মণিপুর, অনাস্থা প্রস্তাব ও রাজনীতির আট বিস্ময়

মণিপুরে সহিংসতা ও নারী নির্যাতনের প্রতিবাদে ভারতের বিভিন্ন স্থানে কর্মসূচি অব্যাহত রয়েছে
ছবি: এএফপি

গণতন্ত্রের জননী, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কথায় ‘মাদার অব ডেমোক্রেসি’র রাজনীতি ও ভারতের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর চরিত্র কীভাবে বদলে গিয়েছে, তার অত্যাশ্চর্য কিছু ঝলক সম্প্রতি দেখা গেল সংসদে।

মণিপুরের সহিংসতা অব্যাহত থাকা, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাজ্য ও কেন্দ্রে বিজেপির ‘ডাবল ইঞ্জিন’ সরকারের চরম ব্যর্থতা এবং সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর মুখ খোলাতে বিরোধীরা অনাস্থা প্রস্তাব আনতে বাধ্য হন। সেই প্রস্তাব ও তা নিয়ে আলোচনা বহু বিস্ময় সৃষ্টি করল, সংসদীয় ভারতের ইতিহাসে আগে যা দেখা যায়নি।

সংসদে সরকারের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত মোট ২৭ বার অনাস্থা প্রস্তাব আনা হয়েছে। প্রথমবার ১৯৬৩ সালে, জওহরলাল নেহরুর সরকারের বিরুদ্ধে সেই প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন আচার্য জে বি কৃপালনী। সরকারের পতন ঘটানোই অনাস্থা প্রস্তাবের মূল লক্ষ্য। এই প্রথম অনাস্থা প্রস্তাব আনা হলো সরকারের পতন ঘটানোর জন্য নয়, প্রধানমন্ত্রীর অস্বাভাবিক ও অযৌক্তিক মৌনতা ভাঙতে!

টানা তিন মাস ধরে (এখন ১০০ দিন অতিক্রান্ত) মণিপুর জ্বলছে, জাতিদাঙ্গায় দেড় শর বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে, ৬০ হাজার জন গৃহহীন, অগুনতি মন্দির, গির্জা ও গৃহ পুড়ে ছারখার, ৫ হাজার আগ্নেয়াস্ত্র ও ৬ লাখ কার্তুজ থানা থেকে উধাও এবং রাজ্য ও পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী নীরব থাকা শ্রেয় মনে করেছেন। কেন এই জেদ, সেই কারণও কেউ জানে না। ওই গোঁ ভাঙিয়ে সংসদে জবাবদিহিতে বাধ্য করাতেই অনাস্থার উত্থাপন। বিরোধীরা বারবার সেই উদ্দেশ্যের কথা জানিয়েও দিয়েছেন। এমন অনাস্থা জ্ঞাপন স্বাধীন ভারতের সংসদীয় ইতিহাসে কখনো ঘটেনি! সেদিক থেকে এটা অনন্য এবং অত্যাশ্চর্য!

প্রধানমন্ত্রী বাধ্য হলেন মৌনতা ভাঙতে, যদিও সৃষ্টি করলেন একের পর এক বিস্ময়! দ্বিমত নেই, মোদি সুবক্তা। বিরোধীদের বাক্যবাণে কুপোকাত করতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। কিন্তু হলফ করে বলা যায়, ২ ঘণ্টা ১৭ মিনিটের এমন ক্লান্তিকর একঘেয়েমি ভাষণ দিয়ে সম্ভবত তিনি নিজেও অবাক হয়েছেন! আজ পর্যন্ত কোনো অনাস্থা প্রস্তাবের জবাবি ভাষণে কোনো প্রধানমন্ত্রী এত সময় ব্যয় করেননি! এটা দ্বিতীয় বিস্ময় হলে তৃতীয়টি আরও চমকপ্রদ! যে কারণে প্রস্তাবের উত্থাপন, সেই ‘মণিপুর’ শব্দটি মোদি উচ্চারণ করলেন ১ ঘণ্টা ৩৯ মিনিট পর। ততক্ষণে ‘মণিপুর মণিপুর’ করে চেঁচিয়ে ক্লান্ত ও হতাশ ‘ইন্ডিয়া’ জোট প্রতিবাদী হয়ে সভা ত্যাগ করেছে!

চতুর্থ বিস্ময়টি সংসদীয় ভারতের ইতিহাসে প্রথম। সংসদের গুণগত চরিত্র পরিবর্তন হয়তো সে জন্য দায়ী।

রাজ্যটির হাল ফেরানোর দিশা কিন্তু তাঁরা দেননি। এত রক্তক্ষয়, এত সম্পত্তি হানি, হিন্দু-খ্রিষ্টানে এত ঘৃণা, সেনা-পুলিশের তীব্র সংঘাত সত্ত্বেও মুখ্যমন্ত্রী পদে বীরেন সিংয়ের টিকে থাকার রহস্য অবশ্য উদ্‌ঘাটিত। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, তদন্তে সহযোগিতা করছেন বলে মুখ্যমন্ত্রীকে সরানো হচ্ছে না। অমিত শাহর এই উক্তিই অষ্টম আশ্চর্য!

লোকসভার স্পিকার ও রাজ্যসভার চেয়ারম্যান (উপরাষ্ট্রপতি) সব সময় সরকারি দল থেকে নির্বাচিত হন। অদূর অতীতেও বহুবার তাঁরা বিরোধীদের ন্যায়সংগত দাবি মেনে নিয়েছেন। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনার জন্য মুলতবি প্রস্তাব (সভার কাজ স্থগিত রেখে ওই বিষয়ে আলোচনা) গ্রহণ করে সরকারকে আলোচনায় বাধ্য করেছেন। ২০১৪ সালে মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সংসদের চরিত্র বদলাতে থাকে।

স্পিকার ও চেয়ারম্যান হয়ে ওঠেন পুরোপুরি সরকারের আজ্ঞাবহ। প্রথা অনুযায়ী, লোকসভার ডেপুটি স্পিকারের পদটি দেওয়া হয় বিরোধীদের। সেই পদ আজও খালি! সভা পরিচালকের দলীয় আনুগত্য যত প্রকট হয়েছে, তত বেড়ে গেছে বিরোধী বিক্ষোভের চরিত্র। প্ল্যাকার্ড, পোস্টার, স্লোগান, ওয়েলে (স্পিকারের সামনের খালি অংশ) নেমে আসা এবং অধিবেশন বানচাল করা ক্রমেই নিয়ম হয়ে উঠেছে।

স্পিকার সংসদ টিভির সর্বময় কর্তা। সভাকক্ষে বিরোধীদের বিক্ষোভ দেখানো তিনি বন্ধ করে দিয়েছেন। হুট বলতে বিরোধীদের মাইকও বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। টিভির ক্যামেরা বিরোধীদের চেয়ে তাঁকে বেশি দেখায়। এসব আজ অনেক দিনই নতুন ভারতের ‘নিউ নরমাল’। কিন্তু বিস্ময়করভাবে এবারই প্রথম দেখা গেল, প্রধানমন্ত্রী লোকসভাকে রাজনৈতিক জনসভা করে তুললেন!

‘ইন্ডিয়া’ জোটকে কটাক্ষ করে তিনি স্লোগান দিলেন আর দলীয় সদস্যরা তাতে গলা মেলালেন! একবার নয়, দুবার নয়, বারবার ঘটল এই ঘটনা! পদমর্যাদা ভুলে, আত্মসম্মান ভুলে, প্রধানমন্ত্রী নিজেকে নামিয়ে আনলেন ‘চিয়ার লিডার’-এর ভূমিকায়! ৭৬ বছর বয়সী ভারতের ৭১ বছর বয়সী সংসদে কোনো প্রধানমন্ত্রীকে এই ভূমিকায় দেখা যায়নি!

অদ্ভুতভাবে এটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে ভারতের রাজনীতির বৈশিষ্ট্য ও সংসদীয় চরিত্র। বিরোধী তো অবশ্যই, সরকারপক্ষের সদস্যদেরও অসহযোগিতার দরুন ‘দুঃখিত ও ব্যথিত’ স্পিকার ওম বিড়লা দুই দিন সভা পরিচালনা না করার সিদ্ধান্ত নেন। মানভঞ্জনের পর তাঁর মন গলে। এটা পঞ্চম বিস্ময়!

সমাজের অন্যত্র যেমন, তেমনই এক অদ্ভুত অসহিষ্ণুতা ভারতীয় সংসদকেও দ্রুত গ্রাস করেছে। নইলে এক অধিবেশনে দুই কক্ষের এতজন সদস্যকে কেন সাসপেন্ড হতে হবে? স্পিকার ও চেয়ারম্যানের বিবেচনায় যাঁরা ‘দুর্বিনীত’, অনির্দিষ্টকালের জন্য তাঁদের সাসপেন্ড করতে কেন বিষয়টি সভার অধিকারভঙ্গ কমিটির কাছে পাঠানো হবে? কেন সংসদের বিধিতে নতুন রীতি জোড়া হবে?

লোকসভার বিরোধী নেতা অধীর চৌধুরীকে অনির্দিষ্টকাল সাসপেন্ড করার মধ্য দিয়ে স্পিকার বিভিন্ন সরকারি কমিটিকেও বিরোধীমুক্ত করার পথ প্রশস্ত করলেন এবং সেটা করা হয় অনাস্থা প্রস্তাব কণ্ঠভোটে পাস হওয়ার পর সরকারের চাপে।

শুধু তা-ই নয়, সভার কার্যবিবরণী থেকে সরকারের ‘অপছন্দের ও আপত্তিকর’ শব্দ মুছে দেওয়ার প্রতিযোগিতাও যেন শুরু হয়েছে। মোদি জমানার আগে এমন কিন্তু কখনো দেখা যায়নি। এমন পাইকারি হারে ভাষণ ছাঁটাই আগে হয়নি!

এ বছরের বাজেট অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে শিল্পপতি গৌতম আদানির সম্পর্ক নিয়ে রাহুল গান্ধী কয়েকটা প্রশ্ন তুলেছিলেন। কেন তিনি আদানির বিমানে চাপতেন; কেন প্রধানমন্ত্রীর সব সফরে আদানিকে দেখা যেত এবং বাংলাদেশ, অস্ট্রেলিয়া, শ্রীলঙ্কায় আদানিকে শিল্প বরাত পাইয়ে দিতে তিনি প্রভাব খাটিয়েছেন কি না ইত্যাদি। প্রধানমন্ত্রী একটি প্রশ্নেরও উত্তর দেননি।

পরের দিনই দেখা গিয়েছিল, রাহুলের ভাষণ থেকে আদানি প্রসঙ্গ পুরো মুছে দেওয়া হয়েছে। মোট ১৮টি জায়গা বাদ দেওয়া হয়েছিল। এবারও রাহুলের ভাষণ থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে ‘ভারতমাতা’কে হত্যার বিষয়গুলো! রাহুল বলেছিলেন, মণিপুরে ভারতের অন্তরাত্মাকে খুন করা হয়েছে। হত্যা করা হয়েছে ভারতমাতাকে। প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে তিনি বলেছিলেন, আপনি ‘দেশদ্রোহী’। দেশভক্ত নন। দেশপ্রেমিক নন। ভারতমাতার সঙ্গে দেশদ্রোহী শব্দও মুছে দেওয়া হয়েছে। এসব ষষ্ঠ বিস্ময়!

সপ্তম আশ্চর্যের কেন্দ্রে রয়েছেন মণিপুরের দুই লোকসভা সদস্য। একজন বিজেপির। রাজকুমার রঞ্জন সিং। তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী। রাজধানী ইম্ফলে তাঁর বাড়ি এই হিংসায় জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। খোদ প্রধানমন্ত্রীকে তিনি জানিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রীর চূড়ান্ত ব্যর্থতার কথা।

অন্যজন বিজেপির সহযোগী দল এনপিএফের লর্হো এস ফোজে। দুজনই ভূমিপুত্র। দুজনই উন্মুখ ছিলেন বিতর্কে অংশ নিয়ে ‘রাজ্যের প্রকৃত চিত্র’ তুলে ধরতে। কিন্তু কী আশ্চর্য, যে রাজ্য নিয়ে এত আলোচনা, সেখানকার ভূমিপুত্ররাই অবহেলিত হলেন! বারবার দরবার সত্ত্বেও তাঁদের বলতে দেওয়া হয়নি! অথচ বিতর্ক চলেছে তিন দিন। প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী খরচ করেছেন সাড়ে চার ঘণ্টা!

রাজ্যটির হাল ফেরানোর দিশা কিন্তু তাঁরা দেননি। এত রক্তক্ষয়, এত সম্পত্তি হানি, হিন্দু-খ্রিষ্টানে এত ঘৃণা, সেনা-পুলিশের তীব্র সংঘাত সত্ত্বেও মুখ্যমন্ত্রী পদে বীরেন সিংয়ের টিকে থাকার রহস্য অবশ্য উদ্‌ঘাটিত। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, তদন্তে সহযোগিতা করছেন বলে মুখ্যমন্ত্রীকে সরানো হচ্ছে না। অমিত শাহর এই উক্তিই অষ্টম আশ্চর্য!

  • সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি