গত মাসে হ্যালোইন উৎসবের সময় হোয়াইট হাউস ভুতুড়ে রং এবং ফোলানো বেলুন দিয়ে বানানো মিষ্টিকুমড়া দিয়ে সাজানো হয়েছিল। বিচিত্র সব পোশাকে সজ্জিত হয়ে সারি বেঁধে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে যে শিশুরা তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল, তাদেরকে তিনি বাক্সভর্তি চকলেট বিতরণ করেন। অনেক শিশুর সাজসজ্জায় খুবই চমৎকারভাবে কাল্পনিক ভয়ের ছবি ফুটে উঠেছিল।
এসব শিশুর মধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্টনি ব্লিঙ্কেনের ছেলেও ছিল। ছেলেটি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির মতো পোশাক পরে এসেছিল। ব্লিঙ্কেনের মেয়ে এমনভাবে সেজে এসেছিল যে তাকে দেখতে ঠিক ইউক্রেনের মতো লাগছিল।
বাইডেনের সেই হ্যালোইন পার্টিতে কেউই ইসরায়েলি অথবা ফিলিস্তিনি সেজে আসেনি। অথচ সেখানকার যুদ্ধটা ইউক্রেনের চেয়েও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে প্রবেশ করে হামাসের হামলার (১৪০০ ইসরায়েলি নিহত হন) পর ইসরায়েল গাজার ঘনবসতিপূর্ণ জনবসতিকে লক্ষ্যবস্তু করে হামলা শুরু করেছে।
ইসরায়েল বিমান হামলা চালিয়ে গাজার সবচেয়ে বড় শরণার্থীশিবির ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে। বোমা ফেলে ভবনগুলো গুঁড়িয়ে দিয়েছে। এই হামলা গাজায় মহাপ্রলয়ের দৃশ্যপট তৈরি করেছে। ছবি ও ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, সদ্য ধসে পড়া ভবনের ছড়িয়ে পড়া ধুলাবালি আর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মৃতদেহ আর মৃত্যুপথযাত্রীদের পাশ দিয়ে শিশুরা তাদের বুকে আরেক শিশুকে আঁকড়ে ধরে ভয়ে চিৎকার করতে করতে আর কাঁদতে কাঁদতে বাঁচার জন্য ছুটছে।
২১ মাসের ইউক্রেন যুদ্ধে যত শিশু মারা গেছে, গাজায় এক মাসে তার চেয়ে ছয় গুণ বেশি শিশু মারা গেছে। সর্বশেষ সংঘাতে এ পর্যন্ত গাজায় ১১ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এর ৪০ শতাংশই শিশু। ইউনিসেফ বলছে, গাজা এখন শিশুদের জন্য কবরস্থান।
জাতিসংঘ শিশু তহবিলের হিসাব বলছে, গাজায় প্রতিদিন গড়ে ৪২০ শিশু হতাহত হচ্ছে। এই সংখ্যা আমাদের প্রত্যেকের বিবেককে ঝাঁকুনি দেওয় দেওয়া উচিত। কিন্তু এই সংখ্যা বাইডেনকে যে নাড়া দিচ্ছে না, সেটা বলাই বাহুল্য। বাইডেন শর্তহীনভাবে ইসরায়েলকে সমর্থন ও সামরিক সহায়তা দিয়ে চলেছেন। অন্ধভাবে যুদ্ধবিরতির বিরোধিতা করে চলেছেন।
বাইডেনের এই অবস্থান তাঁকে বেকায়দায় ফেলেছে। বেসামরিক জনসাধারণকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার এই ঘটনাকে জাতিসংঘ বলেছে ‘জনসাধারণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া সামষ্টিক শাস্তি’। ইসরায়েলি ইতিহাসবিদ রাজ সিগ্যাল হলোকাস্ট ও আধুনিক গণহত্যা বিষয়ে অধ্যয়ন করেছেন। এ ঘটনাকে তিনি ‘গণহত্যার ধ্রুপদি উদাহরণ’ বলেছেন। অথচ বাইডেন খোলাখুলিভাবে ইসরায়েলকে দায়মুক্তি দিয়ে চলেছেন।
এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র বলে পরিচিত অনেক দেশের নেতারাও এ ঘটনায় মিনমিন করে কথা বলছেন না। আমেরিকার নীতিই কার্যত সমাধান—সেই অবস্থান ভেঙে তারা বেরিয়ে এসেছেন। গাজা যুদ্ধ তীব্র হচ্ছে আর লাশের ব্যাগের স্তূপ যতই উঁচু হচ্ছে, ততই ইউক্রেন আগ্রাসনের ভুক্তভোগী আর গাজা আগ্রাসনের ভুক্তভোগীদের নিয়ে বাইডেনের দ্বিচারিতা স্পষ্ট হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে, বৈশ্বিক দক্ষিণ স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের প্রশ্নে আমেরিকানদের হিতোপদেশকে প্রশ্ন করে চলেছে।
এই দিনগুলোতে একটা প্রশ্নই জন্ম হচ্ছে, উদারনৈতিক বিশ্বব্যবস্থার প্রধান জিম্মিদার যুক্তরাষ্ট্র কি শুধু বাদামি লাশের ক্ষেত্রেই উদার?
সিগ্যালের মতো ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা দ্য সিলভা ইসরায়েলের সামরিক অভিযানকে গণহত্যা হিসেবে দেখছেন। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ও গণতন্ত্রের আইকন আনোয়ার ইব্রাহিম এটিকে সর্বাচ্চ মাত্রার বর্বরতা বলেছেন। ইসরায়েলের ‘অমানবিক’ বিমান হামলার জন্য বেলজিয়াম ইসরায়েলের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে চেয়েছে। ফ্রান্স চেয়েছে ইসরায়েল যেন বোমা হামলা বন্ধ করে। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেছেন, শিশুহত্যা বন্ধ করা প্রয়োজন।
যুক্তরাষ্ট্রের আরেক ঘনিষ্ঠ মিত্র অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজ জোর দিয়ে বলেন, প্রতিটি ফিলিস্তিনির জীবন গুরুত্বপূর্ণ। ইসরায়েলকে তিনি যুদ্ধের রীতিনীতি মেনে চলার কথা বলেন।
ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যেকোনো সমালোচনাকে ইহুদিবিরোধী সমালোচনার তকমা দিয়ে উদারনৈতিক বিশ্বব্যবস্থা কোমর বেঁধে লড়াইয়ে নেমে পড়ে। ইসরায়েলকে কেউ অপমান করলে ফ্রান্স তাকে জেলে পাঠানোর কথা চিন্তা করছে। আর ব্রিটিশ সরকার যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভকে ‘ঘৃণা মিছিল’ বলেছে।
কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব ও ইসলামি বিশ্বের বাইরে অনেকে মনে করেন, গাজায় যে অবর্ণনীয় মানব ট্র্যাজেডি, সেটা একেবারে অগ্রহণযোগ্য। এই সংঘাতে যে হৃদয়বিদারক ঘটনাবলি, তা এ ধারণার জন্ম দিচ্ছে যে রাষ্ট্রীয় আচরণ হিসেবে গ্রহণযোগ্য রীতিনীতির অঙ্গহানি করা হচ্ছে চরম অসংযত উপায়ে এবং বৈশ্বিক আইনকানুন ও প্রতিষ্ঠান সেটা থামাতে ব্যর্থ হচ্ছে। বাইডেন প্রশাসন শৃঙ্খলাভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থাকে তাদের মূলমন্ত্র করেছে। কিন্তু গাজা ক্রমশই সেই বিশ্বব্যবস্থার বধ্যভূমি হয়ে উঠছে। গাজার এই গণহত্যা যদি ‘শৃঙ্খলা’র উদাহরণ হয়, তাহলে বিশৃঙ্খলাটা দেখতে কেমন?
শৃঙ্খলাভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থা এবারই প্রথম অবজ্ঞা করল তা নয়। ইরাক ও ইউক্রেনে আগ্রাসনের পর ইসরায়েলকে ধরার সুযোগ কতটা? কিন্তু গাজার মানবিক বিপর্যয় উদার বিশ্বব্যবস্থার নৈতিক যে কর্তৃত্ব, তাতে অভূতপূর্ব সংকট তৈরি করেছে।
দেবাশিষ রায় চৌধুরী টু কিল আ ডেমোক্রেসি : ইন্ডিয়া’স প্যাসেজ টু ডেসপোটিজম বইয়ের সহলেখক
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত