ইউক্রেন যুদ্ধ যেভাবে বৈশ্বিক অস্ত্রবাজার ওলট–পালট করে দিচ্ছে

ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়া তাদের অস্ত্রের একটি বড় চালান ভারতে সরবরাহ করতে পারেনি
ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়া তাদের অস্ত্রের একটি বড় চালান ভারতে সরবরাহ করতে পারেনি

ভারতের বিমানবাহিনী গত ২১ মার্চ বলেছে, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়া তাদের অস্ত্রের একটি বড় চালান সরবরাহ করতে পারেনি। ২০২২ সালে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু করার পর মস্কো যতগুলো অস্ত্র চুক্তির শর্ত পূরণে ব্যর্থ হয়েছে, এটি তার সর্বশেষ উদাহরণ।

ভারত বিশ্বের বৃহত্তম অস্ত্র আমদানিকারক দেশ এবং তাদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ হলো রাশিয়া। অর্থাৎ ভারতের প্রতিরক্ষা খাতে রাশিয়ার বড় ধরনের ভূমিকা আছে। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়া আগের মতো ভারতকে অস্ত্র সরবরাহ করতে পারছে না। বাধ্য হয়ে ভারতকে বিকল্প প্রতিরক্ষা হিসেবে নিজের ভূখণ্ডে অস্ত্র তৈরি এবং অন্য বিদেশি সরবরাহকারীদের কাছ থেকে অস্ত্র নেওয়ার বিষয়টি ভাবতে হচ্ছে।

যুদ্ধ শুরুর পর থেকে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা ব্যয়বৃদ্ধি ইঙ্গিত দিচ্ছিল, দেশটির অভ্যন্তরীণ অস্ত্র নির্মাতারা রাষ্ট্রের স্থিতিশীল চাহিদার ওপর নির্ভরশীল থাকতে পারবে। কিন্তু রাশিয়ার ওপর বাইরের দেশগুলো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় রাশিয়ার অস্ত্র কোম্পানিগুলো আন্তর্জাতিক অস্ত্র বাজারে নিজেদের পণ্য ঠিকমতো সরবরাহ করতে পারছে না।

দ্য স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (সিপরি) একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলেছে, ২০১৮ থেকে ২০২২ সালের মধ্যকার মোট বৈশ্বিক অস্ত্র রপ্তানির ৮০ ভাগই করেছে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ফ্রান্স, চীন, জার্মানি ও ইতালি—এই ছয়টি দেশ।

এদের মধ্যে প্রথম স্থানে থাকা যুক্তরাষ্ট্র রপ্তানি করেছিল ৪০ শতাংশ অস্ত্র। আর যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে অনেক ব্যবধানে থেকে মাত্র ১৬ শতাংশ অস্ত্র রপ্তানি করে দ্বিতীয় স্থানে ছিল রাশিয়া।

বিশ্বে মোট কত ডলারের অস্ত্র কেনাবেচা হয়ে থাকে তা সুনির্দিষ্ট করে বলা অসম্ভব, কারণ একই অস্ত্র বিভিন্ন দামে বিক্রি হতে পারে। বৈধ পথে অস্ত্র বিক্রির পাশাপাশি কালোবাজারেও অস্ত্র বেচাকেনা হয়ে থাকে।

বিভিন্ন দেশের জাতীয় অস্ত্র শিল্পের সক্ষমতা কমতে-বাড়তে পারে। যেমন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়ার অস্ত্র শিল্পে রাষ্ট্রীয় তহবিলের বরাদ্দ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গিয়েছিল। অথচ তার আগে মস্কোর নিয়ন্ত্রণে থাকা অস্ত্র তৈরির পরিকাঠামোর বেশির ভাগই সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নজুড়ে বিস্তৃত ছিল।

১৯৬০–এর দশকে চীন ও ভারতে রাশিয়ার রপ্তানি বৃদ্ধি মস্কোর অস্ত্র শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করেছিল। ২০০০ সালে ভ্লাদিমির পুতিন ক্ষমতায় আসার পর তিনি সাবেক ক্রেতাদের ওপর ভিত্তি করে এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকাজুড়ে রাশিয়ার অস্ত্র বাজার তৈরি করেন।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার প্রতিরক্ষা শিল্প সস্তা ড্রোন উৎপাদনের চেষ্টা করে যাচ্ছে। ২০২০ সালে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের যুদ্ধে ড্রোনের ব্যবহারের ব্যাপক প্রভাব থাকার ঘটনা তাদের এ বিষয়ে মনোযোগী করেছে। এ ড্রোন উৎপাদনে তুরস্ক অনেক এগিয়ে রয়েছে। আর্মেনিয়া-আজারবাইজান যুদ্ধ ছাড়াও লিবিয়া ও সিরিয়ার যুদ্ধে রুশ সমর্থকদের বিরুদ্ধে তুর্কি ড্রোন ব্যবহৃত হয়েছে। ইউক্রেনের কাছেও তুরস্ক এ ড্রোন বিক্রি করেছে।

তবে ২০১৪ সালে প্রথম দফায় রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার পর দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্র রপ্তানিকারক রাশিয়া বিপাকে পড়েছে। পশ্চিমের নিষেধাজ্ঞায় রাশিয়ার প্রযুক্তি আমদানি সীমিত হয়ে পড়েছে। যে দেশগুলো রাশিয়ার কাছ থেকে অস্ত্র কিনছে, তাদের পশ্চিমা শাস্তির মুখে পড়তে হচ্ছে। তবে চীনের কাছে রাশিয়ার অস্ত্র বিক্রি ২০০০–এর দশক থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। শুধু তাই নয়, চীন এখন নিজেদের অস্ত্র কারখানা বৃহৎ পরিসরে গড়ে তোলার কারণে বেইজিং নিজেদের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি এখন রাশিয়া যেসব দেশে অস্ত্র বিক্রি করে থাকে, সেখানেও অস্ত্র বেচতে শুরু করেছে।

ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা শিল্প ঝামেলায় পড়েছে। ক্রেমলিন ক্রেতা দেশগুলোর কাছে তাদের অস্ত্র পৌঁছে দিতে বাধা পাচ্ছে। এর সুযোগ নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। রাশিয়া চীনের কাছে সামরিক সহায়তা চেয়েছে বলে ২০২২ সালের মার্চে মার্কিন গোয়েন্দারা ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, যদিও সেই দাবি মস্কো ও বেইজিং উভয়েই অস্বীকার করেছে। রাশিয়া কিছু সামরিক যন্ত্রাংশের জন্য ভারতের এবং গোলার জন্য উত্তর কোরিয়ার কাছে হাত পেতেছে এবং ইরানের কাছ থেকে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র কিনেছে বলেও খবর বেরিয়েছে।

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ঠিক তার উল্টো হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র তার উদ্বৃত্ত অস্ত্র ও সামরিক যান থেকে তিন হাজার কোটি ডলারের অস্ত্র ইউক্রেনের কাছে বিক্রি করেছে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুদ্ধে না গিয়েও রাশিয়ার সামরিক সক্ষমতাকে উল্লেখযোগ্যভাবে দুর্বল করে দিতে পেরেছে।

ইউক্রেনের কাছে এবং রাশিয়া ও চীনের আধিপত্যের আতঙ্কে পড়া দেশগুলোর কাছে ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র রপ্তানি অনেক বেড়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো আরও বেশ কিছু দেশ রাশিয়ার সামরিক শিল্প বেকায়দায় পড়ার বিষয়টিকে সুযোগ হিসেবে নিয়েছে।

২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বৈশ্বিক মোট অস্ত্র রপ্তানির ৭ শতাংশ ছিল ফ্রান্সের দখলে। ২০১৮ থেকে ২০২২ সালে তা ১১ শতাংশে উঠে এসেছে। রাশিয়ার কাছ থেকে দীর্ঘদিন ধরে অস্ত্র আমদানি করা দেশ সার্বিয়ায় পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে মস্কো অস্ত্র পাঠাতে পারছে না। এ কারণে বিকল্প উৎস হিসেবে সার্বিয়া ফ্রান্স থেকে সামরিক বিমান কিনবে বলে ঘোষণা দিয়েছে।

অন্যদিকে ২০২২ সাল জার্মানির জন্য ছিল জার্মান ইতিহাসে তাদের দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্র রপ্তানির বছর।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার প্রতিরক্ষা শিল্প সস্তা ড্রোন উৎপাদনের চেষ্টা করে যাচ্ছে। ২০২০ সালে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের যুদ্ধে ড্রোনের ব্যবহারের ব্যাপক প্রভাব থাকার ঘটনা তাদের এ বিষয়ে মনোযোগী করেছে। এ ড্রোন উৎপাদনে তুরস্ক অনেক এগিয়ে রয়েছে। আর্মেনিয়া-আজারবাইজান যুদ্ধ ছাড়াও লিবিয়া ও সিরিয়ার যুদ্ধে রুশ সমর্থকদের বিরুদ্ধে তুর্কি ড্রোন ব্যবহৃত হয়েছে। ইউক্রেনের কাছেও তুরস্ক এ ড্রোন বিক্রি করেছে।

চীন যদিও এখনো ইউক্রেন কিংবা রাশিয়াকে অস্ত্র দিচ্ছে না, কিন্তু চীনের সবচেয়ে বড় বেসামরিক ড্রোন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান দুটি দেশেই ড্রোন সরবরাহ করে যাচ্ছে।

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

  • জন পি রুহেল ওয়াশিংটন ডিসিতে বসবাসকারী একজন অস্ট্রেলিয়ান-আমেরিকান লেখক ও সাংবাদিক। তিনি স্ট্র্যাটেজিক পলিসির কন্ট্রিবিউটিং এডিটর