মতামত

ইরাকে ‘অনার কিলিংয়ের’ শিকার ইউটিউব তারকা: আমাদের বাস্তবতা কী

পরিবারের হাতে হত্যার শিকার ২২ বছর বয়সী তিবা আলআলী। এ ঘটনার প্রতিবাদে ইরাকে নারীদের বিক্ষোভ
ছবি: টুইটার থেকে সংগৃহীত

‘পরিবারের সম্মান রক্ষায়’ ইউটিউব তারকা মেয়েকে হত্যা করেছেন তাঁর বাবা। এ নিয়ে ইরাকে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। ২২ বছর বয়সী তিবা আলআলী ছিলেন জনপ্রিয় একজন ইউটিউব তারকা। তবে তিবার পরিবার তাঁর জীবনযাপন পছন্দ করত না। পরিবার মনে করত, এই মেয়ের কারণেই তাদের সম্মানহানি হচ্ছে। তাই পরিবারের সম্মান রক্ষার নামে তাঁকে হত্যা (অনার কিলিং) করা হয়েছে। পুলিশের পক্ষ থেকে বিরোধ নিষ্পত্তির চেষ্টা করা হলেও কোনো কাজ হয়নি। অবশেষে তিবার বাবা তাঁকে হত্যা করেন। ইরাকের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের টুইট বার্তা, আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ও মানবাধিকার সংগঠনের মাধ্যমে এ ঘটনা আমরা জানতে পারছি।

তিবার মৃত্যুর ঘটনার প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন দেশটির সাধারণ মানুষ, রাজনীতিক ও মানবাধিকারকর্মীরা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোয় সমালোচনার ঝড় উঠেছে। দেশটির মানুষ বাবার হাতে মেয়ের মৃত্যুর ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ জানাচ্ছেন।

কিন্তু কেন পরিবারের সদস্যরাই ‘সম্মান রক্ষার নামে’ একজন নারীকে হত্যা করেন বা আত্মহত্যায় প্ররোচনা দিয়ে থাকেন? অনেক কারণের মধ্যে সবচেয়ে বড় কারণ নারীর কুমারীত্ব। এটিই সমাজে নারীর সম্মানের মূল। ধর্ম, জাত ও শ্রেণিভেদে নারীকে মনে করা হয় পরিবারে পুরুষের অধীন। নারীর ভাগ্য কী হবে, সেটা নির্ধারণ করবে পুরুষই। এই সংস্কৃতিতে নারীর শরীর, মন ও ইচ্ছার ওপর তার নিজের কোনো অধিকার নেই। এখানে নারীর স্বাধীনতাকে পরিবারের জন্য হুমকি হিসেবে দেখা হয়। অবশ্য সাধারণ মানুষ পারিবারিক সহিংসতাকে এখনো নিছক পারিবারিক, ধর্মীয় ও সামাজিক আইন ভঙ্গের দায়ে অপরাধ বলে মনে করে।

আলা তালাবানি নামের ইরাকের একজন বর্ষীয়ান রাজনীতিক টুইটারে লিখেছেন, ‘পশ্চাৎপদ ধ্যানধারণা থেকে আমাদের সমাজের নারীদের জিম্মি করে রাখা হয়েছে। কারণ, এসব থেকে নারীদের রক্ষায় আইন বা সরকারি কোনো পদক্ষেপ নেই। ক্রমে বাড়তে থাকা পারিবারিক সহিংসতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ আইন দেশে নেই।’

অনার কিলিং সম্পর্কে সংবাদটি পড়ার পর ‘ডার্ক চকলেট’ নামে একটি মুভির কথা মনে হলো। একটি মেয়ে কীভাবে তার সৎবাবার দ্বারা দিনের পর দিন পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে এবং একপর্যায়ে সে পালাতে চেয়েও পারেনি। মা এই নির্যাতনের কথা জানলেও সমাজের ভয়ে কোথাও মুখ খুলতে দেয়নি মেয়েকে এবং নিজেও মুখ খোলেনি। ফলস্বরূপ মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ল এবং শেষ অবধি নির্যাতনের শিকার মেয়েটি একজন ক্লিনিক্যাল অপরাধীতে পরিণত হয়।

বাস্তবে আমাদের অনেক মেয়ে এভাবেই তাঁর গৃহে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। কিন্তু সমাজের ভয়ে, পরিবারের সম্মান রক্ষার জন্য মেয়েটিকে বাধ্য করা হয় একটি নোংরা পরিবেশে জীবন যাপন করতে। পরিবারের ভেতরে যৌন নির্যাতনের শিকার মেয়েগুলো কখনো মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন, কখনো আত্মহত্যা করেন, কখনোবা মুখ বন্ধ করেই একদিন মারা যান। এসব মেয়ের সবাই মূলত অনার কিলিংয়ের শিকার, তবে সরাসরি নয়, একটু অন্যভাবে। অনেকে আবার নির্যাতনের কথা গোপন করে অপমানজনকভাবে জীবনও কাটিয়ে দিচ্ছেন। অনেকে নির্যাতনের শিকার হয়ে মারাও যান। কিন্তু মুখ খুলতে পারেন না, কারণ সমাজে পরিবারের সম্মান ক্ষুণ্ন হবে। কোনো কোনো সংসারে সবাই মিলে পরিবারের কালো বা প্রতিবন্ধী মেয়েটিকে হেনস্তা করে। বিয়ে হয় না বলে গালাগালিও করে, এ কারণে মেয়েটি একসময় আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন।

পরিবারের লোকেরাই অনার কিলিং ইস্যুতে এই হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের পরিকল্পনা করেন। একে পারিবারিক আদালতের বিচারও বলা যায়। শুধু হত্যা নয়, অ্যাসিড নিক্ষেপ, অপহরণ, যৌন হয়রানি, মারধর—সবই ঘটে পারিবারিক সম্মান রক্ষার নামে। হয়তো সরাসরি কোনো মেয়েকে মারা হলো না, কিন্তু তাঁকে যদি আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা হয়, তখনো সেটা এই একই অপরাধ।

মাদারীপুর সদর উপজেলায় অষ্টম শ্রেণিতে পড়া একটি মেয়েকে অপহরণ করে ধর্ষণ করা হয়েছিল। এরপর গ্রাম্য সালিসে বিচার করে মেয়েটির অমতেই ধর্ষকের সঙ্গে তার বিয়ে দেওয়া হলো। সালিসকারীরা মনে করেছেন, এতে মেয়েটির ‘পরিবারের সম্মান রক্ষা’ হবে। অথচ আমরা জানি, ধর্ষণ ও অপহরণের কোনো সালিস হয় না। এ ঘটনাকে আমরা কী বলব?

বছর দুয়েক আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলায় পূর্বপরিকল্পিতভাবে এক কিশোরীকে তার বাবা, বড় ভাই ও মামা মিলে হত্যা করেছেন। বাড়ির পাশের পাটখেতে প্রেমিকের সঙ্গে আপত্তিকর অবস্থায় তাকে দেখা গেছে—এ অপরাধে হত্যা করে ডোবায় ফেলে দেওয়া হয়। অভিযুক্তরা স্বীকার করেছেন, ‘পরিবারের সম্মান রক্ষার’ জন্যই তাঁরা মেয়েটিকে সবাই মিলে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

ছেলেরাও হতে পারে এর শাস্তির ভিকটিম। যেমন সাতক্ষীরার গৃহস্থ পরিবারের একটি মেয়ে একজন দলিত ছেলেকে বিয়ে করায় মেয়েটির পরিবার মনে করে, এতে তাদের সম্মান নষ্ট হয়েছে। তারা ছেলেটিকে মারধর করে জোর করে তালাক আদায় করে এবং ছেলেটিকে হত্যার হুমকি দিয়ে পরিবারসুদ্ধ গ্রামছাড়া করে।

সাধারণত পরিবারের লোকেরাই অনার কিলিং ইস্যুতে এই হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের পরিকল্পনা করেন। একে পারিবারিক আদালতের বিচারও বলা যায়। শুধু হত্যা নয়, অ্যাসিড নিক্ষেপ, অপহরণ, যৌন হয়রানি, মারধর—সবই ঘটে পারিবারিক সম্মান রক্ষার নামে। হয়তো সরাসরি কোনো মেয়েকে মারা হলো না, কিন্তু তাঁকে যদি আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা হয়, তখনো সেটা এই একই অপরাধ।

কাজ করতে গিয়ে বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন অনেক কেসস্টাডি পেয়েছে, যা একজন মানুষের জন্য অবমাননাকর। হিজড়া হওয়ার দায়ে মা-বাবা সন্তানকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছেন। একজন মা একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ছোটবেলায় যদি তিনি বুঝতে পারতেন যে তাঁর সন্তানটি হিজড়া, তাহলে তখনই তিনি গলা টিপে মেরে ফেলতেন। ধামরাইতে হিজড়াপল্লিতে থাকা একজন হিজড়া বলেছেন, তাঁর বাসায় তাঁকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র টের পেয়ে তিনি পালিয়ে এসেছেন। কারণ, তাঁর মা-বাবা তার এই মেয়েলি স্বভাবের জন্য গ্রামে মুখ দেখাতে পারছিলেন না। এই আচরণকে আমরা ‘অনার কিলিং’ ছাড়া আর কী বলতে পারি?

অনার কিলিং আমাদের সমাজে ছিল এবং আছে। সমাজের ভয়ে মেয়েকে পড়তে না দেওয়া, স্বাধীনভাবে বেড়াতে না দেওয়া, হাসতে না দেওয়া, জোরগলায় কথা বলতে না দেওয়া, পোশাকের ব্যাপারে কড়াকড়ি করা, নিজের পছন্দে বিয়ে করতে না দেওয়া—এসবই নির্যাতন। বিয়ের পর দুঃখ-কষ্ট, নির্যাতন-নিপীড়ন যা-ই হোক, সেই স্বামীর কাছেই মেয়েকে থাকতে বাধ্য করা হয়। এভাবে মেয়েটি একদিন নিজের গলায় দড়ি দিতে বাধ্য হন অথবা স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির লোকের হাতে নিহত হন। শুধু পরিবারের সম্মানের কথা ভেবেই এ রকম একটা জীবনকে তাঁর মেনে নিতে হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রুমানা মঞ্জুরের ক্ষেত্রে দেখেছি পরিবারের সম্মান রক্ষার মাশুল কতটা দিতে হয়েছে তাঁকে। প্রকৌশলী বেকার স্বামী নিয়মিত রুমানাকে তাঁর বাবার বাসাতেই নির্যাতন করতেন। নির্যাতনের একপর্যায়ে যখন রুমানার চোখ একেবারে নষ্ট হয়ে যায় এবং স্বামী তাঁকে প্রাণে মেরে ফেলার অবস্থায় নিয়ে যান, তখন ঘটনাটি সামনে আসে। রুমানার বাবাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, কেন এত দিন ওনারা এই অত্যাচার নিয়ে মুখ খোলেননি? পরিবার থেকে বলা হয়েছিল, ‘নিজেদের সম্মানের কথা ভেবে’ এটা নিয়ে এত দিন উচ্চবাচ্য করেননি তাঁরা।

ইরাকের ইউটিউব তারকা তিবার হত্যাকাণ্ড বা অনার কিলিংয়ের ঘটনায় এসব ভাবনা তৈরি হয়। এর ফলে আমরা দেখতে পাই, নিজেদের সম্মান রক্ষার্থে অনেক পরিবারে মেয়েরা কীভাবে নির্যাতনের শিকার হন, এমনকি প্রাণও হারাতে হয়। বিষয়টি নিছক পারিবারিক সহিংসতা হিসেবে দেখলে নারীর ওপর নিপীড়ন ও নির্যাতন কখনো কমবে না।

  • শাহানা হুদা সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন