কয়েক মাস দেরি ও ইউক্রেনের দিক থেকে মরিয়া আবেদনের পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদ অবশেষে ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তার জন্য ৬০ বিলিয়ন ডলারের বিল অনুমোদন করে।
এই বিলটি চূড়ান্ত হতে এখন সিনেটের অনুমোদন লাগবে। আর আইনে পরিণত হতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের স্বাক্ষর লাগবে। কিন্তু এর আগে যেভাবে সিনেটে একই রকম বিল অনুমোদন করা হয়েছে এবং বাইডেন প্রবলভাবে যেভাবে বিলের পক্ষে ওকালতি করেছেন, তাতে বলা যায় বিলটি আইনে পরিণত হওয়া কেবল আনুষ্ঠানিকতার ব্যাপার মাত্র।
সুতরাং এখন এই প্রশ্নটি করা দরকার যে এই সহায়তা কি ইউক্রেনকে পরাজয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে পারবে? উত্তরটি মোটেই সরাসরি নয়। একটা বিষয় নিশ্চিত যে এই সমর্থন যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেনকে কিছুটা শ্বাস ফেলার জায়গা দেবে।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ভূখণ্ড জিতে নেওয়ার ক্ষেত্রে রাশিয়ান বাহিনীর যে ধীর; কিন্তু ধারাবাহিক আক্রমণ তার গতি কিছুটা রুদ্ধ করার সুযোগ দেবে ইউক্রেনকে।
সিনেট ও প্রেসিডেন্টের অনুমোদনের বাইরেও ৬০ বিলিয়নের সামরিক সহায়তা ইউক্রেনের কাছ পৌঁছাতে কিছু লজিস্টিক সমস্যা উতরাতে হবে। সবচেয়ে জরুরি প্রয়োজন সামরিক সরঞ্জাম, বিশেষ করে গোলাবারুদ। পোল্যান্ডে যদিও এর মজুত করা আছে। কিন্তু ফ্রন্টলাইন বা সম্মুখভাগে সেগুলো পরিবহন করে নেওয়া প্রয়োজন। একই সঙ্গে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা রণকৌশল ও সেনা পরিচালনা কৌশলের সঙ্গে কীভাবে সেটাকে অন্তর্ভুক্ত করা যায়, সেই সমস্যাও রয়েছে।
কিন্তু ইউক্রেনের সেনানায়কেরা এখন একটা বিষয়ে সুনিশ্চিত যে তাঁদের কাছে শিগগিরই সরবরাহ পৌঁছে যাবে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে তাঁরা বাধ্য হচ্ছিলেন গোলাবারুদ রেশনিং করে ব্যবহার করতে। মার্কিন সহযোগিতা প্যাকেজে সেনাদের নৈতিক মনোবল চাঙা হবে, তাতে করে যুদ্ধক্ষেত্রের পরিস্থিতি উন্নতি হবে।
সাময়িক উপশমের চেয়ে বেশি কিছু এই সহায়তা প্যাকেজ কি সত্যি সত্যি দিতে পারবে? এটা বেশ কয়েকটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করবে। সামরিক ও অন্য কোনো উপায়ে যে সহায়তা প্যাকেজ দেওয়া হয় সেটা কতটা টেকসই হবে, এ প্রশ্নটি কেবল অর্থনৈতিক প্রশ্ন নয়। এটা রাজনৈতিক ইচ্ছারও বিষয়।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেট ঘাটতির পরিমাণ প্রায় ৩৪ ট্রিলিয়ন ডলার। প্রতি ১০০ দিনে ১ ট্রিলিয়ন ডলার ঘাটতি বাড়ছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে দীর্ঘ মেয়াদে সহযোগিতা প্যাকেজ চালিয়ে নেওয়া যাবে কি না, সেটা বড় প্রশ্ন। আর ট্রাম্প যদি দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হন, তাহলে প্রশ্নটা আরও দীর্ঘ হবে।
যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসে কয়েক মাস ধরে ইউক্রেনের সামরিক বিল আটকে থাকার পেছনে এ বছরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের হিসাব–নিকাশ কাজ করেছে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে মিশ্র ইঙ্গিত দেওয়ার পর অবশেষ গত রোববার ডোনাল্ড ট্রাম্প–সমর্থিত প্রতিনিধি পরিষদের রিপাবলিকান দলীয় স্পিকার মাইক জনসন গত রোববার ইউক্রেন বিলটি ভোটাভুটির জন্য উত্থাপন করেন। কিন্তু প্রতিনিধি পরিষদে যতজন রিপাবলিকান বিলটির পক্ষে ভোট দিয়েছেন, তার চেয়ে বেশিসংখ্যক সদস্য বিরোধিতা করে ভোট দেন।
এ ছাড়া নভেম্বর মাসের নির্বাচনের পর ট্রাম্পের হোয়াইট হাউসে ফেরার সম্ভাবনা আছে। ইউক্রেন ও দেশটির প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রতি তাঁর ব্যক্তিগত বিদ্বেষও সুপরিচিত। এই বাস্তবতার সঙ্গে ভ্লাদিমির পুতিনের প্রতি ট্রাম্পের তারিফপূর্ণ মনোভাব যুক্ত করলে ইউক্রেন ও ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের মৈত্রী অনিশ্চয়তায় পড়বে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নে ইউক্রেনের জন্য সহযোগিতা প্যাকেজ পাস করাতে নতুন সমস্যায় পড়তে হবে। এর আগে ২৭টি দেশের মধ্যে একটি দেশের সরকারপ্রধানের বিরোধিতার কারণে ইউক্রেনের জন্য নেওয়া সহযোগিতা প্যাকেজ পাস করতে সমস্যায় পড়তে হতে হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে।
তিনি হলেন রাশিয়াপন্থী হাঙ্গেরির প্রেসিডেন্ট ভিকতর ওরবান। এখন ওরবান তার নতুন বন্ধু স্লোভাকিয়ার প্রধানমন্ত্রী রবার্ট ফিকোকে পেয়েছেন। ফিকো ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দেওয়ার বিরোধিতা করেছেন। তার বদলে কিয়েভ যাতে রাশিয়ার সঙ্গে একটা মীমাংসায় পৌঁছাতে সমঝোতায় বসে, সেই পরামর্শ তিনি দিয়েছেন।
জুন মাসে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, তার মধ্য দিয়ে পার্লামেন্টে রাশিয়াপন্থী সদস্যদের বিরাট ভিড় বাড়বে। তারা ইউক্রেনকে সহযোগিতা দেওয়ার ব্যাপারে খোলাখুলি বিরোধিতা করে আসছে। যদিও অর্থায়ন তহবিল পাসে প্রভাব তৈরি করার ক্ষমতা তাদের সীমিত। কিন্তু তারা নিশ্চিতভাবেই ইউরোপীয় ইউনিয়নে ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে বিশাল সমস্যা তৈরি করবে।
এ ছাড়া রাশিয়া যেভাবে তার প্রতিরক্ষা খাত শক্তিশালী করেছে এবং ব্যাপকভাবে সামরিক সরঞ্জাম ও অস্ত্র ও গোলাবারুদ উৎপাদন বাড়িয়েছে, সেই তুলনায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সমরশিল্প গতিশীল হতে পারেনি। রাশিয়া খুব দ্রুতগতিতে তাদের অর্থনীতিকে যুদ্ধ অর্থনীতিতে রূপান্তর করতে পারার পেছনে ইরান, উত্তর কোরিয়া ও চীনের সমর্থন ও অস্ত্র-গোলাবারুদ পেয়ে আসছে।
এ ব্যাপারে একটা আস্থা তৈরি হয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ এবং একই সঙ্গে ইউক্রেনের অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ উৎপাদনের সক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে। একই সঙ্গে এ ব্যাপারে কিছু সন্দেহ তৈরি হয়েছে যে রাশিয়া কি বর্তমান গতিতে তাদের সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদন কত দিন অব্যাহত রাখতে পারবে। বিশেষ করে যখন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন চীন ও ইরানকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে রাশিয়াকে আর যাতে সামরিক সহায়তা না দেয়, সে ব্যাপারে নিরস্ত্র করেছে।
সমরশিল্পে উৎপাদন বাড়াতে পশ্চিমা দেশগুলোর সম্মিলিত প্রয়াসের বিপরীতে রাশিয়ার উৎপাদন যদি তাৎপর্যপূর্ণভাবে কমে যায়, তাহলেও কেবল খেলার গতিমুখ পাল্টে দেওয়ার মতো ঘটনা হতে পারত। কিন্তু নিকট ভবিষ্যতে সেটা ঘটা সম্ভব বলে মনে হয় না।
এ ছাড়া ইউক্রেনের তুলনায় রাশিয়া জনবলের দিক থেকে পরিষ্কারভাবে শ্রেষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে। ইউক্রেনের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়ায় এ মুহূর্তে রাশিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। রাশিয়া এখন তার বর্তমান আক্রমণের গতি দ্বিগুণ করার চিন্তা করছে।
পরিশেষে বলব, বর্তমানে ইউক্রেন পশ্চিমাদের কাছে একমাত্র প্রধান নিরাপত্তা সংকট নয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদ ইউক্রেন বিল পাস করার পাশাপাশি ইসরায়েল, তাইওয়ান ও ইসরায়েলকে সামরিক সহায়তা বিল পাস করেছে। সব মিলিয়ে ১০০ বিলিয়ন ডলারের সহায়তা প্যাকেজ।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেট ঘাটতির পরিমাণ প্রায় ৩৪ ট্রিলিয়ন ডলার। প্রতি ১০০ দিনে ১ ট্রিলিয়ন ডলার ঘাটতি বাড়ছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে দীর্ঘ মেয়াদে সহযোগিতা প্যাকেজ চালিয়ে নেওয়া যাবে কি না, সেটা বড় প্রশ্ন। আর ট্রাম্প যদি দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হন, তাহলে প্রশ্নটা আরও দীর্ঘ হবে।
কেউ কেউ বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান সামরিক সহায়তার সঙ্গে আরও সহায়তা যুক্ত হলে এক বছরের মধ্যে ইউক্রেন যুদ্ধে জিততে পারবে। কিন্তু এটা শুধু অতি আশাবাদী চিন্তা হবে না, ভয়ংকর রকম বিভ্রান্তিকর ভাবনাও হবে।
স্টেফান উলফ, বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিষয়ে অধ্যাপক
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মনােজ দে