১৯৭৪ সালে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকি, প্রথম ভর্তি হয়েছিলাম আইন বিভাগে। দেশে দুর্ভিক্ষ, চাকরিজীবী বাবা পরিবারসহ দুঃসহ দারিদ্র্যে। অর্থাভাবে বেশির ভাগ সময় গ্রামের বাড়িতে বসে থাকি, এক সপ্তাহ ক্লাস করি তো দু সপ্তাহ নেই। কিছুদিন পরে দেখি ক্লাসে শিক্ষকদের বক্তৃতা দুর্বোধ্য মনে হচ্ছে। তখন অনুষদ পরিবর্তন করে ইতিহাস বিভাগে চলে গেলাম। আইন নিয়ে আমার আনুষ্ঠানিক লেখাপড়া ওই পর্যন্তই।
চাকরিতে ঢোকার পর আন্তর্জাতিক আইন অবশ্য কিছু পড়তে হয়েছে। দেশের সংবিধান নিয়ে আমার চিন্তা ভাবনা তাই আইনের মতো একটি জটিল বিষয়ে বিশেষায়িত জ্ঞান নেই এমন একজন সাধারণ মানুষের মতো হিসেবেই দেখা যায়। ৪ নভেম্বর সংবিধান দিবস পালিত হলো। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী বাণী দিয়েছেন। জ্ঞানী গুণী আইন বিশেষজ্ঞরা মতামত দিয়েছেন। আমি শুধু দু তিনটি বিধান নিয়ে কথা বলব, সাধারণ নাগরিক হিসাবে যে বিষয়গুলো আমাকে পীড়া দেয়।
আইন বিষয়ে কোনো দ্বিধায় উপনীত হলে আমি ড. শাহদীন মালিকের শরণাপন্ন হই। কয়েক বছর আগে এক সামাজিক অনুষ্ঠানের ফাঁকে তাঁকে বলেছিলাম, আচ্ছা, সংবিধানে কোনো সংশোধনী আনতে গেলে তো ওই মুহূর্তে বিদ্যমান ব্যবস্থার আলোকেই করতে হবে। পঞ্চদশ সংশোধনীর আগে সংবিধানের ১৪২ ধারায় এরূপ সংশোধনীর ক্ষেত্রে গণভোটের বিধান ছিল, পঞ্চদশ সংশোধনীতে যা উঠিয়ে দেওয়া হয়। এই উঠিয়ে দেওয়াটি তো বিদ্যমান ব্যবস্থা, অর্থাৎ গণভোটে সিদ্ধ করে নেওয়া প্রয়োজন ছিল, তাই না? কিন্তু তা করা হয়নি। তাহলে এই সংশোধনী কি অকার্যকর নয়? ড. মালিক বলেছিলেন, হ্যাঁ, এ নিয়ে কথাবার্তা আছে। সম্প্রতি জনাব বদিউল আলম মজুমদার তাঁর একাধিক লেখায় এই প্রসঙ্গ এনে খোলাসা করে বলেছেন যে সংশোধনীটি অসাংবিধানিক এবং বিষয়টি আদালতে গেলে পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল হয়ে যাবে। তিনি অবশ্য মনে করেন যে বিদ্যমান বাস্তবতায় এরূপ প্রতিকার পাওয়া দুষ্কর।
পঞ্চদশ সংশোধন পরবর্তী ৭খ অনুচ্ছেদে সংবিধানের বড় একটি অংশকে সংশোধন অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। সংবিধান প্রণয়ন বা সংশোধন করেন সংসদ সদস্যরা, যারা তাত্ত্বিকভাবে জনগণের ইচ্ছার প্রতিভূ। অর্থাৎ, সংবিধানের বিধানাবলি ওই নির্দিষ্ট সময়ে জনগণের, বা তাঁদের প্রতিনিধিদের, প্রজ্ঞার প্রতিফলন। আমরা কী করে নিশ্চিত হতে পারি যে এ ব্যবস্থা যাঁরা করেছেন, মহাকালের মাঝে তাঁরাই সবচেয়ে ঋদ্ধ, সবচেয়ে প্রজ্ঞাবান, এবং তাঁদের চেয়ে জ্ঞানী গুণী বাংলাদেশে আর কখনো জন্ম নেবে না?
পঞ্চাশ বছর পরের পৃথিবী হবে সম্পূর্ণ অন্য রকম, যখন কিছু বিধান জনস্বার্থে পরিবর্তন জরুরি হতে পারে। তখন তাহলে কী উপায় হবে? আমার মতে তাই এই ৭খ অনুচ্ছেদ রহিত করা প্রয়োজন। তবে পঞ্চদশ সংশোধনী যদি বাতিল হয়ে যায়, তখন আলাদাভাবে আর কিছু করার প্রয়োজন হবে না।
ক. বাংলাদেশের গত ৫২ বছরের ইতিহাসে দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়নি, ভবিষ্যতে হবে এমনটি অতি বড় আশাবাদীও মনে করেন না। পক্ষান্তরে গত ২৫ বছরে দেশে যত রাজনৈতিক সংঘাত, সংঘর্ষ হয়েছে তার মূল ইস্যু ছিল নির্বাচন কীভাবে হবে। এর ফলে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটেছে, সম্পদ ধ্বংস হয়েছে, অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, বিদেশিদের হস্তক্ষেপের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এ দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসতে হলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় একটি দল নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা থাকতে হবে সংবিধানেই। ‘অনির্বাচিত সরকার’ নিয়ে চলমান বাগাড়ম্বর অর্থহীন। সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তিন মাসের অনির্বাচিত সরকার চাই, না পাঁচ বছরের।
খ. বাংলাদেশে সুষ্ঠু যে চারটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তার পরিসংখ্যান (শতকরা ভোট/আসন) দেখে নেওয়া যাক। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩০.০৮ শতাংশ, বিএনপি ৩০.৮১ শতাংশ জামায়াত ১২.১৩ শতাংশ ও জাতীয় পার্টি ১১.৯২ শতাংশ ভোট পায়। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৮৮ টি, বিএনপি ১৪০ টি, জামায়াত ১৮টি ও জাতীয় পার্টি ৩৫টি আসন পায়। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩৭.৪৪, বিএনপি ৩৩.৬১, জামায়াত ৮.৬১ ও জাতীয় পার্টি ১৬.৪০ শতাংশ ভোট পায়। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৪৬ টি, বিএনপি ১১৬ টি, জামায়াত ৩টি ও জাতীয় পার্টি ৩২টি আসন পায়। ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৪০.১৩, বিএনপি ৪০.৯৭, জামায়াত ৪.২৮ ও জাতীয় পার্টি ১.১২ শতাংশ ভোট পায়। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৬২ টি, বিএনপি ১৯৩ টি, জামায়াত ১৭টি ও জাতীয় পার্টি ৪টি আসন পায়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৪৮.০৪, বিএনপি ৩২.৫০, জামায়াত ৪.৭০ শতাংশ ও জাতীয় পার্টি ৭.০৪ শতাংশ ভোট পায়। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৩০ টি, বিএনপি ৩০ টি, জামায়াত ২টি ও জাতীয় পার্টি ২৭টি আসন পায়।
এ পরিসংখ্যান থেকে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট।
১. বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুটিই প্রধান দল যাদের বিপুল জনসমর্থন আছে। আর দুটি দল আছে যাদের কিছু জনসমর্থন আছে।
২. ফলাফল যাই হোক না কেন আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি দুই দলেরই কমিটেড ভোটার আছে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ করে। এর বাইরের ভোটগুলো আসে ক্ষমতাসীনদের ওপর নানান বৈধ কারণে বিরক্ত বা ক্ষুব্ধ মানুষদের কাছ থেকে, যাদের কোনো দলের প্রতি আনুগত্য নেই এবং যারা পরিবর্তন চান।
৩. নির্বাচনে বিজয়ী দল কখনোই অর্ধেক বা বেশি ভোট পায়নি, এমনকি ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের ভূমিধস বিজয় এসেছে অর্ধেকের কম ভোটে। অর্থাৎ আমরা সব সময়ই কমসংখ্যক ভোটের প্রতিনিধিত্বশীল সরকার দ্বারা শাসিত হয়েছি। ওয়েস্ট মিনস্টার মডেলে এতে তেমন সমস্যা থাকার কথা নয়, যেহেতু গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দেশ পরিচালিত হওয়ার কথা একধরনের ঐকমত্যের ভিত্তিতে। কিন্তু আমাদের দেশে বিজয়ী দল নিজেদের একচ্ছত্র শাসক এবং পাঁচ বছর মেয়াদে সব ধরনের স্বেচ্ছাচারিতার অধিকারপ্রাপ্ত হিসেবে বিবেচনা করে। শুধু তাই নয়, অর্ধেকের কম ভোট পেয়েও একটি দল সংবিধানকে ইচ্ছামতো কাটাছেঁড়া করার অধিকার অর্জন করে। এ ছাড়া বড় দুটি দলই পরস্পরকে শত্রু জ্ঞান করে এবং বিরোধীদের কোনো পরিসর দেওয়াকে নিজেদের দুর্বলতা, এমনকি পরাজয় হিসেবে দেখে।
এই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ হিসেবে জাতীয় সংসদে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের বিধান করার বিষয়টি বিবেচনা করা জরুরি। এর ফলে কোনো দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে পরিপূর্ণ স্বেচ্ছাচারী আচরণের সুযোগ পাবে না। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের পরামর্শ রেখেছেন যাতে কোনো দল ‘ব্রুট মেজরিটি’ না পায়। এর ফলে সরকার গঠন করতে ছোট দল বা দলসমূহের সাহায্য প্রয়োজন হবে। এতে হয়তো কিছু নীতিবিবর্জিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে খানিক ‘হর্স ট্রেডিং’ এর সুযোগ সৃষ্টি হবে, কিন্তু পাঁচ বছরের জন্য মৌরুসি–পাট্টা পেয়ে গেছি এই মনোভাব তিরোহিত হবে। সংবিধান সংশোধন করতেও বিরোধী দলের সহযোগিতা প্রয়োজন হবে। দেশের প্রয়োজনে যে এটা সম্ভব তার প্রমাণ ১৯৯১ সালে প্রেসিডেন্ট পদ্ধতি থেকে সংসদীয় পদ্ধতিতে প্রত্যাবর্তনে আনা সংশোধনী পাশে উভয় পক্ষের সহযোগিতা।
বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডেকে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বিল পাশ করতে পারে। ২০২৪ এর জানুয়ারিতে হোক বা এর পরে কোনো এক সময়, একদিন দেশে অবশ্যই একটি নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে যেখানে জনগণ প্রকৃতই তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন। সে নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ বা বিএনপি তাদের কমিটেড ভোটারদের, অর্থাৎ কমবেশি এক-তৃতীয়াংশ ভোট পাবে। কিন্তু বিদ্যমান ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ ব্যবস্থায় এক-তৃতীয়াংশ ভোট পেয়েও যে কোনো দল ৩০ থেকে ৪০টি আসন লাভ করে একটি ছোট বিরোধী দলে পরিণত হবে। অথচ আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের বিধান থাকলে তারা হবে ১০০টি আসন নিয়ে একটি বৃহৎ বিরোধী দল।
উপরন্তু যে দল ক্ষমতায় যাবে, তারা আওয়ামী লীগ বা বিএনপি যে দলই হোক না কেন, নিরঙ্কুশ ক্ষমতা তাঁরা কুক্ষিগত করতে পারবেন না, যেহেতু ছোট একটি বা একাধিক দলের সঙ্গে তাদের জোট বাঁধতে হবে। এতে জনগণ এবং দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো লাভবান হবে।
সংবিধান নিয়ে চিন্তায় আরও আছে ১৮ কোটি লোকের দেশটিতে কয়েকটি প্রদেশ সৃষ্টি, এবং সেখানে ক্ষমতার উল্লেখযোগ্য বিকেন্দ্রীকরণ, স্থানীয় সরকারের প্রকৃত ক্ষমতায়ন, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার পুনর্বণ্টন, বিচারব্যবস্থার উৎকর্ষসাধন ইত্যাদি। তবে আজ থাকুক এ পর্যন্তই।
● মো. তৌহিদ হোসেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব