চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়: এক হাজার অজ্ঞাতনামা আসামি কেন 

‘সেদিন রাতে যারা ভাঙচুর চালিয়েছে ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতি করেছে, তাদের শাস্তি হোক—এটা আমরা চাই।’
ছবি: ফেসবুক থেকে সংগৃহীত

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে বুঝেছিলাম, এখানে পড়ার চেয়ে চড়ার ব্যাপারটা বেশি। শহর থেকে ক্যাম্পাসে যাতায়াতের জন্য যে শাটল ট্রেন চলত, তার গতির সঙ্গে কেবল প্যাডেলচালিত রিকশা বা অযান্ত্রিক যানই তুলনীয়। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের মাত্র দুই মাসের মাথায় এক সহপাঠী বন্ধুকে ট্রেন থেকে পড়ে মারা যেতে দেখেছিলাম। শিক্ষাজীবন শেষ করার আগে আরও বেশ কয়েকজন সতীর্থের দুঃখজনক মৃত্যুর সাক্ষী হতে হয়েছিল আমাদের। এসব প্রায় ৪০ বছর আগের ঘটনা। এরপর কর্ণফুলীতে কত পানি গড়িয়ে গেল; কিন্তু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের দুর্ভাগ্যের আর অবসান হলো না। 

শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে, নতুন অনেক বিভাগ খোলা হয়েছে। বহুতল ভবনও হয়েছে অনেক। কিন্তু তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যেন বেড়েছে যাতায়াতের দুর্ভোগ। এর মধ্যে শাটল ট্রেনে ছিনতাই, ছুরিকাঘাত থেকে শুরু করে যৌন নিপীড়নের ঘটনা পর্যন্ত ঘটে গেছে। কিন্তু প্রকৃত দোষী ব্যক্তিকে শনাক্ত করে বিচারের আওতায় আনা গেছে—এমন দৃষ্টান্ত বিরল। যার প্রতিক্রিয়ায় শিক্ষার্থীরা তাদের ক্ষোভ উগরে দিয়েছে কখনো ট্রেনের কামরা ও স্টেশন ভাঙচুর করে, কখনোবা ট্রেনের নিরীহ চালক–সহকারীকে মারধর করে।

তবে ৭ সেপ্টেম্বর মধ্যরাতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যে ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাল, তা রীতিমতো বিস্ময়কর! সেদিন রাতে শাটল ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে ১৬ জন ছাত্র গুরুতর আহত হয়, তাদের মধ্যে তিনজনের এখনো চিকিৎসা চলছে। দুর্ঘটনায় এক বা দুজন নিহত হয়েছে বলে গুজব ছড়িয়ে পড়লে ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবহন পুলের অন্তত ৬৫টি গাড়ি ভাঙচুর চালায়। উপাচার্যের বাসভবন, শিক্ষক ক্লাব ও পুলিশ বক্সে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে তারা। 

আকস্মিক এই হামলায় কর্তৃপক্ষ কিছুটা ভ্যাবাচেকা খেয়েছে সন্দেহ নেই। কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে শিবিরের কর্মীদের দায়ী করার সহজ পথটি বেছে নিয়েছে তারা। তবে ছাত্রলীগের দুটি গ্রুপ পরস্পরকে দায়ী করে বক্তব্য দিতে শুরু করলে এই সন্দেহ যে অমূলক, তা প্রমাণিত হয়েছে। তারপরও বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন ছাত্রলীগের নাকের ডগায় শিবিরকর্মীরা এমন কর্মকাণ্ডে অংশ নেবে—এ যুক্তি ক্যাম্পাসের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে যারা অবগত, তাদের কাছে হাস্যকর বলেই মনে হবে।

সেদিন রাতে যারা ভাঙচুর চালিয়েছে ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতি করেছে, তাদের শাস্তি হোক—এটা আমরা চাই। মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, উপাচার্য ও পরিবহন দপ্তর থেকে ১৫ লাখ টাকা চাঁদা না পেয়ে এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে। মামলায় চিহ্নিত ১৪ জন আসামির ১২ জনই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী। পুলিশও বলছে, এ হামলার ঘটনা পরিকল্পিত। এখন সেই চিহ্নিত আসামিদের ধরা হোক, সাধারণ শিক্ষার্থীদের কেউ যাতে ভুক্তভোগী না হয়। 

যাহোক, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ১৪ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা আরও এক হাজার জনকে আসামি করে দুটি মামলা করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক হাজার ছাত্রের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের মতো ঘটনা এর আগে আর কখনো ঘটেছে বলে আমাদের জানা নেই। এই বিরাটসংখ্যক ছাত্রের বিরুদ্ধে মামলা আমাদের সামনে দুটি প্রশ্ন তুলে ধরছে—এক. ‘অজ্ঞাতনামার’ ভিড়ে নিরীহ কিছু ছাত্রকে ফাঁসানো হবে না তো? দুই. একটি ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডে এত বেশিসংখ্যক ছাত্র কেন জড়িয়ে পড়ল? 

প্রথম প্রশ্নের উত্তর না–বোধক হোক, এটাই আমাদের চাওয়া। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে এই ‘অপরাধীদের’ ক্ষোভ ও বঞ্চনার জায়গাটি শনাক্ত করতে হবে। শিক্ষার্থীরা অনেক দিন ধরেই শাটল ট্রেনের সংখ্যা ও বগি বাড়ানোর দাবি জানিয়ে আসছে। তাদের এই দাবি তো মানা হয়ইনি, বরং ট্রেনে প্রায় সময়ই যোগ করা হয় মালবাহী বগি। 

ট্রেনের সংখ্যা ও বগি বাড়ানো প্রসঙ্গে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য বিশ্ববিদ্যালয় ও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, ‘শাটল ট্রেনের কোচ ও ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য বারবার তাগিদ দেওয়া সত্ত্বেও রেলওয়ে বিষয়টি আমলে নিচ্ছে না।’ এ কথা নাকচ করে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বলছে, ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যেভাবে ট্রেন চালানোর কথা বলবে, আমরা সেভাবেই কোচ কম্পোজিশন ও শিডিউল নির্ধারণ করি। ফলে বগি বা ট্রেনের সংখ্যা কম হওয়ার বিষয়টি রেলওয়ের ওপর বর্তায় না।’ 

এই পরস্পরবিরোধী বক্তব্যের মধ্যে কোনটি ঠিক, তা আমরা জানি না। তবে শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা দেখার দায়িত্ব যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের, সেটা জানি। রেলওয়ের বারবার তাগিদ দেওয়ার পরও যদি তারা তা আমলে না নেয়, সেটাও দর-কষাকষির ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দক্ষতা-যোগ্যতার ঘাটতি বলেই তো মনে হয়।

সেদিন রাতে যারা ভাঙচুর চালিয়েছে ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতি করেছে, তাদের শাস্তি হোক—এটা আমরা চাই। মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, উপাচার্য ও পরিবহন দপ্তর থেকে ১৫ লাখ টাকা চাঁদা না পেয়ে এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে। মামলায় চিহ্নিত ১৪ জন আসামির ১২ জনই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী। পুলিশও বলছে, এ হামলার ঘটনা পরিকল্পিত। এখন সেই চিহ্নিত আসামিদের ধরা হোক, সাধারণ শিক্ষার্থীদের কেউ যাতে ভুক্তভোগী না হয়। 

প্রসঙ্গক্রমে বলি, ২০১৯ সালের জুলাই মাসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম। তিনি শিক্ষার্থীদের যাতায়াতব্যবস্থা সরেজমিন দেখার জন্য নিজে চট্টগ্রাম শহর থেকে শাটল ট্রেনে চড়ে ক্যাম্পাসে এসেছিলেন। সেই সফরের সময় মন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, শিক্ষার্থীদের জন্য শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কোচ দেওয়া হবে। এতে থাকবে ওয়াই-ফাই ও শৌচাগারের ব্যবস্থা। পরবর্তী জুন মাসের মধ্যে ১৫ থেকে ১৬টি বগির একটি নতুন ট্রেন বিশ্ববিদ্যালয়কে দেওয়া হবে বলেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি।

এর মধ্যে পেরিয়ে গেছে চারটি বছর। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কোচ বা ওয়াই-ফাই দূরে থাক, একটি সাধারণ ট্রেনও বাড়ল না। নিয়মিত দুর্ভোগ একটুও কমল না। এই প্রতারিত হওয়ার বোধ, হতাশার বোধ সময়-সুযোগে যে বিস্ফোরণের সৃষ্টি করবে, এটাই তো স্বাভাবিক। ফলে বিক্ষোভকারীদের শাস্তি দেওয়ার আগে তার প্রতি অন্যায় হয়েছে কি না, সেটাও ভাবতে হবে। নইলে পুনরাবৃত্তি রোধ করা যাবে না।

বিশ্বজিৎ চৌধুরী প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক, কবি ও সাহিত্যিক