ইরান গেল শনিবার যে রাতে ইসরায়েলের বিভিন্ন কৌশলগত অবস্থান ও দখলকৃত পশ্চিম তীরের ইহুদি বসতি নিশানা করে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা করে, সে রাতে বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যের কেউ নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পেরেছে—এমন কথা কল্পনা করা কঠিন। যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল, জর্ডান এবং যুক্তরাজ্যের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এসব ড্রোন–ক্ষেপণাস্ত্রের প্রায় সবগুলোকে আকাশেই ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।
আসলে ১ এপ্রিল দামেস্কের ইরানি কনস্যুলেটে ইসরায়েল বোমা হামলা চালিয়ে ইরানের সামরিক বাহিনীর সাতজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাসহ মোট ১৩ জনকে হত্যা করার সময়ই তেহরানের এই নজিরবিহীন হামলার ‘ট্রিগার’ টিপে দেওয়া হয়েছিল।
ছয় মাস ধরে বাইডেন প্রশাসন নিজ দেশে প্রগতিশীল ও আরব আমেরিকান ভোটারদের সমর্থন হারানোর পরও একচেটিয়াভাবে ইসরায়েলকে গাজা যুদ্ধে সমর্থন দিয়ে গেছে। কিন্তু এখন বাইডেন প্রশাসনকে অভ্যন্তরীণ চাপ কমানোর জন্য হলেও ইসরায়েলকে যুদ্ধ থেকে সরে আসতে বলতে হবে।
ইসরায়েলের ওই হামলা ছিল ১৯৬১ সালের ভিয়েনা কনভেনশনের কূটনৈতিক সম্পর্ক অনুচ্ছেদের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। ইসরায়েলের ওই হামলা ইরানকে সামরিক প্রতিক্রিয়া জানাতে বাধ্য করেছে। ইরান এ ক্ষেত্রে কোনো প্রক্সি শক্তির সহায়তা না নিয়ে সরাসরি নিজেই আঘাত করেছে।
ভিয়েনা কনভেনশন লঙ্ঘন করে দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে ইসরায়েলের হামলাও সরাসরি ইরানের সার্বভৌমত্বের ওপর হামলা। ফলে সার্বভৌমত্ব রক্ষার অভিপ্রায় ইরানকে ইসরায়েলে আঘাত করতে উদ্বুদ্ধ করেছে। তবে এই বিপজ্জনক উত্তেজনাকর ঘটনাই এখন শাপে বর হয়ে উঠছে বলে মনে হচ্ছে।
এই হামলার কারণে আঞ্চলিক অস্ত্রবিরতির সম্ভাবনাকে জোরালো করেছে। বিশেষ করে গাজা যুদ্ধের ইতি টানা, ইসরায়েল–ইরানের পাল্টাপাল্টি শক্তি প্রদর্শন বন্ধ এবং লোহিত সাগরে ইয়েমেনের হুতিদের আক্রমণের সমাপ্তির বড় সুযোগ করে দিয়েছে ইরানের এই হামলা।
উভয় শিবিরেরই সামরিক সক্ষমতা দেখানোর সামর্থ্য থাকলেও অনুমান করা যাচ্ছে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সতর্কবার্তা মেনে নিয়ে ইরানের বিরুদ্ধে এখনই প্রতিশোধ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এর ফলে এ অঞ্চল একটি ‘অস্বস্তিকর ভারসাম্যের’ দিকে যেতে পারে।
স্নায়ুযুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকে ধারণা করা যায়, সন্ত্রাসের ভারসাম্যও অনেক সময় সন্ত্রাস ঠেকাতে শক্তিশালী প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করতে পারে এবং শান্তি ও স্থিতিশীলতা বাড়াতে পারে।
এই সংকীর্ণ সুযোগটিকেই কাজে লাগিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে শক্তিশালী ও বাধ্যবাধকতাভিত্তিক একটি প্রস্তাব পাস করতে হবে। সেই প্রস্তাবে একটি আঞ্চলিক যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানাতে হবে।
ইসরায়েল ও ইরানের বাইরেও প্রস্তাবটি এই অঞ্চলের সব দেশ এবং তৃতীয় পক্ষের যোদ্ধাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে হবে। এই বাধ্যবাধকতামূলক প্রস্তাবটির মাধ্যমে অবশ্যই বর্তমান আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতার ভরকেন্দ্র গাজা যুদ্ধকে প্রধান সমস্যা হিসেবে আমলে নিতে হবে এবং তার সমাধান করতে হবে।
গত ২৫ মার্চের প্রস্তাবের (যেখানে ভোট দেওয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে বিরত রেখেছে) সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নিরাপত্তা পরিষদকে অবশ্যই গাজায় ইসরায়েলের চলমান বোমাবর্ষণ বন্ধ করার এবং হামাসের হাতে আটক হওয়া সব ইসরায়েলি জিম্মি ও বন্দীদের মুক্তির দাবি জানাতে হবে। আন্তর্জাতিক আইনের বাধ্যবাধকতা মেনে নেওয়া প্রস্তাবটি ইসরায়েলের হাতে আটক ফিলিস্তিনিদের মুক্তির সুযোগও এনে দিতে পারে।
একটি সর্বাত্মক যুদ্ধ–ঝুঁকির পরিপ্রেক্ষিতে নিরাপত্তা পরিষদকে অবিলম্বে জাতিসংঘ সনদের ৭ অধ্যায়ের অধীনে সমগ্র অঞ্চলকে অন্তর্ভুক্ত করে একটি নতুন প্রস্তাবের খসড়া তৈরি করতে হবে এবং তা পাস করার জন্য ভোট দিতে হবে। সেই নতুন প্রস্তাবে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের সমাধানকে মাথায় রাখতে হবে এবং ১৯৬৭ সালের সীমানা অনুযায়ী একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিশদ রোডম্যাপ দাঁড় করাতে হবে। সৌদি আরব যেমনটা বলেছে: ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পূর্বশর্ত হলো একটি বিশ্বাসযোগ্য ‘সমাধানের পথ’।
ছয় মাস ধরে বাইডেন প্রশাসন নিজ দেশে প্রগতিশীল ও আরব আমেরিকান ভোটারদের সমর্থন হারানোর পরও একচেটিয়াভাবে ইসরায়েলকে গাজা যুদ্ধে সমর্থন দিয়ে গেছে। কিন্তু এখন বাইডেন প্রশাসনকে অভ্যন্তরীণ চাপ কমানোর জন্য হলেও ইসরায়েলকে যুদ্ধ থেকে সরে আসতে বলতে হবে।
● দাউদ কাত্তাব আন্তর্জাতিক পুরস্কারজয়ী ফিলিস্তিনি সাংবাদিক
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ