ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পসের (আইআরজিসি) জ্যেষ্ঠ কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ রেজা জাহেদির হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি নতুন উত্তেজনা তৈরি করেছে
ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পসের (আইআরজিসি) জ্যেষ্ঠ কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ রেজা জাহেদির হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি নতুন উত্তেজনা তৈরি করেছে

ইরানকে কেন যুদ্ধের প্ররোচনা দিচ্ছে ইসরায়েল?

লেবানন অথবা সিরিয়ায় কিংবা অন্য কোথাও ইসরায়েল যে বিমান হামলা চালাচ্ছে, সেটা মোটেই বিস্ময়কর ঘটনা নয়। এ ধরনের হামলাকে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী ‘যুদ্ধগুলোর মাঝের অভিযান’ বলে মনে করে। ইসরায়েল মনে করে, আঞ্চলিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় ইরানের যে আকাঙ্ক্ষা, সেটা ঠেকাতেই এই অভিযান।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এসব বিমান হামলা সরাসরি ইরান অথবা মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে থাকা দেশটির প্রক্সিদের উদ্দেশ্য চালানো হয়। বিশেষ করে লেবাননে হিজবুল্লাহর ওপর। এ ধরনের হামলা দশকের পর দশক ধরে ইসরায়েল চালিয়ে আসছে। কিন্তু গত সোমবার ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোর (আইআরজিসি) জ্যেষ্ঠ কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ রেজা জাহেদির হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি, গাজা যুদ্ধের কারণে নাজুক ও সংকটাপন্ন হয়ে ওঠা আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতার পালে নতুন উত্তেজনার রসদ তৈরি করল। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ রেজা জাহেদি ছিলেন কুদস ফোর্সের সিরিয়া ও লেবাননের কমান্ডার।

এ হত্যাকাণ্ডে তেহরান যে তাৎক্ষণিকভাবে সময়, সুযোগ ও পছন্দ অনুযায়ী প্রতিশোধে নেওয়ার ঘোষণা দেবে, সেটাও বিস্ময়কর কোনো ব্যাপার নয়। কিন্তু এ ঘটনা ইসরায়েল ও ইরানকে একটা সরাসরি সংঘাতের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে একটা বড় যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার বড় ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

‘যুদ্ধগুলোর মাঝের অভিযান’—এ ধারণার মানে হচ্ছে স্বল্প মাত্রার, সমন্বিত ও প্রতিপক্ষকে আগে থেকেই ঘায়েল করার যুদ্ধ। এ যুদ্ধের উদ্দেশ্য হলো, ইরান ও প্রক্সিদের ব্যতিব্যস্ত রাখা এবং স্থায়ীভাবে তাদের প্রতিরক্ষামূলক অবস্থানে আটকে রাখা। কিন্তু গত ছয় মাসে পরিস্থিতি মৌলিকভাবে বদলে গেছে। পরিস্থিতি এখন এমন যে আগের হিসাব-নিকাশ বদলে গিয়ে যেকোনো মুহূর্তে সত্যিকারের বিপদ এসে হাজির হতে পারে। সর্বাত্মক সংঘাতের একটা সত্যিকারের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এ ধরনের কোনো সংঘাত পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে যুদ্ধ ও বিশৃঙ্খলার মধ্যে টেনে নিয়ে যাবে।

কমান্ডার জাহেদি ও দামেস্কে ইরানের কনস্যুলেটে হামলার ঘটনা অতীতের হামলাগুলোর থেকে ভিন্ন। এর প্রভাবও ভিন্ন। এ হামলা থেকে মনে হচ্ছে যে ইসরায়েল ইরান ও লেবাননের প্রক্সি হিজবুল্লাহকে ঠেকাতে বড় একটা বাজি ধরল। হিজবুল্লাহ সঙ্গে বৈরিতার একেবারে শেষ প্রান্তে যাওয়ার এবং ইরানের সঙ্গে সম্ভাব্য সরাসরি সংঘাতে জড়ানোর ঝুঁকি নিতে ইসরায়েল যে প্রস্তুত, সেই ইঙ্গিত এ হামলা থেকে মিলল।

অন্যদিকে ইসরায়েল একেবারে স্পষ্টভাবে তেহরানকে প্ররোচিত করল, এই আশায় যে এতে হিজবুল্লাহ ক্ষিপ্ত হয়ে তেল আবিবের ওপর প্রতিশোধ নেবে। তাহলে লেবাননে সশস্ত্র গোষ্ঠীটির ওপর বড় ধরনের হামলার অজুহাত তৈরি হবে। ইসরায়েলের অনেক রাজনীতিবিদ ও সামরিক কমান্ডার যেমনটা বলে আসছেন, গাজার হামাসের চেয়ে হিজবুল্লাহ তাদের ওপর বেশি অস্তিত্বগত হুমকি তৈরি করছে।

ইসরায়েল ক্রমাগতভাবে এমন একটা সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে, যা থেকে বেরিয়ে আসার কোনো পথ নেই। এই সংঘাতে ইসরায়েলের স্বার্থ যেমন উদ্ধার হচ্ছে না, মিত্রদের কারোর স্বার্থও উদ্ধার হচ্ছে না। যুদ্ধ প্রলম্বিত করে কেবল নেতানিয়াহুর ক্ষমতায় (যদিও তার সম্ভাবনা ক্ষীণ) থাকার অজুহাত তৈরি হচ্ছে।

দামেস্কে ইরানের কূটনৈতিক ভবনে ইসরায়েলের সরাসরি হামলা আইনগতভাবেই ইরানের সার্বভৌমত্বের ওপর সরাসরি আঘাত। এ ছাড়া কাসেম সোলাইমানির পর জাহেদির এই হত্যাকাণ্ড ইরানের সর্বোচ্চ পদাধিকারী কোনো সামরিক কর্মকর্তার মৃত্যু। ফলে এই হত্যাকাণ্ডে পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার ভীতি সৃষ্টি হয়েছে।

এ হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি প্রতিশোধ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, ‘জায়নবাদী শয়তানেরা অবশ্যই আমাদের বীর সন্তানদের হাতে শায়েস্তা হবে। এই অপরাধে আমরা তাদের অনুতাপ করতে বাধ্য করব।’

জাহেদিকে হারানোয় সিরিয়া ও লেবাননে সামরিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে ইরান। শুধু তা-ই নয়, এটা ইরানিদের সম্মানের বিষয়। ইরান কি আবারও তাদের সম্মানটা থুতু গিলে নেওয়ার মতো করে সহ্য করে নিয়ে ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি সংঘাত এড়াবে কি না, সেটা এখন দেখার ব্যাপার। কিন্তু ইরান সরকারের মধ্যেই অতিসত্বর ও কঠোর প্রতিশোধ নেওয়ার আওয়াজ উঠছে।

এটাও স্পষ্ট যে ওয়াশিংটন এখন ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের বিষয়ে দূরত্ব বজায় রাখছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদভিত্তিক ওয়েবসাইট অ্যাক্সিওস অনুযায়ী, ওয়াশিংটন ইরানকে বলছে, ‘সিরিয়ায় কূটনৈতিক এলাকায় ইসরায়েলের হামলার ঘটনার ব্যাপারে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এ হামলার সম্পর্কে আগাম কিছু জানতেন না তাঁরা।’ এটা পরিষ্কার যে অন্তত এ ঘটনার ক্ষেত্রে উত্তেজনা যেন না বাড়ে, যুক্তরাষ্ট্র সেই প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। ইসরায়েল যে বখে গেছে, যুক্তরাষ্ট্র তাদের বক্তব্যে সেটা বোঝাতে চাইছে।

দামেস্কের ইরানের কনস্যুলেটে ইসরায়েলের এই হামলা প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ওপর বাইডেন প্রশাসন যে আরও প্রভাব হারিয়েছে, তার দৃষ্টান্ত। এ হামলা বাইডেন প্রশাসনে কেবল ক্ষোভের জন্ম দিতে পারে। এ হামলায় শুধু তেহরানকে ধৈর্যের পরীক্ষায় ফেলা হলো না, ইসরায়েল তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্রকেও ধৈর্যের পরীক্ষায় ফেলল। গাজা যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ব্যাপক টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধবিরতির আহ্বান নাকচ করে এবং গাজায় আরও মানবিক ও ত্রাণ কার্যক্রম ঠেকিয়ে দিয়ে এ পরিস্থিতি তৈরি করেছে ইসরায়েল।

গাজা যুদ্ধে ইসরায়েল কাদাপানিতে আটকা পড়েছে, প্রায় সবটা আন্তর্জাতিক সমর্থন হারিয়ে ফেলেছে। এ পরিস্থিতিতে দামেস্কে হামলা চালিয়ে তারা কী অর্জন করতে চেষ্টা করছে, তার মর্ম উদ্ধার করা বিস্ময়কর একটা ব্যাপার হবে। ইসরায়েল ক্রমাগতভাবে এমন একটা সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে, যা থেকে বেরিয়ে আসার কোনো পথ নেই। এই সংঘাতে ইসরায়েলের স্বার্থ যেমন উদ্ধার হচ্ছে না, মিত্রদের কারোর স্বার্থও উদ্ধার হচ্ছে না। যুদ্ধ প্রলম্বিত করে কেবল নেতানিয়াহুর ক্ষমতায় (যদিও তার সম্ভাবনা ক্ষীণ) থাকার অজুহাত তৈরি হচ্ছে।

আঞ্চলিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় ইরানের আকাঙ্ক্ষা আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতার জন্ম দিচ্ছে। ইরানের সমর্থনে হামাস ও হিজবুল্লাহ ইসরায়েলের ওপর হুমকিও তৈরি করছে। কিন্তু সামরিক পথে ইসরায়েলের পক্ষে এই হুমকি অপসারণ করা যে সম্ভব নয়, গাজা যুদ্ধ তার প্রমাণ।

  • ইয়োসি মেকেলবার্গ, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক, থিঙ্কট্যাংক চ্যাটাম হাউসের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা কর্মসূচির অ্যাসোসিয়েট ফেলো
    আরব নিউজ থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত