গত কয়েক দশকে দেশের সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলো থেকে শিল্পকারখানার নামে, ব্যবসা-বাণিজ্যের নামে হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে, সেই ঋণ পরিশোধ করা হয়নি। অন্যদিকে শিল্পায়ন এবং কর্মসংস্থানও আশানুরূপ হয়নি। এর জন্য দায়ী যে উন্নয়নদর্শন বা নীতি, তা নিয়ে লিখেছেন মাহা মির্জা
ঢাকার হকারদের দিকে একটু মনোযোগ দিয়ে তাকালে ঘাবড়ে যাই। এত খর্বকায়, এত শীর্ণ, মলিন। কী ভীষণ আকুতি নিয়ে গাড়ির পেছনে দৌড়ায়। কেউ তোয়ালে, কেউ বেলুন, কেউ খেলনা বা চাবির রিং, কেউ দোলনচাঁপা নিয়ে। ৪০ ডিগ্রি তাপপ্রবাহে রাস্তার মোড়ে মোড়ে তাঁদের জীবনসংগ্রাম চলে।
এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এক অমানবিক উচ্ছেদ মিশন চালিয়েছে। ধানমন্ডি ও লালমাটিয়া এলাকার সবজি ভ্যান, টংদোকান, তরমুজওয়ালা, ফুটপাতের কাপড় বিক্রেতা—সবাইকে তাড়িয়েছে।
এই শহরে টং থাকবে না, ভ্যান থাকবে না, ডাবওয়ালা থাকবেন না, বিসমিল্লাহ ভাতের হোটেল থাকবে না, মায়ের দোয়া হালিম থাকবে না, মন্টু ফার্নিচার থাকবে না, ভাই ভাই থাকবে না, মামা–ভাগনে থাকবে না; থাকবে শুধু মহীশুর সিল্ক, জাপানিজ কিচেন, প্রাডোর শোরুম।
এই শহর কয়েক শ বিএমডব্লিউ পার্কিংয়ের জায়গা বের করে দেবে, কিন্তু ফুচকাওয়ালার জন্য দুই ফুট জায়গা ছাড়তে গিয়ে মাসে মাসে উচ্ছেদ করবে।
কেউ প্রশ্ন করবে না, ঢাকা শহরে এত হকার, এত রিকশাচালক এলেন কী করে? তাঁরা কারা? তাঁরা হুড়হুড় করে কোথা থেকে এসে জড়ো হচ্ছেন রাজধানীতে? উন্নয়নের দেশে কাজ নেই কেন?
ভারত স্বাধীন হওয়ার পর নেহরুর প্রবল আগ্রহ ছিল ভারী শিল্পায়নে। পঞ্চাশের দশকে ভারতজুড়ে অবকাঠামো নির্মাণের চিন্তা মাথায় রেখেই গড়ে উঠেছিল দুর্গাপুর স্টিল মিল বা চিত্তরঞ্জন রেল ইঞ্জিন কারখানার মতো শক্তিশালী শিল্প। সবই রাষ্ট্রীয় মালিকানায়।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানিদের ফেলে যাওয়া মিলগুলোর রাষ্ট্রায়ত্তকরণ করা হলো। সত্তর-আশির দশকে সারা দেশে অসংখ্য সরকারি মিল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। পাটকল, কাগজকল, টেক্সটাইল মিল, স্পিনিং মিল, রাইস মিল, অয়েল মিল, সুতার কারখানা, চিনিকল তো ছিলই, আরও ছিল জাহাজ মেরামত কারখানা, রি-রোলিং কারখানা, সাইকেল, সিলিং ফ্যান আর ডিজেল ইঞ্জিনের কারখানা, রং ও কেমিক্যালের কারখানা।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, নেহরুর স্থানীয় শিল্পায়ন বা জাতীয় সক্ষমতার ‘ভিশন’ আমাদের ছিল না। সত্তর দশকে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে দুর্নীতির প্রকোপ বাড়ে। যদিও পাবলিক মিলগুলোর দুর্নীতির কথাই প্রচার করা হয়; কিন্তু সত্যটি হলো দুর্নীতির অন্যতম ভাগীদার ছিল দেশের প্রাইভেট শিল্প গ্রুপগুলো (এ সময় সরকারির তুলনায় বেসরকারি খাতে বরাদ্দকৃত ঋণের পরিমাণ প্রায় ১৭ গুণ বেশি ছিল)।
স্বাধীনতার এক দশকের মধ্যেই দেশের বড় শিল্প গ্রুপগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়! ১৯৮২ সালে সাপ্তাহিক একতায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘কোটি কোটি টাকা ঋণ গ্রহণের পর ৪ হাজার শিল্প লা-পাত্তা’। অর্থাৎ শিল্পের নামে ঋণ নিয়ে হাপিশ করে দেওয়া হয়েছে।
আশির দশকে বিশ্বব্যাংক পলিসি ধরিয়ে দিল—পাবলিক কলকারখানা বন্ধ করো, রপ্তানিমুখী শিল্প তৈরি করো, কৃষি থেকে ভর্তুকি কমাও, সার, বীজ, সেচ থেকে ভর্তুকি সরালে কৃষি থেকে শ্রমিক ‘রিলিজ’ হবে (ছাড়া পাবে)। সেই শ্রমিক চাকরি পাবেন রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানায়। সরকারি কলকারখানার ছাঁটাই হওয়া শ্রমিকও পোশাক কারখানায়ই কাজ পাবেন।
এরপর কৃষিতে শুরু হলো বিপর্যয়। সরকারি ক্রয়কেন্দ্র নেই, হিমাগার নেই, আলু-সবজি পচে যায়। কৃষি উপকরণের খরচ বাড়ল, গ্রামীণ অর্থনীতি দিন দিন দুর্বল হলো। গ্রাম থেকে শহরে আসা মানুষের সংখ্যা বাড়তে লাগল।
নব্বইয়ের দশকে বিপুলসংখ্যক পোশাক কারখানা গড়ে উঠল। ৪০ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হলো। পোশাক কারখানার মালিকেরা সস্তা শ্রমিক কাজে লাগিয়ে দ্রুত ধনী হলেন।
২০১৬ সাল থেকে শুরু হলো লাগাতার অটোমেশন। শুরু হলো ছাঁটাই। ‘শিল্পপতি’ ভর্তুকি পেলেন, ২৫ বছর ধরে ট্যাক্স মওকুফ পেলেন, সহজ শর্তে ঋণ পেলেন, বারবার খেলাপি ঋণের পুনঃ তফসিল হলো, কিন্তু মুনাফার টাকা পুনর্বিনিয়োগ হলো না; বরং বিদেশে পাচার হয়ে গেল। নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হওয়া বন্ধ হলো।
রপ্তানিমুখী শিল্পায়নের প্রতিশ্রুতি ছিল কৃষি থেকে উচ্ছেদ হওয়া কৃষককে সে চাকরি দেবে। অথচ শূন্য দশক থেকেই সতর্কবার্তা ছিল যে অটোমেশনের হার বাড়বে, পোশাক কারখানা হোক বা অন্য কোনো ভারী শিল্প হোক, আগের মতো আর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না। হয়েছেও তা-ই।
শেষ পর্যন্ত গাজীপুর, টঙ্গী, আশুলিয়ার শত শত সোয়েটার কারখানা থেকে ছাঁটাই হওয়া শ্রমিক, সরকারি কলকারখানা থেকে ছাঁটাই হওয়া শ্রমিক, কৃষি থেকে উচ্ছেদ হওয়া শ্রমিক—সবাই দলে দলে অটোরিকশাচালক হয়েছেন অথবা ঢাকার রাস্তার হকার।
ব্যাংকের টাকায় বাজেট হয়, কলকারখানা হয়, ‘ডেভেলপমেন্ট’ হয়, রাস্তা হয়, উড়ালসড়ক হয়, মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। অথচ গত কয়েক দশকে দেশের সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলো থেকে শিল্পকারখানার নামে, ব্যবসা-বাণিজ্যের নামে হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে, সেই ঋণ পরিশোধ করা হয়নি।
নব্বইয়ের দশকে আদমজী বন্ধের মধ্য দিয়ে সরকারি কলকারখানাগুলো বন্ধ করা শুরু হয়েছিল। ২০২০ সালে তড়িঘড়ি বন্ধ করা হলো দেশের শেষ ২৬টি পাটকল ও ৯টি চিনিকল। দক্ষিণের ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল বেল্ট’, স্থানীয় অর্থনীতি—সব শেষ।
বছরে ২০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হয়, এই অজুহাতে রাষ্ট্রীয় মিলগুলো বন্ধ করা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত লোকসানি মিল বন্ধ করে কত টাকা বাঁচাল সরকারি ব্যাংক?
শেষ খবর অনুযায়ী, জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩০ হাজার কোটি টাকা, অগ্রণী ব্যাংকের ২০ হাজার কোটি এবং সোনালী ব্যাংকের ১৪ হাজার কোটি টাকা। রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৮৪ হাজার কোটি টাকা।
সরকারি পাটকলকে ২০০ কোটি টাকা দেওয়া গেল না অথচ রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক দেশের শীর্ষ ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানটিকে ঋণ দিয়েছিল ২২ হাজার কোটি টাকা! দেশের শীর্ষ চার ধনীকে ‘বিশেষ বিবেচনায়’ ২১ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছিল ইসলামী ও জনতা ব্যাংক।
রিকশাচালক বা হকার রংঢং করতে ঢাকা শহরে আসেন না। গ্রামে কাজ না থাকার কারণে, কৃষি থেকে ভর্তুকি সরানোর কারণে, পোশাক কারখানা থেকে ছাঁটাই হওয়ার কারণে, পোশাক কারখানার মুনাফা পুনর্বিনিয়োগ না হওয়ার কারণে এবং ব্যাংকের টাকা বিদেশে পাচার হওয়ার কারণে তৈরি হয় ‘ইনফরমাল’ খাত। বাজেটের টাকা শীর্ষ ধনীদের অ্যাকাউন্টে চলে যাওয়ার সুব্যবস্থা আছে বলেই শিল্পায়ন বা কর্মসংস্থান—কোনোটাই আর হয়ে ওঠেনি এ দেশে।
এই যে দেশের শীর্ষ ধনীরা হাজার কোটি টাকা ঋণ পেলেন, এখান থেকে অর্থনীতির প্রাপ্তি কী? এই টাকা কি অর্থনীতিতে ঘুরছে? কলকারখানা সৃষ্টি হচ্ছে?
বাংলাদেশ ‘লেবার ইনটেনসিভ’ দেশ। অর্থাৎ অতিরিক্ত শ্রমিকের দেশ। আমাদের অগ্রাধিকার হবে কর্মসংস্থান তৈরি। সেটা কৃষিতে হোক, শিল্পে হোক, সরকারি সেবায় হোক। যে কর্ম সৃষ্টি করবে, সে ঋণ পাবে, ভর্তুকি পাবে।
সোনালী, রূপালী, জনতা ব্যাংকের ৮৪ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ মানে দেশের বাজেটের ৯ ভাগের ১ ভাগ! এই টাকা নেওয়া হয়েছে শিল্পায়নের নামে। অথচ এই টাকায় উৎপাদন হয়নি, শিল্পায়ন হয়নি, গ্রামীণ অর্থনীতিতে কর্ম সৃষ্টি হয়নি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশও হয়নি। পাটশিল্প, কাগজশিল্প, তাঁতশিল্প, চিনিশিল্প ধুঁকছে; অথচ শিল্পায়নের নামে লুটপাট হয়ে গেছে জনগণের লাখো কোটি টাকা।
শেষ পর্যন্ত কোটি মানুষের ঠাঁই হয়েছে ইনফরমাল (অপ্রাতিষ্ঠানিক) খাতে। লাখে লাখে হকার। লাখে লাখে অটোরিকশা। লাখে লাখে সবজি ভ্যান, ফুটপাতের চা বিক্রেতা। তাঁরা ব্যাংক থেকে টাকা মারেননি। ধারদেনা করেছেন, শরীরের রক্ত পানি করা পরিশ্রম দিয়ে কিস্তি শোধ করছেন, পুলিশকে মোটা অঙ্কের চাঁদা দিয়ে শহরের রাস্তায় টিকে থাকার লড়াই করছেন।
এসব লোককে আমরা কিছুতেই মানতে পারছি না। আমাদের উন্নয়ন ‘ফ্রেমওয়ার্কে’র মধ্যে হকার ‘ফিট’ করে না। অর্থনীতিবিদ ও এনজিওওয়ালাদের বিদেশি টাকার ‘টেকসই উন্নয়নে’র আলোচনায় অটোরিকশা ‘ফিট’ করে না। ডিজিটাল বিপ্লবের বিজ্ঞাপনে পাঁচ লাখ ‘ম্যানুয়াল’ ছুটা বুয়ার জায়গা নেই।
মধ্যবিত্ত প্রতিনিয়ত তাঁদের ‘সার্ভিস’ গ্রহণ করে, কিন্তু স্বীকৃতি দেয় না। সরকার ও বড় ব্যবসায়ীরা মিলেমিশে তাঁদের ঠেলতে ঠেলতে শহরের বাইরে পাঠিয়ে দেন। দক্ষিণ এশিয়ার সর্বোচ্চ খরচের শহরে হকার, বুয়া, অটোরিকশা ক্রমাগত উচ্ছেদ হতে থাকে।
আমাদের শেখানো হয়েছে, মেগা প্রকল্পই উন্নয়ন। জনগণের টাকায় সর্বোচ্চ খরচে মেগা প্রকল্প হয়েছে। পদ্মা সেতু, এলিভেটেড হাইওয়ে, মেট্রোরেল। অথচ কয়টা স্থানীয় কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে?
পদ্মা সেতু নির্মাণের সময় বলা হয়েছিল দক্ষিণাঞ্চলে শিল্পায়নের জোয়ার বয়ে যাবে। হাজারটা কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। অথচ পদ্মা সেতু হওয়ার বহু আগের থেকেই দক্ষিণের পাটকলগুলো ঘিরে লাখো মানুষের কর্মসংস্থান ছিল। সেতু চালু হওয়ার আগেই সব হাওয়া হয়ে গেল। তার মানে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে ৩০ হাজার কোটি টাকার পদ্মা সেতু লাগে না। শিল্পায়নের নিয়ত লাগে। পলিসি লাগে।
দুই বছর হলো পদ্মা সেতু হয়েছে। কই, নতুন নতুন চাকরি সৃষ্টি হলো?
জনগণের করের টাকায় ২৬ হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি হয়েছিল। অথচ অর্ধেক সক্ষমতাই অকেজো বসে থাকে। (এর মধ্যে আদানিকেই বসিয়ে বসিয়ে ‘ভাড়া’ দিতে হয় বছরে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। ১৪ বছরে সিঙ্গাপুরভিত্তিক একটি বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান পেয়েছে ১২ হাজার কোটি টাকা!)
এভাবে দেশের বিদ্যুৎ খাতটিকে কয়েকটি ধনী গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। ‘প্রাইভেট অ্যাকাউন্টে’ টাকা সরবরাহ করতে গিয়ে ঋণের পাহাড় জমেছে (বর্তমানে পিডিবির বকেয়া বিল ৫ বিলিয়ন ডলার!)। অথচ এই পরিমাণ পুঁজি, এই পরিমাণ বিদ্যুৎ দিয়ে তো শিল্পায়নের জোয়ার বয়ে যাওয়ার কথা ছিল। জেলায় জেলায় না ‘ইপিজেড’ হওয়ার কথা ছিল?
হয়েছে? লাখ লাখ বাদ দিলাম, হাজারটা চাকরিও সৃষ্টি হয়েছে?
খেয়াল করুন, দেশের ইপিজেডগুলো (রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল) প্রচুর বিদ্যুৎ নিচ্ছে, কিন্তু নতুন চাকরি সৃষ্টি করছে না, বরং ছাঁটাই করছে।
হুন্দাইয়ের মতো গাড়ি সংযোজন কারখানা মারাত্মক বিদ্যুৎ অপচয়কারী অথচ কয়টা চাকরি সৃষ্টি করেছে? মাত্র ৩০০! ভারী শিল্পে একসময় আর শ্রমিক লাগবে না—এটা বহু আগের সতর্কবার্তা।
অথচ মাঝখান থেকে ‘বিদ্যুৎ চোর’ নামে খ্যাত অটোরিকশা খাতটি অর্ধকোটির বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে ফেলেছে। দেশীয় মেকানিকরাই তৈরি করছেন অটোরিকশার যাবতীয় পার্টস—হুড, বডি, সিট, চাকা, বেল, প্যাডেল। জেলায়-উপজেলায় গড়ে উঠেছে মেরামতের কারখানা, ওয়ার্কশপ, টায়ারের দোকান।
আমাদের মতো ‘সারপ্লাস’ শ্রমিকদের দেশে বিদ্যুৎ কোথায় খরচ হওয়া উচিত? শ্রমিকবিহীন ‘অ্যাসেম্বলি লাইন’ চালাতে? নাকি অসংখ্য শ্রমিকের জীবিকা তৈরি করতে? ২৬ হাজার মেগাওয়াট দিয়ে তো শিল্পায়নই হওয়ার কথা ছিল। কর্মসংস্থান হওয়ার কথা ছিল। অপ্রত্যাশিতভাবে সেই কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে অটোরিকশা খাতে।
আরেক দিকে হকারি করে জীবন চালাচ্ছেন কয়েক লাখ মানুষ। সেটাও এক কিলোওয়াট বাড়তি বিদ্যুৎ খরচ না করে।
সরকার চেষ্টা করেনি, মেগা প্রকল্প পারেনি, কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালাতে শতকোটি ডলার বেরিয়ে যাচ্ছে, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব দিয়ে কোটি কোটি গ্রামীণ বেকারের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে—এমন সম্ভাবনাও নেই।
এ অবস্থায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে কোথায়? আমার ৮৬ ভাগ মানুষ কোন খাতে কাজ করে? শুনতে অস্বস্তি হয়, কিন্তু বাস্তবতা হলো রিকশা, অটোরিকশা, হকার, সবজি ভ্যান, দোকানদার, খেতমজুর, দরজি, মিস্ত্রি, ঠিকা বুয়া—তাঁরাই আমাদের মূলধারার কর্মসংস্থান। এসব কর্মসংস্থান ‘ডিসেন্ট্রালাইজড’ অর্থাৎ সারা দেশে ছড়িয়ে আছে।
রিকশাচালক বা হকার রংঢং করতে ঢাকা শহরে আসেন না। গ্রামে কাজ না থাকার কারণে, কৃষি থেকে ভর্তুকি সরানোর কারণে, পোশাক কারখানা থেকে ছাঁটাই হওয়ার কারণে, পোশাক কারখানার মুনাফা পুনর্বিনিয়োগ না হওয়ার কারণে এবং ব্যাংকের টাকা বিদেশে পাচার হওয়ার কারণে তৈরি হয় ‘ইনফরমাল’ খাত। বাজেটের টাকা শীর্ষ ধনীদের অ্যাকাউন্টে চলে যাওয়ার সুব্যবস্থা আছে বলেই শিল্পায়ন বা কর্মসংস্থান—কোনোটাই আর হয়ে ওঠেনি এ দেশে।
কয়েক দশকের ধারাবাহিক পলিসি ব্যর্থতা এবং ব্যাংকের টাকা লোপাটের কাহিনি বাদ দিয়ে দুই দিন পরপর অটোরিকশা আর হকার উচ্ছেদ করলেই শহরমুখী অজস্র কর্মহীন মানুষের ঢল ঠেকানো যাবে?
মাহা মির্জা গবেষক