেনা নিয়োগ করেছে এবং পরবর্তী সময়ে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সঙ্গে দর–কষাকষি করেছে। এতে এটাই স্পষ্ট হয় যে ইউডব্লুউএসএর কৌশলগত গুরুত্ব কতটা বেশি।

বিশেষজ্ঞরা চীনের এই পদক্ষেপকে মুখোশ বলে বর্ণনা করছেন। তাঁরা বলছেন বন্ধুত্ব ও শান্তির বার্তা নিয়ে মিয়ানমারে চীন হাজির হলেও তাদের আসল উদ্দেশ্য রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও কৌশলগত আধিপত্য প্রতিষ্ঠা। মিয়ানমারের ভবিষ্যৎ একটা ভারসাম্যমূলক ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করছে যেখানে দেশটির সার্বভৌমত্ব এবং বাইরের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে জনগণের মঙ্গলকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।

  • বৈশালী বসু শর্মা নয়াদিল্লিভিত্তিক থিংক ট্যাংক পলিসি পারস্পেকটিভ ফাউন্ডেশনের উপদেষ্টা

দ্য ইরাবতী থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত